ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

শেবাচিমে পরীক্ষার যন্ত্রপাতি নষ্ট, সুযোগ সন্ধানীদের দৌরাত্ম্য

মুশফিক সৌরভ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৪১ ঘণ্টা, নভেম্বর ৪, ২০২০
শেবাচিমে পরীক্ষার যন্ত্রপাতি নষ্ট, সুযোগ সন্ধানীদের দৌরাত্ম্য হাসপাতালে রোগীরা। ছবি: বাংলানিউজ

বরিশাল: সাধারণ চিকিৎসক সংকটের মধ্যেই শিক্ষানবিস চিকিৎসকদের কর্মবিরতির কারণে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালের রোগীদের ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। যদিও হাসপাতাল প্রশাসনের হস্তক্ষেপে চতুর্থ দিন মঙ্গলবার (৩ নভেম্বর) দুপুরে এসে কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে নিয়েছেন ইন্টার্নরা।

এই কর্মবিরতির কারণেই কমিশন বাণিজ্যের মতো একটি বিষয় সামনে বেরিয়ে এলেও এটি নিয়ে এখন আর কথা বলতে চাচ্ছেন না কেউই। যদিও কমিশন বাণিজ্য নিয়েই চিকিৎসকদের দুটি পক্ষের মধ্যে বিরোধের সূত্রপাত ঘটে বলেও দাবি করা হচ্ছে। এর ফলে রোগীরা যে, ভোগান্তির শিকার হন, তা রোধ এবং কমিশন বাণিজ্য বন্ধের দাবি জানিয়েছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।

হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রোগীদের চিকিৎসাসেবার সহায়ক বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সরকার কর্তৃক প্রতিনিয়ত আধুনিক মেশিনারিজ দেওয়া হয়ে থাকে দক্ষিণাঞ্চলের সর্বাধুনিক ও সর্ববৃহত শেবাচিম হাসপাতালে। তবে সে যন্ত্র যতই ব্যয়বহুল হোক না কেন, কিছুদিনের মধ্যেই সেগুলো বিকল হয়ে পড়ছে, যা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে একেবারেই বিপরীত। এখন হাসপাতালে থাকা সিটিস্ক্যান, এমআরআই, ল্যাসিক মেশিন নষ্ট থাকায় এগুলোর সেবা পাচ্ছে না রোগীরা। আবার ক্যানসার রোগীদের জন্য কোবাল্ট-৬০ মেশিন, এনজিও গ্রাম মেশিন, দুই তৃতীয়াংশ এক্স-রে মেশিন, আল্ট্রাসানো মেশিনও বিকল থাকায় হাসপাতাল থেকে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছে না রোগীরা। আবার নির্ধারিত সময় ও নির্ধারিত সংখ্যা থাকাতেও হাসপাতালে পরীক্ষা করাতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়ে রোগীরা। এর বাইরে জনবলসহ নানান সংকটের কারণে মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষাও বন্ধ থাকে হাসপাতালে। কিন্তু সেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রতিনিয়ত হচ্ছে হাসপাতালের সামনে থাকা ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে। হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট স্টাফদের তথ্যানুযায়ী, প্যাথলজিসহ-পরীক্ষা-নিরীক্ষার গোটা বিভাগ চলে প্রভাবে। যেখানে প্রভাব খাটিয়ে কেউ বছরের পর বছর ধরে ডেপুটেশনে অন্যত্র থাকছেন। আবার কেউ প্রভাব খাটিয়ে যোগ্যতা না থাকলেও এই বিভাগে আসছেন। আবার যারা একটু দক্ষ পদে রয়েছেন, তাদের বেশিরভাগই বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। কেউ রয়েছেন মালিকানায়, কেউ রয়েছেন কর্মে। আর তাদের কারণেই হাসপাতালের কিছু চিকিৎসকদের সঙ্গে সক্ষতা গড়ে উঠেছে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর সঙ্গে। আর্থিকসহ নানানভাবে সুবিধা দিয়ে সেসব ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনুকূলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানোর পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে রোগীদের। আর এই সুবিধাতেই গত কয়েক বছরে হাসপাতালের সামনে একে একে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু ডায়গনস্টিক সেন্টার।

ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পরিচালনার দায়িত্ব থাকা স্টাফদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, হাসপাতাল থেকে একজন রোগীকে বাইরে ডায়াগনস্টিক সেন্টারে আনতে শুধু চিকিৎসকদের নয়, ওয়ার্ডবয়, আয়া, ট্রলিম্যানসহ সবাইকে আর্থিক সুবিধা দিতে হয়। আবার অনেক ডায়াগনস্টিক সেন্টার তো তাদের প্রতিনিধিও নিযুক্ত রাখেন হাসপাতালের গুরুত্বপূর্ণ ওয়ার্ডগুলোতে।

