ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ভারত

পশ্চিমবঙ্গে পরাজয়ে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন বামরা

ভাস্কর সরদার, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬১০ ঘণ্টা, মে ২৯, ২০১৬
পশ্চিমবঙ্গে পরাজয়ে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন বামরা ছবি: বাংলানিউজটোয়েটিফোর.কম

কলকাতা: পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর সিপিএম পলিটব্যুরোতে সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি পশ্চিমবঙ্গ এবং কেরলের নির্বাচন নিয়ে সদস্যদের সামনে তার জবাব পেশ করবেন। কেরলের নির্বাচন নিয়ে বিশেষ সমস্যায় তাকে পড়তে হবে না, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে তাকে বেশ কিছু কঠিন প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

দক্ষিণ ভারতের সিপিএম নেতারা এই প্রশ্ন তুলবে।

যদিও রাজ্য নেতৃত্বের রিপোর্ট, এখনও পশ্চিমবঙ্গ থেকে পলিটব্যুরোতে গিয়ে পৌঁছায়নি, তাই সেই রিপোর্ট না পেলে কিছু না বলার রাস্তায় হাঁটতে পারেন সীতারাম। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে বামদের ভরাডুবি নিয়ে গোটা ভারতের রাজনৈতিক মহলে যথেষ্ট আলোচনা শুরু হয়েছে।

সিপিএম –এর পার্টি কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিজেপি এবং কংগ্রেস থেকে সম দূরত্বের নীতি বজায় রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে সেই সিদ্ধান্তকে ভেঙে  কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে সিপিএম। যদিও কংগ্রেসের সঙ্গে জোট কথাটি না বলে সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ দলের সমঝোতা বলে পার্টি কংগ্রেসের সিদ্ধান্তের দিকটি বজায় রেখেছে সিপিএম।

কিন্তু বাস্তবের মাটিতে যেটা হয়েছে, সেটাকে কংগ্রেস এবং সিপিএম –এর জোট ছাড়া আর কিছুই বলা হচ্ছে না। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠবে কেন এই ধরনের একটি জোটে গেল সিপিএম। বিশেষ করে যখন তাদের এই জোট থেকে নিশ্চিতভাবে কিছু পাওয়ার ছিল না। তবে, এখানের সিপিএম এর বঙ্গ ব্রিগেডের বিড়ম্বনার শেষ হবে না। সাধারণ কর্মীদের মতোই জাতীয় নেতারা পশ্চিমবঙ্গের নেতাদের কাছে প্রশ্ন তুলবেন, ক্ষমতা হারানোর পাঁচ বছর পরেও কেন দলকে সংগঠিত করতে পারল না সিপিএম।

এই দুটি প্রশ্নের উত্তরে বিভিন্ন বিশ্লেষণ উঠে আসছে। প্রথমত, কংগ্রেসের সঙ্গে জোটের বিষয়টি যেভাবে জনগণের ইচ্ছা বলে চালান হয়েছিল, অনেকে মনে করছেন আসলে সেটা ছিল কিছু নেতাদের ইচ্ছা।   এর ফলেই কংগ্রেস নেতাদের সভায় লাল পতাকা নিয়ে সিপিএম কর্মীরা হাজির হলেও সে অর্থে জনগণ জোটের বাক্সে বিশেষ ভোট দেন নি।

দ্বিতীয়ত, তৃণমূল কংগ্রেস বিরোধী ভোট কিছুটা বিজেপি –এর দিয়ে চলে যাওয়ার বিষয়টি অনেকে তুলে আনছেন। সেখানের প্রশ্ন থেকে তবে কি তৃণমূলের বিরোধী হিসেবে বামদের মেনে নিতে পারেননি মানুষ। যদি তাই হয় তবে কেন?

সেক্ষেত্রে দেখতে গেলে ৩৪ বছর যে দল সরকার চালিয়ে এসেছে সরকার থেকে সরে যাওয়ার পরেই সেই দলের এত দ্রুত জনপ্রিয়তা হ্রাসের কারণ কি? এই প্রসঙ্গে অনেকেই তৃণমূল কংগ্রেসের পাইয়ে দেবার রাজনীতির বা ‘ডল পলিটিক্স’-এর কথা তুলে আনছেন। কিন্তু এই পাইয়ে দেবার রাজনীতির শুরু বাম আমলেই।

৩৪ বছরের সরকারের থাকার অভ্যাস বামদের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের দুটি চরম ক্ষতি করেছে। প্রথমত, সরকারে থাকার ফলে আন্দোলন সংগ্রামের অভ্যাস থেকে বাম নেতা কর্মীরা বেশ কিছুটা দূরে চলে গেছেন। ক্ষমতায় থাকা ৩৪ বছরে কেন্দ্রের বঞ্চনা আর সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মিছিল-মিটিং ছাড়া বাম কর্মীরা সরকারের ভালো দিকগুলি প্রচারে ব্যস্ত ছিলেন।

এক সময়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী বামরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করে ধীরেধীরে নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসার বিষয়টিকে এত বেশি প্রাধান্য দিয়ে ফেললেন যে, কিভাবে ক্ষমতা ধরে রাখতে হবে, সেই চিন্তা করতে করতে আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের প্রয়োজনের কথা ভুলেই গেলেন।

