ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ভারত

যেভাবে ভুয়া বিচারক ৯ বছর ধরে নকল আদালত চালাচ্ছিলেন

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২০৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০২৪
যেভাবে ভুয়া বিচারক ৯ বছর ধরে নকল আদালত চালাচ্ছিলেন

ঘটনাটি ভারতের গুজরাটের রাজধানী গান্ধীনগরের। সেখানে বেশ কয়েক বছর ধরেই নিজেকে বিচারক বলে দাবি জানানো এক ব্যক্তি ভুয়া আদালত পরিচালনা করছিলেন।

 

চলচ্চিত্রের গল্পকে হার মানিয়ে দিতে পারে এই বাস্তব ঘটনা, যার কেন্দ্রীয় চরিত্র অর্থাৎ সেই ভুয়া সালিশি আদালতের বিচারক এখন পুলিশের হেফাজতে।

মরিস স্যামুয়েল ক্রিশ্চিয়ান নামে ওই ব্যক্তিকে সম্প্রতি আদালতে পেশ করে পুলিশ। সেখানেও তিনি নিজেকে সালিশি আদালতের জাজ হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেন।  
শুধু তাই নয়, বিচারকের কাছে অভিযোগ করেন, পুলিশ তাকে মারধর করেছে এবং বাধ্য করেছে তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ স্বীকার করতে।

এরপর, তার ডাক্তারি পরীক্ষার নির্দেশ দেন আদালত।

সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার মরিস স্যামুয়েল ক্রিশ্চিয়ানের বিরুদ্ধে ভুয়া আদালত গঠন এবং জালিয়াতি করে রায় দেওয়ার অভিযোগে অবিলম্বে প্রতারণা ও ষড়যন্ত্রের মামলা দায়ের করার নির্দেশ দেন সিটি সিভিল কোর্টের বিচারক জয়েশ এল চৌতিয়া। আদালত তাকে ১০ দিনের জেল হেফাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

কীভাবে সাধারণ মানুষকে প্রতারণা করছিলেন নিজেকে সালিশি বিচারক বলে দাবি জানানো এই ব্যক্তি এবং কী করে তিনি এত বছর এই নকল আদালত চালিয়ে এসেছেন, সে বিষয়ে জানতে এই মামলার সঙ্গে যুক্ত আইনজীবী ও এক পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি গুজরাটি।

মরিস স্যামুয়েল ক্রিশ্চিয়ান গত নয় বছর ধরে এই কাজ করে আসছিলেন। পুলিশ জানায়, এই ব্যক্তির দাবি, আইনে পিএইচডি করেছেন তিনি। আহমেদাবাদ, ভদোদরা ও গান্ধীনগরে জমি বিবাদে সালিশি পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেছেন বলে দাবি করেছেন।

আহমেদাবাদ জোন-২ এর ডেপুটি পুলিশ কমিশনার (ডিসিপি) শ্রীপাল শেশমা বিবিসিকে বলেন, মরিস ক্রিশ্চিয়ান আদতে সবরমতীর বাসিন্দা। কয়েক বছর আগে গান্ধীনগরে ভুয়া আদালত খোলেন মরিস। পুলিশে অভিযোগের জেরে সেই আদালতের ঠিকানা বদলে ফেলতে বাধ্য হন। বর্তমানে গান্ধীনগরের সেক্টর ২৪-এ একটা ভুয়া আদালত চালাচ্ছিলেন তিনি।  

পুলিশ জানায়, সিটি সিভিল কোর্টে মরিস স্যামুয়েল ক্রিশ্চিয়ান স্বীকার করেছেন, তিনি গত এক বছরে গান্ধীনগর, আহমেদাবাদ ও ভদোদরা মিলিয়ে ৫০০টি বিতর্কিত জমি সংক্রান্ত মামলার রায় দিয়েছেন।

এক সময় মরিস স্যামুয়েল ক্রিশ্চিয়ানের প্রতিবেশী ছিলেন স্যামুয়েল ফার্নান্দেজ। তিনি আহমেদাবাদের সবরমতীর কবীর চক এলাকার বহুদিনের বাসিন্দা।

বিবিসিকে ফার্নান্দেজ বলেন, ছেলেবেলা থেকেই অনেক বড় বড় স্বপ্ন দেখতেন মরিস। লোকজনের কাছ থেকে টাকা ধার নিতেন। মরিসের মা গোয়ার বাসিন্দা ছিলেন আর বাবা রাজস্থানের।

তিনি বলেন, অনেকের কাছ থেকে টাকা ধার নেন মরিস কিন্তু কখনও ফেরত দেননি। এ অভ্যাসের কারণে সবরমতীর সবাই তার কাছ থেকে দূরে থাকতে শুরু করেন।  

