কলকাতা: ভারতে সংশোধিত ওয়াকফ আইন বাতিলের দাবিতে অশান্ত পশ্চিমবঙ্গ। বেসরকারি মতে রাজ্যটির মুর্শিদাবাদ জেলায় সহিংসতায় চার জনের মৃত্যু হয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ, মুর্শিদাবাদে যে সহিংসতা এবং অশান্তির ঘটনা ঘটেছে, তা পরিকল্পিতভাবে ঘটানো হয়েছে। প্ল্যান করে এই অশান্তি করা হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে লোক ঢুকতে দিয়েছে বিএসএফ। বাইরে থেকে লোক এনেছে বিজেপি। তারাই অশান্তির আগুন জ্বেলেছে।
এখানেই শেষ নয়; মমতার স্পষ্ট অভিযোগ, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বৈঠক করে এই চক্রান্ত করেছেন।
বুধবার (১৬ এপ্রিল) কলকাতার নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে ইমাম-মোয়াজ্জেম-বুদ্ধিজীবীদের সভায় আমন্ত্রিত ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই মঞ্চে দাঁড়িয়ে মমতা বলেছেন, ‘আমি ভারত সরকারকে বলছি, আপনি বাংলাদেশের পরিস্থিতি জানেন না? জানেন না পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশের বর্ডার রাজ্য? আপনি ইউনূসের সাথে কী গোপন মিটিং করেছেন? আপনি চুক্তি করুন। দেশের জন্য ভালো হলে খুশি হব। কিন্তু আপনার প্ল্যানটা কী? আপনাদের প্ল্যানটা কী ছিল? এজেন্সির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে লোক এনে পশ্চিমবঙ্গে দাঙ্গা করানো?’
প্রসঙ্গত, মুর্শিদাবাদে দাঙ্গা পরিস্থিতির জন্য থাইল্যান্ডে হয়ে যাওয়া বিমস্টেক সম্মেলনে মোদী-ইউনূসের একান্ত বৈঠককে দায়ী করেছেন মমতা।
মমতা বলেছেন, ‘আমি গতকাল এএনআই’র একটা টুইট দেখেছি, সেখানে বলা হয়েছে মুর্শিদাবাদের এই অশান্তির জন্য বাংলাদেশের হাত রয়েছে। বর্ডার সুরক্ষা তো কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। বিএসএফ বর্ডার সামলায়। পশ্চিমবঙ্গ বর্ডার রক্ষা করে না। তাহলে এত বাংলাদেশি মুর্শিদাবাদে কোথা থেকে ঢুকলো?’
এরপরই কেন্দ্রীয় সরকারকে সরাসরি প্রশ্ন করেন মমতা। তিনি বলেন, ‘কেন বাংলাদেশিদের এখানে ঢুকিয়ে মুর্শিদাবাদে অশান্তি তৈরি করলেন?’
পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু-মুসলমান ভাগাভাগি করার জন্য এই চক্রান্ত করা হয়েছে বলে, দাবি করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। মমতার দাবি, কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিএসএফ বাংলাদেশ থেকে দুষ্কৃতকারীদের ঢুকিয়েছিল এবং বিজেপি বাইরে থেকে লোক এনে মুর্শিদাবাদে অশান্তি তৈরি করেছিল।
এখানেই থেমে না থেকে মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেছেন, ‘বিজেপি কেন বাইরের লোক এনে এখানে গন্ডগোল পাকাবে? কেন এজেন্সির মাধ্যমে দাঙ্গা করা হবে? আমি জেনেছি, বাচ্চা ছেলেদের পাঁচ-ছ’হাজার টাকা করে হাতে দিয়ে ইট ছোড়ানো হয়েছে। ’
প্রধানমন্ত্রী মোদীকে উদ্দেশ্য করে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘আপনি বাংলার ধর্মীয় মেরুকরণ ঘটাতে চান, হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ভাগাভাগি করতে চান। আপনার জুমলা (বিজেপি) সরকার খালি বলে, আমরা শুধু হিন্দুদের জন্য। এই কারণেই দেশে অশান্তি। এভাবে চললে তো দেশটা ভাগ হয়ে যাবে। জোড়ার চেষ্টা করুন। ভাঙবেন না। ’
একই সাথে বক্তব্যে পশ্চিমবঙ্গের ইমাম, মোয়াজ্জেম ও সংখ্যালঘুদের একাংশের উদ্দেশ্যেও বিরক্তি প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘ওয়াকফ আইন তো রাজ্যের সরকার সংশোধন করেনি। দিল্লি করেছে। আমরা তো প্রতিবাদ করেছি। সবচেয়ে বেশি প্রতিবাদ আমরা করেছি। সুপ্রিম কোর্টে মামলাও করেছি। আপনাদের এত তাড়া কীসের? ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার কি একসঙ্গে করতে চান?’