কিন্তু যখন ভারতের মতো একটি দেশে সামাজিক এবং আর্থিক বৈষম্য এক বড় মাপের সমস্যা সেখানে বামদের সরকারের থাকার লড়াই ধীরে ধীরে বামপন্থী মানুষদের থেকে পশ্চিমবঙ্গের বামদের দূরে সরিয়ে দিয়েছে। যেনতেন প্রকারের ভোটে জেতার ইচ্ছা বাম দলগুলির ভারতের অন্যান্য দলগুলি থেকে আলাদা বিপ্লবী চরিত্রটিকে নষ্ট করে দিয়েছে।

বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের ৩৪ বছরের শাসনের ফলে বামরা গণতান্ত্রিক কাঠামোয় যতটা পোক্ত হয়েছেন, বামপন্থার মূল জায়গা থেকে ততটাই তারা দূরে সরে গেছেন। কিন্তু বামদের তরফে অবহেলায় ফেলে রাখা বিষয়গুলি নিয়ে কাজ থেমে থাকেনি। এর একটি উদাহরণ ‘দুর্নীতি’। দুর্নীতি নিয়ে যখন বামরা নিয়মমাফিক প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবাদের মধ্যেই সীমিত ছিলেন তখন বিরাট আন্দোলন গড়ে তুললেন আন্না হাজারে।

গোটা দেশ জুড়ে সমর্থনের ঢেউ উঠল। যে দায়িত্ব বামদের নেওয়ার কথা ছিল, সেই দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে দিল্লির ক্ষমতার একবার নয়, দু’বার বিপুল ভোটে জিতে মুখ্যমন্ত্রী হলেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল।
 
শুধু তাই নয়, সামাজিক ক্ষেত্রগুলি, আদিবাসী, বন্ধ চা বাগানের শ্রমিক, কৃষক আত্মহত্যা, নারী নির্যাতন সহ এই ধনের ইস্যুগুলিতে বামরা প্রথম সারি থেকে সরে গিয়ে পিছনের বেঞ্চে জায়গা পেয়েছিলেন।

বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে বাম নেতারা যতটা টেলিভিশনে সময় দিয়েছেন, তার থেকে তাদের মাঠে ময়দানের লড়াই-সংগ্রামে কম দেখা গেছে। যতটা তার ফেসবুক ,টুইটারে সচল ছিলেন জমিহারা কৃষক, কর্মহীন শ্রমিক কিংবা জাতের নামে অবদমনের শিকার হওয়া মানুষকে নিয়ে তারা বড় মাপের আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন।

পশ্চিমবঙ্গের বামরা যতটা ক্ষমতার ফেরার জন্য চেষ্টা করেছেন, তার থেকে অনেক কম সময় দিয়েছেন আর্থ-সামাজিক বিষয়গুলি নিয়ে লড়াই করার দিকে। মানুষ দেখেছে ক্ষমতায় ফেরার জন্য পশ্চিমবঙ্গের বামরা সরকারের সমালোচনা করেছেন, তারা জোট করেছেন, তারা ভোট কাটাকাটির অঙ্ক কষেছেন, কিন্তু মানুষ বামপন্থার সঙ্গে এই বিষয়গুলির কোনো যোগ খুঁজে পাননি। যে বামেদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যোগদান ছিল উপলক্ষ্য, সেই ক্ষমতার রাজনীতি তাদের প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই চর্চা ক্ষমতায় থাকাকালীন গতি পেয়েছে। ফলে ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার পড়ে বামেদের সংগঠন ভাঙতে শুরুর করে। এবং যারা বামপন্থার ধারে কাছ দিয়ে না ঘেঁষেও শুধুমাত্র সুবিধে পাওয়ার লোভে লাল পতাকার তলায় ছিলেন। তারাই দল বদলে অন্যদিকে গিয়ে ভিড় করেছেন। এর ফলেই পাঁচ বছর ক্ষমতা হারিয়েও সংগঠন জোরদার করতে পারেনি বামেরা।

পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের ফল প্রকাশের ঠিক দুই দিন পর কলকাতার ‘ভারত সভা’ হলে এসে দিল্লীর জহরলাল ইউনিভার্সিটির বিতর্কিত ছাত্র উমর খালিদ বক্তব্য রাখতে গিয়ে এই একই কথা বলেছেন। পশ্চিমবঙ্গের বামেদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেন, তাদের উচিৎ বামপন্থা  চর্চায় মনোনিবেশ করা।

উমর খালিদের মতো তাত্ত্বিক ভাবে না হলেও এই একই কথা বলছেন পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষও, যেনতেন প্রকারেণ ক্ষমতায় ফেরার বদলে বামেরা ফিরুক বামপন্থায়। সামাজিক আন্দোলনের এবং সাধারণ দাবির মুখ হয়ে উঠুক পশ্চিমবঙ্গের বামেরা, তবেই হয়তো আগামী দিনে আবার তাদের বরণ করে নিতে পারে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ।  

বাংলাদেশ সময়: ১৫৫১ ঘণ্টা, মে ২৯, ২০১৬
ভি.এস/পিসি

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।