তিনি আরও বলেন, এক সময় ওই এলাকা ছেড়ে চলে যায় মরিসের পরিবার। তার কয়েক বছর পরে যখন আমাদের দেখা হয়েছিল, তখন মরিস জানিয়েছিলেন, তিনি বিদেশে পড়াশোনা করেছেন এবং বিচারক হয়েছেন।

স্যামুয়েল ফার্নান্দেজের মতে, বড় কর্মকর্তাদের মতো জীবনযাপন করতেন মরিস স্যামুয়েল ক্রিশ্চিয়ান। তিনি গাড়িতে ভ্রমণ করতেন। এমনকি তার ব্যাগ ধরে রাখার জন্য একজন ব্যক্তি ছিলেন।

মামলায় সরকারি আইনজীবী আদালতে যে তথ্য পেশ করেছেন, সেখান থেকে জানা গেছে, ২০১৫ সালে মধ্যস্থতাকারী নিয়োগ শুরু করে সরকার। কারণ ছিল আদালতে দায়ের হওয়া বিপুল সংখ্যক মামলার বোঝা। এক্ষেত্রে উভয় পক্ষের সম্মতিতে মামলা নিষ্পত্তির জন্য মধ্যস্থতাকারী ও আইনজীবী নিয়োগ করা হয়।

তখন মরিস স্যামুয়েল ক্রিশ্চিয়ান সালিশির প্রশংসাপত্র পান। এরপরই প্রথমে গান্ধীনগরের সেক্টর-২১-এ তার ভুয়া আদালত শুরু করেন। আদালত পরিচালনার জন্য বিচারকের আসনের ব্যবস্থা করেন। আদালতে একজন বিচারককে যেমন আসনে দেখা যায়, তেমনই একটি চেয়ার কেনেন তিনি।

এরপর দুজন টাইপিস্টকে নিয়োগ করেন, জামিনদার নিয়োগ করেন এবং বিতর্কিত জমি ও ভবন সংক্রান্ত মামলার বিচার শুরু করে দেন।

ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব সোশ্যাল ওয়েলফেয়ারের আইন বিভাগের প্রধান অ্যাডভোকেট দীপক ভাট বিবিসি গুজরাটির সঙ্গে কথোপকথনের সময় বলেন, আদালতের মতো আদেশ দেওয়ার ক্ষমতা সালিশের নেই। আদালত দ্বারা অনুমোদিত হলে তবেই মধ্যস্থতার মাধ্যমে আসা চুক্তি বৈধ হবে।

ডেপুটি পুলিশ কমিশনার (ডিসিপি) শ্রীপাল শেশমা বলেন, সেক্টর ২১ এ ভুয়া আদালত চালানোর সময় মরিসের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল। অভিযোগের পর মরিস রাতারাতি ২১ নম্বর সেক্টরের অফিস খালি করে ২৪ নম্বর সেক্টরে একটি আদালত শুরু করে দেন।

তবে তার বিরুদ্ধে এটাই প্রথম অভিযোগ নয়। ইতোমধ্যেই এই ব্যক্তির বিরুদ্ধে পুলিশে একাধিক অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। আহমেদাবাদ ক্রাইম ব্রাঞ্চ, মণিনগর ও চাঁদখেদায় মরিস স্যামুয়েল ক্রিশ্চিয়ানের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। তবে সবচেয়ে প্রথমে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছিল গুজরাট বার কাউন্সিলে।

গুজরাট বার কাউন্সিলের শৃঙ্খলা রক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান ও আইনজীবী অনিল কেলা বিবিসি গুজরাটিকে বলেন, আমরা তার ডিগ্রির বিষয়ে জানতে ছেয়েছিলাম। তখন তিনি বলেছিলেন, বিদেশে পড়াশোনা করেছেন এবং তার কাছে এমন ডিগ্রি রয়েছে যে, দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি আইনজীবী হিসাবে প্র্যাকটিস করতে পারবেন।

তিনি বলেন, আমাদের প্রথম সন্দেহ ছিল এই কথা ভেবে যে, এত উঁচু ডিগ্রিধারী একজন ব্যক্তির সুপ্রিম কোর্ট বা হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করা উচিত। তিনি নিম্ন আদালতে কেন প্র্যাকটিস করবেন? এরপর তার ডিগ্রি সংক্রান্ত নথি খতিয়ে দেখা হয়।

তিনি আরও বলেন, বার কাউন্সিল যখন তার ডিগ্রি ইত্যাদির বিষয়ে খতিয়ে দেখে তখন জানা যায় সেগুলো সবই জাল। এর ভিত্তিতেই তিনি চার্টারের (দলিল বা সনদ) জন্য আবেদন করেছিলেন। এমনকি ওকালতি করার জন্যও তার প্রয়োজনীয় নথি ছিল না। তাই আমরা ২০০৭ সালে ক্রাইম ব্রাঞ্চে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করি।