এদিক সাবেক ইন্টার্ন চিকিৎসকরা বলছেন, কমিশন বাণিজ্য নিয়ে মিড-লেভেলের চিকিৎসকদের সঙ্গে আগেও মনোমালিন্যের ঘটনা ঘটেছিল ইন্টার্নদের। তবে এবারের মতো কোনোবারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি।

তারা বলেন, ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে যে আর্থিক সুবিধা আসে তা অভ্যন্তরীণভাবে ওপেন-সিক্রেট ব্যাপার, তবে এটা কমিশন বাণিজ্য নয়। বছরের পর বছর ধরে চলা এ ধরনের সুবিধা দিয়ে ফান্ডের মাধ্যমে ভর্তির দিন, ওটির দিন নাস্তা, চিকিৎসকের বিদায় সংবর্ধনা, পিকনিকসহ নানানকাজে ব্যয় করা হয়ে থাকে। সিএ-রেজিস্ট্রার ভালো মনের মানুষ হলে অসহায় রোগীদেরও এই ফান্ড থেকেই সহায়তা করা হয়ে থাকে। সাবেক ইন্টার্নদের তথ্যানুযায়ী হাসপাতালের সব থেকে বেশি আর্থিক সুবিধা আসে এবং খরচ হয় অর্থোপেডিক্স ইউনিটে, তারপরে হয় মেডিসিন ইউনিটে। আবার নাক-কান-গলা ও চক্ষুতে খরচ হয় না বললেই চলে। তবে হাসপাতালের এখন চিকিৎসকদের দাবি কমিশন বাণিজ্য বলতে কোনো বিষয় নেই। তারা বলছেন, বেশিরভাগ ওয়ার্ডেই রোগীদের যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে, তা কোনো নির্ধারিত ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে মার্ক করে দেয় না চিকিৎসকরা। তবে একটি ভালো মানের ডায়াগনস্টিক সেন্টার দিয়ে পরীক্ষা করানোর কথাটি বলা হয়ে থাকতে পারে। আর কোনো ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পরীক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠলে সেক্ষেত্রে সেটিকে এড়িয়ে কেউ কেউ চলতেই পারেন। যদিও এটা যাদের দেখভালের বিষয়, সেই সিভিল সার্জন কার্যালয় নিজ উদ্যোগে হাসপাতালের সামনের ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে নামে মাত্র অভিযান চালায় বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।

তবে এ থেকে পরিত্রাণ চেয়ে হাসপাতালের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়ার দাবি রোগী ও তাদের স্বজনদের। এর ফলে ভালো মানের রিপোর্ট যেমন পাওয়া যাবে, তেমনি ব্যয়ও কমবে রোগীদের।

যদিও তদন্ত চলমান থাকায় এ বিষয়ে সরাসরি কিছু বলতে রাজি হননি হাসপাতাল প্রশাসন, তবে ২২ অক্টোবর ডা. মাসুদ খানের বিচার ও কমিশন বাণিজ্য বন্ধের দাবিতে স্মারকলিপি দেওয়ার সময় ইন্টার্নদের নানান অভিযোগের ভিত্তিতে হাসপাতাল পরিচালক ডা. বাকির হোসেন কমিশন বাণিজ্যের বিষয়ে কিছু জানেন না বলেও জানান।

আর তখন ইন্টার্ন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সজল পান্ডে, সাধারণ সম্পাদক তরিকুল ইসলামসহ নেতাদের সরাসরি অভিযোগ করেন মেডিসিন-৪ ইউনিটের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. মাসুদ খান রোগীদের নির্ধারিত ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যাওয়ার জন্য চাপ দিয়ে থাকেন, আর অন্য জায়গা থেকে রিপোর্ট নিয়ে এলে তা ফেলে দেন, অনেক সময় ছিঁড়েও ফেলেন। আর ডা. মাসুদ খান অসৎ উপায়ে টাকা-পয়সা নিচ্ছেন, তা ধামাচাপা দেওয়ার জন্যই ইন্টার্নদের বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ তুলেছেন তিনি। যদিও ডা. মাসুদ খানের দাবি এসব অভিযোগ মিথ্যে। কেউ যদি প্রমাণ দিতে পারে তাহলে তিনি চাকরি ছেড়ে চলে যাবেন।

এ বিষয়ে জানতে ইনডোর ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিকে কল করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।

আউটডোর ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ডা. সৌরভ সুতার বলেন, হাসপাতালে সিন্ডিকেটের কোনো বিষয় নেই, এমনকি নির্ধারিত কোনো ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যাওয়ার জন্য রোগীদের চিকিৎসকরা বাধ্যও করেন না। কেউ করে থাকলে সেটা ওই চিকিৎসকের ব্যক্তিগত বিষয়। ভেতরের মেশিন নষ্ট থাকাসহ নানান কারণে রোগীরাই বাইরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাচ্ছেন।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৩৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৪, ২০২০
এমএস/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।