লালমনিরহাট: রোগীদের রোগ নিরাময়ে ওষুধের চেয়ে খাদ্যাভ্যাসই বেশি কার্যকর। গ্রামীণ মায়েদের ভ্রান্ত ধারণা পরিবর্তন করতে ডা. আজমল হক নিজে চেম্বারে রেখেছেন ‘পুষ্টির ট্রে’।
রোগের ধরন দেখে ওষুধ লিখার আগে রোগীদের পুষ্টিকর খাদ্যে মনোনিবেশ করাতে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আজমল হক হাতে কলমে শেখাচ্ছেন রান্নার পদ্ধতিও। ওষুধের সঙ্গে পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যেমন বাড়ছে, তেমনি রোগ নিরাময়ও ঘটছে। তাই শিশুদের দীর্ঘ লাইন লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। ডা. আজমল হক এ হাসপাতালে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ জুনিয়র কনসালট্যান্ট পদে কর্মরত রয়েছেন। তিনি পুষ্টির ওপর জোর দেওয়ায় রংপুর বিভাগের সেরা চিকিৎসক পুরস্কারও অর্জন করেন।
জানা গেছে, শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে মানবদেহে বিভিন্ন রোগ বাসা বাধে। পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়। গ্রামীণ গর্ভবতী মায়েরা পেটের সন্তান মোটা হবে এবং এতে প্রসবে কষ্ট হবে ভেবে খাবার কমিয়ে দেন। যা মা ও নবজাতকের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এ ছাড়া মা ও শিশুদের শরীরে কোনো সমস্যা দেখা দিলে খাদ্য তালিকা থেকে কিছু খাবার বন্ধ করে দেন। ফলে ওই মা ও শিশু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারায়। যার ফলে রোগ নিরাময় করতে বেশ বেগ পেতে হয় এবং স্বাস্থ্যহানী ঘটে।
খাদ্যাভ্যাস ও খাদ্য গ্রহণের নিয়ম না জানার কারণে গ্রামীণ শিশুরা পুষ্টিহীনতায় ভোগে। যার কারণে মেধার বিকাশও ঘটছে না। গ্রামের বেশির ভাগ লোকজন মনে করে পুষ্টিকর খাবার হচ্ছে মাছ, মাংস ও ফল। আসলে তা নয়। একেকটি খাবারে একেকটি পুষ্টিগুণ বিদ্যমান। মৌসুমী ফল ও মৌসুমী সবজিতে প্রচুর পুষ্টিগুণ রয়েছে। অনেকের ধারণা, মসলা শুধু রান্নার স্বাদ বাড়ায়, যা ঠিক নয়। মসলাও পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ। তাই কোন রান্নায় কি পরিমাণ কোন মসলা ব্যবহার করলে খাবারে পুষ্টিগুণ ঠিক থাকবে, সেটা হাতে কলমে শেখাচ্ছেন ডা. আজমল হক। রোগী দেখার চেম্বারের টেবিলে সাজিয়ে রেখেছেন পুষ্টির ট্রে। যেখানে চাল, ডাল, আটা, তেল, মসলা, বিভিন্ন ফল ও সাবান রয়েছে তার ট্রেতে।
চেম্বারে আসা রোগীদের প্রথমে রান্নার কৌশল আর কোন খাবারে কি পুষ্টি, তা হাতে কলমে শিখিয়ে তবেই চিকিৎসার নির্দেশনা দেন তিনি। তার রুমে গেলে চিকিৎসকের চেম্বার মনে হবে না, মনে হবে এটি কোনো সবজির প্রদর্শনী কেন্দ্র।
চার মাসের শিশুর জ্বর নিয়ে হাসপাতালে আসা মা জান্নাতি বেগম বলেন, চিকিৎসকের কাছে এলে আগে বিভিন্ন টেস্ট করাতে বলেন। কিন্তু ডা. আজমল হকের নিয়মটা উল্টো। তিনি আগে জানতে চান, বাড়ির কি ধরনের খাবার খাওয়া হয়, সেসব খাবার রান্নার পদ্ধতিই বা কী? সব শুনে তিনি কোন খাদ্যে কোন পুষ্টি এবং পুষ্টিকর খাবার তৈরির পদ্ধতিও বর্ণনা করেন। সবশেষে চিকিৎসার প্রেসক্রিপশন লিখেন। সেই প্রেসক্রিপশনের ওপর লিখেন কোন রোগের জন্য কোন পুষ্টিকর খাবারটি খাওয়াতে হবে। তার চিকিৎসা পদ্ধতি বেশ ভালো।
হাসপাতাল গেটের এক ব্যবসায়ী বলেন, ডা. আজমল হক এ হাসপাতালে যোগদানের পর থেকে রোগীদের চাপ বেড়েছে। বিশেষ করে মা ও শিশুদের ভিড় বেড়েছে এ হাসপাতালে।
ডা. আজমল হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, গ্রামীণ মায়েরা নানান কুসংস্কারে নিমজ্জিত রয়েছেন। এখনও পুরনো আমলের চিন্তা ভাবনা নিয়ে চলেন। শিশুদের কিছু হলে ঝাড় ফুঁকের জন্য ছুটে যান। পরে রোগ অস্বাভাবিক বেড়ে গেলে হাসপাতালে আসেন। তখন চিকিৎসা দিতে বেশ সময় লাগে। পেটের সন্তান মোটা হওয়ার ভয়ে এখনও অনেক গর্ভবতী মাকে কম খাওয়ানো হয়। যা মা ও নবজাতকের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি। অথচ গর্ভবতী মায়েদের পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার প্রয়োজন। গর্ভের সন্তান বেঁচে থাকে মায়ের খাবার থেকে নির্যাস পেয়ে। তাই দ্বিগুণ খাবার প্রয়োজন গর্ভবতী মায়েদের। মৌসুমী ফল আর সবজিতে প্রচুর পুষ্টি। অথচ না জানার কারণে সহজে পাওয়া এ পুষ্টি থেকেও বঞ্চিত থাকে গ্রামীণ মা ও শিশুরা।
তিনি আরও বলেন, প্রথমে এসে এমন কুসংস্কার দেখে চিকিৎসা পদ্ধতিতে পরিবর্তন নিয়ে এসেছি। আগে পুষ্টির ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। পরে চিকিৎসা। তাই টেবিলে পুষ্টির ট্রে সাজিয়ে রেখেছি। চিকিৎসা নিতে আসা মায়েদের হাতে কলমে পুষ্টিকর খাদ্য ও তা রান্নার কৌশল বর্ণনা করা হয়। আশা করি, এখানে দেখে মায়েরা বাসায় গিয়ে শিশুদের এভাবে খাওয়ালে শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যেমন বাড়বে, তেমনি শিশুদের মেধারও বিকাশ ঘটবে। শিশুরা ভালো থাকলে ভালো থাকবে আগামীর বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ সময়: ১৩১৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৯, ২০২১
এসআই