পাশাপাশি অন্যান্য অভিযোগের উল্লেখও করেছেন কেলা। তিনি বলেন, আমরা আরও জানতে পারি, তাকে মুম্বাইয়ে নয়টি ভিন্ন পাসপোর্ট এবং জাল ভিসা রাখার জন্য গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তবে তিনি যে ভুয়া আদালত পরিচালনা করছেন, সে বিষয়ে আমাদের ধারণাও ছিল না।  

আহমেদাবাদ পুলিশ সূত্রে খবর, আহমেদাবাদ ক্রাইম ব্রাঞ্চে অভিযোগ ছাড়াও তার বিরুদ্ধে ২০১২ সালে চাঁদখেদা থানায় এবং ২০১৫ সালে মণিনগর থানায় জাল নথির অভিযোগে প্রতারণার মামলা দায়ের করা হয়।

আহমেদাবাদের পালড়ির বাসিন্দা বাবু ঠাকুরের জমি নিয়ে আহমেদাবাদ মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের সঙ্গে বিবাদ চলছিল। পেশায় দিন মজুর তিনি।

ফোনে কথোপকথনের সময় বাবু ঠাকুর বিবিসিকে বলেন, আমি একজন দিনমজুর, আমার জমি নিয়ে বিবাদ চলছে। এই মামলা নিয়ে আদালতে যাওয়ার মতো টাকা আমার কাছে ছিল না। তাই আমরা মরিস ক্রিশ্চিয়ানের কাছ থেকে সাহায্য চেয়েছিলাম।

বাবু ঠাকুর বলেন, মরিস আমাদের বলেন, জমির মূল্য ২০০ কোটি টাকা। এই জমি আমি আপনাকে ফিরিয়ে দেব। জমির টাকা এলে ফি বাবদ ৩০ লাখ টাকা এবং নথি সংক্রান্ত খরচের জন্য ১ শতাংশ টাকা আপনাকে দিতে হবে।

তিনি বলেন, উত্তরে আমি হ্যাঁ বলেছিলাম। এর জন্য আহমেদাবাদ কালেক্টরের অফিসে নিযুক্ত উকিলের কথা অনুযায়ী সই-সাবুদ করি। ২০১৯ সালে আমাকে নির্দেশ দিয়ে জানানো হয়- এই জমি এখন তোমার।

গুজরাট সরকারের আইনজীবী ভিবি শেঠ বিবিসিকে বলেন, আমি যখন মামলাটি দেখি, তখন দেখতে পাই, আদেশে লেখা রয়েছে, সরকার অবৈধভাবে বাবু ঠাকুরের জমি নিয়েছে। আট থেকে দশ লাইনের এ আদেশে জমির আয়তন, জমি কার নামে করা রয়েছে এবং তা কখন করা হয়েছে সেই বিষয়ে কোনো উল্লেখ ছিল না। শুধু তাই নয়, স্ট্যাম্প পেপারে কিন্তু ওই আদেশ ছিল না।

এরপর পুরো বিষয়টা নিয়ে তদন্ত শুরু হয়।

শেঠ বলেন, আমরা যখন বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করি, তখন আদালত থেকে জানা যায় মরিস ক্রিশ্চিয়ানের কাছে সালিশির জন্য প্রয়োজনীয় পদ ছিল না। কারণ তাকে নিয়ে হাইকোর্টের ১১ ধারা অনুযায়ী সালিশির জন্য নিয়োগ নিয়ে কোনো আদেশ ছিল না। নিজেই স্পিড পোস্টের মাধ্যমে মামলার জন্য হাজির হওয়ার নির্দেশ দিতেন মরিস।

এরপর ঠাকুরের আইনজীবী ক্রিস্টিনা ক্রিশ্চিয়ানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।

শেঠ বলেন, আমরা যখন বাবু ঠাকুরের আইনজীবী ক্রিস্টিনা ক্রিশ্চিয়ানকে জেরা করি, তখন তিনি আদালতে স্বীকার করে নেন যে তিনি ফৌজদারি মামলার আইনজীবী, দেওয়ানি মামলার আইনজীবী নন।
 
তিনি বলেন, এরপর আমরা তদন্ত করে দেখি যে মরিস ক্রিশ্চিয়ানের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলাও রয়েছে। সরকারি জমি দখলের জন্য যে এমন ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল, সেই বিষয়টিও স্পষ্ট হয়ে যায়।

বিবিসি বাংলা অবলম্বনে

বাংলাদেশ সময়: ০২০৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০২৪

আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।