কয়েকদিন আগেই ভারতের আসাম রাজ্য থেকে এনআরসির (জাতীয় নাগরিক পঞ্জি) নোটিশ পেয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার দিনহাটার বাসিন্দা উত্তম কুমার ব্রজবাসী। আসাম সরকারের নোটিশ বলা, হয়েছিল আগামী ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে উপযুক্ত নথি (ভারতীয় পরিচয়পত্র) দেখাতে না পারলে তাকে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী হিসেবেই চিহ্নিত করা হবে।
বঙ্গবাসীর প্রশ্ন, যদি অনুপ্রবেশ হিবেসে চিহ্নিত করতে হয় তা পারে কেন্দ্র সরকার। ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো অনুযায়ী, কখনই একটি রাজ্যের সরকার, অন্য রাজ্যবাসী এধরেন নোটিশ পাঠাতে পারে না। কোন শক্তিতে এসব হচ্ছে? এই নিয়ে একাধিকবার সরব হয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পথে মিছিল করে ঘটনার প্রতিবাদও জানিয়েছেন মুখমন্ত্রী।
সেই রেশ কাটতে না কাটতেই আবারও সামনে এলো একই ঘটনা। এবার আসাম সরকারের নোটিশ পেলেন কোচবিহারের মাথাভাঙ্গা-২ ব্লকের আরও এক বাসিন্দা নিশিকান্ত দাস (৭০)।
জানা যায়, দেড় মাস আগে তার কাছে ফরেনারস্ ট্রাইব্যুনাল থেকে নোটিশ এসেছে।
এদিকে তথ্য বলছে, নিশিকান্ত পেশায় একজন খুচরা ডিম ব্যবসায়ী। বাড়ি বাড়ি ডিম সংগ্রহ করে সেই ডিম বিক্রি করে কোনোভাবে তার সংসার চলে। কিন্তু আচমকা এনআরসি নোটিশ পেয়ে বিপাকে নিশিকান্ত। উত্তম কুমার ব্রজবাসীর মতই আতঙ্কে ঘুম উড়েছে তারও।
শনিবার (২৬ জুলাই) নিশিকান্ত বলেছেন, প্রায় ৩০ বছর আগে জীবিকার সন্ধানে আসামে গিয়েছিলাম। সেখানে এয়ারপোর্ট সংলগ্ন চৌপথি এলাকা থেকে অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশি সন্দেহে আটক করে আসাম পুলিশ। তাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। এরপরই তার এজেন্ট (যার অধীনে তিনি সেখানে কাজে গিয়েছিলেন) থানায় গিয়ে জানায়, নিশিকান্ত দাস বাংলাদেশি নন, তিনি পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারের বাসিন্দা এবং একজন ভারতীয় নাগরিক।
কিন্তু পুলিশ জানায়, ভারতীয় হওয়ার প্রমাণ দেখাতে হবে। এরপর নিজেকে ভারতীয় প্রমাণ করতে নিশিকান্ত সব নথি তদন্তকারী কর্মকর্তাদের দেখান। আসাম পুলিশ তাকে ছেড়ে দেয়। এই পরিস্থিতিতে কাজে মন বসাতে না পেরে, প্রায় ছয়মাস পর কাজ ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন নিশিকান্ত।
গত নয় বছর আগে নিশিকান্তের স্ত্রী রাধা রানি দাসের মৃত্যু হয়। তার দুই ছেলে ও তিন মেয়ে। তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। এরপরই চলতি বছরের মে মাস নাগাদ তার কাছে ফরেনারস্ ট্রাইব্যুনাল থেকে এনআরসির নোটিশ আসে।
