কুমিল্লা: কুমিল্লায় ভয়ানক রূপ ধারণ করেছে করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি। জেলা সিভিল সার্জন অফিসের দেওয়া তথ্য মতে গেল ৭ দিনেই এ জেলায় প্রাণ হারিয়েছেন ৩০ জন করোনা পজিটিভ রোগী।
স্থানীয়রা বলছেন স্বাস্থ্য বিভাগ ও সিভিল সার্জন অফিসের তথ্যের বাইরে উপসর্গ নিয়ে কি পরিমাণ মুত্যু রয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই, এর সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যাবে। কাগজে-কলমে সর্বমোট ১৫ হাজার ৯৫৫ জন আক্রান্ত হওয়ার বিপরীতে সুস্থ হয়েছেন ১২ হাজার ১১২ জন। তবে জেলার সর্বত্র ঘরে ঘরেই জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্টসহ করোনা উপসর্গের রোগী।
চিকিৎসকরা বলছেন, ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকা ও অধিক জনসংখ্যার নগরী হওয়ায় কুমিল্লায় করোনা দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। করোনার ডেল্টা ধরনের কারণে দিন দিন বাড়ছে মৃত্যু হার। হাসপাতালগুলোতে স্বল্পতা দেখা দিয়েছে অক্সিজেনের। কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ (কুমেক) হাসপাতালে তৈরি হয়েছে রোগীদের রয়েছে উপচেপড়া চাপ, করোনা ইউনিটে জায়গা না পেয়ে রোগীরা বারান্দায় এবং মেঝেতে অবস্থান করছেন। ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) শয্যাসমূহ নেই খালি।
কুমিল্লা জেলা সিভিল সার্জন অফিসের সর্বশেষ দেওয়া তথ্য মতে, এর মধ্যে গেল সপ্তাহের বৃহস্পতিবার ৫ জন, শুক্রবার ২ জন, চলতি সপ্তাহের শনিবার ২ জন, রোববার ৩ জন, সোমবার ৪ জন, মঙ্গলবার ৭ জন ও বুধবার ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। দৈনিক শনাক্ত ৪৫ শতাংশ, বিপরীতে সুস্থ ১৯ শতাংশ, চিকিৎসাধীন রয়েছে ৩ হাজার ৮৪৩ জন, গড় মৃত্যু ৩ দশমিক ১৭ শতাংশ।
শনাক্তের চেয়ে সুস্থ্যের হার কম
স্বাস্থ্য বিভাগের দেওয়া তথ্য মতে, দৈনিক সংক্রমণ শনাক্তের হার কুমিল্লায় যেখানে ৪৫ শতাংশের বেশি, তার তুলনায় সুস্থ হওয়ার হার মাত্র ১৯ শতাংশ। সর্বশেষ বুধবার একদিনে ৩৯৩ জন করোনা ভাইরাসে শনাক্ত হওয়ার বিপরীতে সুস্থ হয়েছেন ৭৫ জন। সর্বমোট ১৫ হাজার ৯৫৫ জন আক্রান্ত হওয়ার বিপরীতে সুস্থ হয়েছেন ১২ হাজার ১১২ জন। অর্থাৎ এখনো কুমিল্লায় ৩ হাজার ৮৪৩ জন করোনা আক্রান্ত চিকিৎসাধীন।
বৃহস্পতিবার (৮ জুলাই) সকাল সাড়ে ৯টায় কথা হয় কুমেক হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. রেজাউল করিমের সঙ্গে।
তিনি বলেন, ২৪ ঘণ্টায় কুমেক করোনা ইউনিটে করোনা আক্রান্ত ছিলেন ১৪৯ জন। এছাড়া উপসর্গ নিয়েও ভর্তি আছেন অনেকে। এর মধ্যে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম থেকে হাই ফ্লো অক্সিজেন পাচ্ছেন ১৩৫ জন। বাকিদের সিলিন্ডার ও অক্সিজেন কনসেনট্রেটর থেকে অক্সিজেন সরবরাহ করা হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় কুমেক হাসপাতালে মারা গেছে আরো ৫ জন।
কুমেকে শয্যা সংকট, খালি নেই আইসিইউ
কুমেক হাসপাতাল সূত্র মতে, এ হাসপাতালে করোনা ইউনিটে বেড রয়েছে সর্বমোট ১৩৬টি। এর মধ্যে ২০টি আইসিইউ বেড এবং ১০টি এইচডিইউ বেড রয়েছে। এসব বেডের কোনোটিই খালি নেই, সবগুলোতেই রয়েছে রোগী। বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৯টায় ১৪৯ জন রোগী চিকিৎসাধীন আছেন। আরও ভর্তি হচ্ছে। এদের সবাইকে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহ করা যাচ্ছে না। নতুনদের সিলিন্ডার অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে।
শয্যা সঙ্কটের কারণে অধিকাংশ রোগীর ঠাঁই হয়েছে হাসপাতালের বারান্দা ও মেঝেতে। একাধিক নতুন মুমূর্ষু রোগীকে দেখা গেছে করোনা ইউনিটের নিচতলায় বেডের জন্য অপেক্ষা করতে। এছাড়াও রোগী নামানোর সিগন্যাল না পেয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে অক্সিজেন লাগিয়ে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। কুমেক হাসপাতালে জেলার ১৭ উপজেলা ছাড়াও ফেনী, চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আসছেন রোগীরা।
কুমেক হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. রেজাউল করিম বলেন, করোনা ইউনিটে ১৩৬টি বেডের বিপরীতে বর্তমানে ১৪৯ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন। আমরা সাধারণ বেডে নতুন রোগীরা ভর্তি রাখছি।
দুশ্চিন্তায় স্বাস্থ্য বিভাগ
স্বাস্থ্য বিভাগের দেওয়া তথ্য মতে, কুমিল্লায় ৩ হাজার ৮৪৩ জন করোনা আক্রান্ত হাসপাতাল ও নিজেদের বাড়িতে চিকিৎসাধীন আছেন। কুমেক ও সদর হাসপাতালের করোনা ইউনিটের ওপর চাপ কমাতে দুশ্চিন্তায় আছেন তারা।
জেলা সিভিল সার্জন মীর মোবারক হোসাইন বলেন, কুমিল্লার করোনা পরিস্থিতি ভালো না, অবস্থা বেগতিক, দিন দিন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, প্রতিদিন বাড়ছে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা। করোনার প্রথম ঢেউয়ের তুলনায় বর্তমানে সর্বোচ্চ শনাক্ত রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
সিভিল সার্জন বলেন, আমরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোকে ‘ব্যাক আপ’ হিসেবে প্রস্তুত করছি। যাদের অতিরিক্ত প্রেশারের অক্সিজেন না লাগবে তাদের স্ব-স্ব উপজেলায়ই চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা করছি।
তিনি আরও বলেন, মানুষ যদি এমন ভয়নক পরিস্থিতিতেও সচেতন না হয়, তাহলে কিছুই করা যাবে না। কোনোভাবেই লাগাম ধরা যাবে না মৃত্যুর মিছিলের। করোনার দৌড় হবে লাগামহীন।
কুমেকে স্থাপন হচ্ছে আরো একটি অক্সিজেন প্লান্ট
কুমেক হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. রেজাউল করিম বলেন, কুমেক হাসপাতালে নতুন আরো একটি প্লান্ট স্থাপন কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে যা থেকে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেমের মাধ্যমে একসঙ্গে ৫শ জনকে হাই ফ্লো অক্সিজেন দেওয়া সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩৬ ঘণ্টা, জুলাই ০৮, ২০২১
এসএইচডি/এএটি