খুলনা: খুলনা বিভাগে করোনা পরিস্থিতি বলা যায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে। দেশে রেকর্ড মৃত্যুর দিনে খুলনাও গড়েছে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড।
প্রতিনিয়ত খুলনা বিভাগে করোনায় মৃত্যুর মিছিল যে হারে বাড়ছে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন, উৎকণ্ঠিত সর্বমহল। কেউ বলছেন একবারে শেষ মুহূর্তে হাসপাতালে উপস্থিতি, পাকস্থলির কার্যকারিতা ক্ষীণ নিয়ে ভর্তি, অক্সিজেন সংকট, সতকর্তার ক্ষেত্রে উদাসীনতা ও স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন না করায় মৃত্যুর সংখ্যা পারদের মতো ওঠানামা করছে।
প্রিয়জন হারানোর কষ্টে ভেসে আসা কান্নার শব্দে প্রতিনিয়ত ভারি হয়ে উঠছে খুলনা বিভাগের হাসপাতালগুলো। প্রতিনিয়ত মৃত্যুর দৃশ্য দেখে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছেন পাশের শয্যায় চিকিৎসা নেওয়া অপর রোগীরা। শোকে স্তব্দ তারা। কোনো হাসপাতালে শয্যা খালি নেই, অক্সিজেন সংকট, আইসিইউ শয্যার অমিল। খুলনা মেডিক্যালের করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে ১৩০ বেড, খুলনা জেনারেল হাসপাতালের ৭০ বেড, বেসরকারি গাজী মেডিক্যাল হাসপাতালে ১৫০ বেড ও শহীদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালে ৪৫ বেড মিলিয়ে ৩৯৫ বেডে করোনারোগীরা সেবা নিচ্ছেন।
এই হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ এত বেশি যে অনেকে দূর-দূরান্ত থেকে এসেও ভর্তি হতে না পেরে ফিরে যাচ্ছেন। খুলনার চারটি করোনা বিশেষায়িত হাসপাতালসহ বিভাগের প্রতিটি জেলার হাসপাতালের একই চিত্র।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, সামনে আরো ভয়াবহ বিপদ। এভাবে যদি রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে আর সংক্রমণ রোধ না করা যায়, তাহলে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে।
খুলনা অক্সিজেন ব্যাংকের অর্থ সম্পাদক মো. আসাদ শেখ বাংলানিউজকে বলেন, যে কোনো মুহূর্তে অসহায় করোনায় আক্রান্ত মানুষকে বাঁচাতে অক্সিজেন ব্যাংক খুলে বিনামূল্যে অক্সিজেন সেবা দিচ্ছি আমরা। করোনা পরিস্থিতিতে যে কোনো সময়ের চেয়ে খুলনার অবস্থা খুবই ভয়াবহ। বৃহস্পতিবার রাতে সবচেয়ে বেশি রোগী মারা গেছেন খুলনায়। এত মানুষের মরদেহ আর আহাজারি দেখে স্তব্ধ হয়ে গেছি।
তিনি জানান, ইতোমধ্যে খুলনা অক্সিজেন ব্যাংকের মাধ্যমে প্রায় ১৮শ মানুষকে অক্সিজেন সেবা দেওয়া হয়েছে।
সার্চ মানবাধিকার সোসাইটি খুলনা মহানগর শাখার সভাপতির মাসুম উর রশিদ বাংলানিউজকে বলেন, আশঙ্কাজনক হারে খুলনায় বেড়েই চলেছে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চরম অক্সিজেন সংকট। করোনারোগীরা অক্সিজেন সিলিন্ডারের অভাবে প্রতিদিন ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। অক্সিজেন-সংকটে ভুগতে থাকা মানুষদের ফ্রি অক্সিজেন সেবা দিচ্ছি আমরা। দিন-রাত যে কোনো সময় রোগীরা জানালেই পৌঁছে দিচ্ছি অক্সিজেন।
এদিকে অনুজীব বিজ্ঞানীরা বলছেন, বর্তমানে শহর ও গ্রামে ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের আগ্রাসন মাত্রাতিরিক্ত। ওহান, আলফা ও বেটার চেয়ে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের জীবাণু মানুষের শরীরে দ্রুত প্রবেশ করার পাশাপাশি স্বল্প সময়ে একজনের শরীর থেকে অপরজনের শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। এমনকি এর প্রার্দুভাবও অনেক সময় বোঝা যায় না।
চলতি জুলাই মাসের ৯ দিনের খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের দফতর থেকে দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় মাঝেমধ্যে একটু কমবেশি হলেও এ সময়ে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে, ১ জুলাই বিভাগের ১০ জেলায় ৩৯ জনের মৃত্যু হয় এই সময়ে নতুন করে ১ হাজার ২৪৫ জনের করোনা শনাক্ত হয়। ২ জুলাই করোনা শনাক্তের সংখ্যা ছিল এক হাজার ২০১ জন। মারা যায় ২৭ জন। পরের দিন ৩ জুলাই এই সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৫৩৯ ও ৩২ জন। আর ৪ জুলাই এক হাজার ৩০৪ ও ৪৬ জন। যা ৫ জুলাই আরও বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ৪৭০ ও ৫১ জনে। ৬ জুলাই তা একটু কমে এক হাজার তিনশ ও ৪০ জন হলেও ৭ জুলাই রেকর্ডসংখ্যক আক্রান্ত হয় এক হাজার নয়শ এবং মারা যায় ৬০ জন। যা বৃহস্পতিবার ৮ জুলাই একটু কমে যথাক্রমে এক হাজার ৭৩২ ও ৫১ জনে দাঁড়িয়েছে। শুক্রবার বিভাগে সর্বোচ্চ ৭১ জনের মৃত্যু হয়েছে। শনাক্ত হয়েছে ১ হাজার ৬৫৬ জনের।
খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক রাশেদা সুলতানা জানান, খুলনা বিভাগে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৭১ জন মারা গেছেন। যা এ বিভাগে সর্বোচ্চ মৃত্যু। গত ২৪ ঘণ্টায় বিভাগের মধ্যে সর্বোচ্চ ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে খুলনা জেলায়। বাকিদের মধ্যে কুষ্টিয়ায় ১৪ জন, যশোরে ৯ জন, ঝিনাইদহে ১০ জন, চুয়াডাঙ্গায় ছয়জন, মেহেরপুরে পাঁচজন, বাগেরহাটে দু’জন, নড়াইল ও মাগুরায় একজন করে মারা গেছেন।
বাংলাদেশ সময়: ২২১২ ঘণ্টা, জুলাই ০৯, ২০২১
এমআরএম/এএ