তিনি আরও বলেন, ‘আপনারা দিল্লিতে গিয়ে প্রতিবাদ জানান। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করুন। তৃণমূলের সাংসদরাও আপনাদের সঙ্গে যাবে। ’
পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রীর নিশানা ছিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তার নাম উল্লেখ না করে মমতা বলেন, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক কালীদাসের মতো হয়ে গেছে। যে ডালে বসে আছে, সেই ডাল কাটছে। আপনার এত তাড়া কীসের?’
অমিত শাহকে আরও কটাক্ষ করে মমতা বলেছেন, ‘আপনি তো প্রধানমন্ত্রী কখনও হতে পারবেন না। মোদীজি চলে গেলে আপনার কী হবে? আপনাকে তো হামাগুড়ি দিতে হবে। মোদীজিকে বলব, ওনাকে একটু কন্ট্রোল করতে। সমস্ত এজেন্সি ওনার হাতে দিয়ে দিয়েছেন। মুর্শিদাবাদে যা ঘটেছে, তা পুরোটাই পরিকল্পিত। ’
বিজেপির প্ররোচনায় পা না দেওয়ার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি এলাকায় শান্তি রক্ষায় ইমাম মোয়াজ্জেমদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান মমতা। তিনি বলেন, ‘আপনাদের কাছে অনুরোধ, আপনারা এলাকায় শান্তি রক্ষা করুন। বিজেপির লক্ষ্যই অশান্তি পাকানো। রামনবমীর দিন এই পরিকল্পনা ছিল। সেই পরিকল্পনা আপনারা ভেস্তে দিয়েছেন। বিজেপির কথায় পা দিয়ে অশান্তি করার চেষ্টা করলে তাকে নিয়ন্ত্রণ করুন। আমাদের ওপর বিশ্বাস রাখুন, ভরসা রাখুন, বিভাজন হতে দেব না। আমরা কখনো হিন্দু-মুসলিম ভাগাভাগি করি না। বাংলায় শান্তি থাকলে আমরা শান্তিতে থাকতে পারব। ’
সব ধর্মের মানুষকে পাশে নিয়ে তৃণমূল নেত্রীর বার্তা, ‘আমরা কেউ একা নই। আমার একটা আঙুল যদি হিন্দু হয়, আর একটা আঙুল মুসলমান, আরেকটা আঙুল শিখ, আরেকটা জৈন। ’
সবশেষে সংশোধিত ওয়াকফ আইনের প্রতিবাদে মুর্শিদাবাদ জেলায় সরকারি মতে নিহত তিনজনের পরিবারকে রাজ্য সরকারের তরফে ১০ লাখ রুপি করে আর্থিক সাহায্য ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পাশাপাশি যাদের বাড়ি ও দোকানপাট ভাঙা হয়েছে তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
বাংলাদেশ সময়: ১৭০০ ঘণ্টা, ১৬ এপ্রিল ২০২৫
ভিএস/এমজেএফ