ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ভারত

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ইতিবৃত্ত

ভাস্কর সরদার, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫৮ ঘণ্টা, মে ২৭, ২০১৬
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ইতিবৃত্ত

কলকাতা: দ্বিতীয়বারের মতো পশ্চিমবঙ্গের মুখমন্ত্রী হিসেবে বিধানসভায় প্রবেশ করতে যাচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুক্রবার (২৭ মে) রেড রোডে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে শপথ নিয়েছেন বাংলার ‘দিদি’।

ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায় যে বিধানসভায় অভিষিক্ত ছিলেন, সেই বিধানসভার ইতিবৃত্তটা একবার জেনে নেওয়া যাক।

১৯২৮ সালের ৯ জুলাই বাংলার তৎকালীন গভর্নর ফ্রান্সিস স্ট্যানলি জ্যাকসন আইনসভা ভবনের শিলান্যাস করেন। পরে যেটি বিধানসভা ভবন নামকরণ করা হয়। এর আগে কলকাতার টাউন হলে আইনসভার কাজকর্ম করা হতো। পরবর্তী সময় টাউন হলের ঠিক বিপরীতের ২৮ বিঘা জমিতে নতুন ভবনের পরিকল্পনা করা হয়।

ব্রিটিশ স্থপতি জি গ্রেভস এ ভবনের নকশা তৈরি করেন। কলকাতার নির্মাণ সংস্থা মার্টিন বার্ন কোম্পানি এ বাড়ি নির্মাণ করেন। ১৯৩১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয় অধিবেশনের কাজ।

এর আগে যেমন কলকাতার টাউন হলে সভা বসতো। তার আগে কলকাতার গভর্নর হাউজ বা ‘রাজভবন’ এবং তারও আগে বেলভিডিয়ার হাউসে বসতো আইন সভা।

বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ভিতরে যেখানে মূল সভা বসে সেটি আসলে একটি গোলাকৃতির চেম্বার। এই গোল সভাকক্ষটির আয়তন ৪৩০০ বর্গফুট। সভায় মোট ৩০০ সদস্য বসতে পারেন। এর মধ্যে ২৯৪ জন সদস্য জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন। একজন সদস্যকে সভার তরফ থেকে মনোনীত করা হয়। সাধারণভাবে মনোনীত সদস্য হন সমাজের কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তি।

বিধানসভার ভিতরে তিনটি ভবন আছে, উত্তর অ্যানেক্স ভবন, দক্ষিণ অ্যানেক্স ভবন ও সুবর্ণ জয়ন্তী ভবন। বিধানসভার মূল চৌহদ্দির মধ্যে রয়েছে পোস্ট অফিস, ব্যাংক, রেলের টিকিট কাউন্টার একটি ডাক্তারখানা ও ক্যান্টিন।

১৯৫২ সালে প্রথম পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার নির্বাচন হয়। সেই সময়ে মোট ২৩৮টি নির্বাচন হয়েছিল। ক্রমশ এ আসন বেড়ে বর্তমানে ২৯৪টি আসনে দাঁড়িয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ইতিহাস ঘাঁটলে একটি লক্ষ্যণীয় বিষয় উঠে আসে। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান জনগোষ্ঠী থেকে বিভিন্ন সময়ে এক বা একাধিক সদস্যকে বিধানসভায় মনোনীত করা হয়েছে। যারা অ্যাংলো  ইন্ডিয়ান জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করতেন।

১৯৭১ সালে ২৮১ জন সদস্য নিয়ে গঠিত পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা মাত্র ১ মাস ২৩ দিন স্থায়ী হয়। এইটি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সবচেয়ে কম দিন স্থায়ী হওয়ার রেকর্ড। এই সময়ের মধ্যে মাত্র ১০ দিন সভা বসার সুযোগ হয়। একটি মাত্র অধিবেশনেই সভা ভেঙে যায়।

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় মন্ত্রী ও বিরোধীদলের বিধায়কদের নিয়ে বিভিন্ন কমিটি তৈরি করা হয়। এর মধ্যে পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি, স্ট্যান্ডিং কমিটি উল্লেখযোগ্য। এই কমিটিগুলিতে সভার বাইরে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়।