সেই নোটিশের পর আবারও তিনি ১৯৬০ সালের জমির কাগজপত্র ও বিভিন্ন প্রমাণপত্র নিয়ে আসামে যান। কিন্তু সব নথি ও প্রমাণ পত্র দেখার পরেও সন্তুষ্ট নয় ফরেনারস্ ট্রাইব্যুনাল। কর্তৃপক্ষর দাবি, তৎকালীন সময়ের ভোটার তালিকা ও তার বাবার পরিচয়পত্র দেখাতে হবে। সেই নথি সঙ্গে না থাকায় তিনি কার্যত হতাশ হয়ে বাংলায় ফিরে আসেন।
নিশিকান্তের অভিযোগ বাবা দেবেন্দ্র চন্দ্র দাস প্রায় ৪৫ বছর আগে মারা গেছেন। ফলে এখন তার বাবার এসব নথি কীভাবে জোগাড় করবেন, তা নিয়ে চিন্তায় রয়েছেন তিনি।
শুক্রবার বিষয়টি সামনে আসার পরই এদিন তার বাড়িতে গিয়ে দেখা করেন কোচবিহারে জেলা তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি অভিজিৎ দে ভৌমিক। তিনি জানান, আমরা ওই ব্যাক্তির পাশে আছি। তৃণমূল সভাপতির প্রশ্ন, বাংলাভাষা বলাটা কি অপরাধ? বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে বাঙালিদের যেভাবে বিজেপি হয়রানি করছে, আমরা তার প্রতিবাদে আন্দোলনে আছি।
এর আগে ৮ জুলাই, ফরেনারস্ ট্রাইবুনাল' থেকে এনআরসির নোটিশ পেয়েছিলেন উত্তম কুমার ব্রজবাসী (৫০)। সেসময় তিনি বলেছিলেন, গত কয়েক দশক ধরে বংশ-পরম্পরায় কোচবিহারের দিনহাটার চৌধুরীহাটে বসবাস করছি। আজ পর্যন্ত কোচবিহারের বাইরে যায়নি। অথচ পার্শ্ববর্তী আসাম সরকারের থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশের নোটিশ পেয়েছি।
নেটিশ পেয়েই মাথায় বাজ ভেঙে পড়েছিল উত্তমের। তিনি জানান, চলতি বছরের জানুয়ারির দিকে পুলিশ মারফত তার বাড়িতে একটি এনআরসি সংক্রান্ত চিঠি আসে। এরপর আমি প্রতিবেশীদের সেই চিঠিটি দেখালে জানতে পারি, সেটা আসাম সরকার অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে আমাকে চিহ্নিত করে নোটিশটি পাঠিয়েছে। নোটিশটি আসামের গুয়াহাটি থেকে এসেছে।
তিনি আরও বলেন, এরপরে আমি এক আইনজীবীর সহযোগিতায় আমার সমস্ত নথি আসামে পাঠিয়েছিলাম। পরবর্তী চিঠিতে আমার থেকে ১৯৬৩ সালের নথি চায়। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন(পশ্চিমবঙ্গ) আমাকে সেই কাগজ দিতে পারেনি।
এ নিয়ে জোড়াল প্রতিবাদ জানাচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
১৭ জুলাই মমতা বলেছিলেন, ভিনরাজ্যে বাংলাভাষীদের ওপর সন্দেহ হলে গ্রেপ্তার করে ডিটেনশন ক্যাম্প বা হোল্ডিং এরিয়ায় রেখে দেওয়া হচ্ছে। তারা ভারতীয় হওয়ার নথি দেখালেও তাদের জেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কি অপরাধ করেছে তারা? তাদের বাংলা ভাষায় কথা বলা অপরাধ? কতজনকে বাংলাদেশে পুশইন করা হয়েছে? কতজনকে জেলে রাখা হয়েছে? এভাবে দেশ চালাবেন? হিন্দু মুসলমান দেখছেন? মলা মাছ যেমন বাছে, তেমন মুসলমান বাছতে গিয়ে আসামে এনআরসি করে আসামে ১২ লাখ হিন্দুদেরই বাদ দিয়েছেন। লজ্জা করে না আপনাদের?
ভিএস/এএটি