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিধায়কদের মূল বেতন ৫ হাজার রুপি। যাবতীয় ভাতা মিলিয়ে বিধায়করা মোট বেতন পান ১২ হাজার রুপি। চিঠিপত্র দেওয়া-নেওয়ার জন্য বছরে ৩ হাজার রুপি করে ভাতা পান প্রত্যেক বিধায়ক। বই, খাতা, কলম কেনার জন্য বছরে এককালীন ৩ হাজার রুপি, ২ হাজার লেটার প্যাড এবং সেই পরিমাণ খাম পান প্রত্যেক বিধায়ক।

এছাড়া বিধায়কের কাজ করার জন্য রেলে প্রথম বাতানুকূল শ্রেণি বা দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভ্রমণের সুযোগ পান। রাজ্যর বাইরে বছরে সর্বাধিক ২০ হাজার কিলোমিটার ভ্রমণ করার সুযোগ পান প্রত্যেক বিধায়ক। তবে রাজ্যের মধ্যে সড়কপথে, জলেপথে বা ট্রামে অবাধ যাতায়াতের সুযোগ পায় বিধায়করা।

পশ্চিমবঙ্গের বিধায়করা মাসে ৩ হাজার রুপি পর্যন্ত টেলিফোনের খরচ এবং যতটা প্রয়োজন ততটা চিকিৎসার খরচ পেয়ে থাকেন। চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিধায়কের বাবা, মা, স্ত্রী ও সন্তানরাও খরচ পান।

বিধানসভায় সভারক্ষী একটি দণ্ড ব্যবহার করেন। সভা শুরুর পর সেই দণ্ডটি সভার অধ্যক্ষের চেয়ারের পাশে একটি বালিশে হেলান দিয়ে রাখা থাকে। দণ্ডটি মাথার উপরে আছে অশোক স্তম্ভ। জানা যায় হাউস অব কমন্স থেকে এ দণ্ডটি ব্যবহারের রীতি নেওয়া হয়েছে। যদিও ভারতীয় সংবিধানে এ দণ্ডটি ব্যবহার ও এর কার্যকারিতা সম্পর্কে কোনো কথা বলা নেই। তবুও দীর্ঘদিন ব্যবহারের ঐতিহ্য মেনে এ দণ্ডটি ব্যবহার করা হয়।


ভারতীয় সাংবিধানিক রাজনীতির ইতিহাস নাড়লে দেখা যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন কালের সময় গোটা ভারত জুড়ে বিভিন্ন জায়গায় ছোটছোট গন বিপ্লবের চেহারা দেখে ব্রিটিশরা বুঝতে পেরেছিলেন কোম্পানির আইনে যথেষ্ট রদবদল না করলে ভারতের বুকে উপনিবেশ টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।

সেই সূত্রেই তারা আইনে কিছু সংস্কার নিয়ে আসে। সে কারণেই শুরু হয় আইনসভার। ব্রিটিশরা এ সভায় ১২ জন সদস্যের মধ্যে ৪ জন বাঙালি সদস্যকেও যোগ করেন। এ সময় বেলভেডিয়ার হাউসে এ সভা প্রতি শনিবার বসতো। ১৮৯২ সালে এ সভার পরিধি বাড়ে। সভায় নির্বাচনের মাধ্যমে সদস্যরা আসতে থাকেন। তবে সেই নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিলেন জমিদার বা ভূস্বামী। ঐতিহাসিকরা বলেন আদতে সাধারণ মানুষের কোনো রকম যোগ এ আইনসভায় ছিল না।

১৯০৫ সালে বঙ্গ প্রদেশকে দুই ভাগে ভাগ করা নিয়ে আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। এ আন্দোলনের চাপেই ১৯১১ সালে পঞ্চম জর্জের দিল্লির দরবারে বাংলাকে জুড়ে দেওয়া হয়। তবে ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে স্থানান্তরিত হয় দিল্লি। সেই সময়ে গভর্নর হাউস বা ‘রাজ ভবনে’ শুরু হয় আইনসভার কাজ।

এরপর আইনসভার কাজ স্থানান্তরিত হয় টাউন হলে এবং অবশেষে বিধানসভা ভবনে। সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত বিধানসভা ভবনেই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আইনসভার কাজ হয়ে চলেছে। প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ১৯৫২ সালে এ সভায় প্রবেশ করেছিলেন ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়।

এখানেই মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নিজের দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করতে চলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিগত দিনের মতোই তিনিও পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ঐতিহ্য বয়ে নিয়ে যাবেন বলেই আশা সবার।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৫ ঘণ্টা, মে ২৪, ২০১৬
ভিএস/এএ

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।