ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ভারত

বঙ্গবন্ধু ও কলকাতার নেতাজীভবন

ভাস্কর সরদার, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৩৩ ঘণ্টা, মে ২১, ২০১৮
বঙ্গবন্ধু ও কলকাতার নেতাজীভবন কলকাতায় নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের এই বাড়িটি মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন পরিকল্পনার সাক্ষী। ছবি: বাংলানিউজ

[২৫ মে বিকেলে বঙ্গবন্ধুর কন্যা, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা নেতাজীভবন পরিদর্শনে আসছেনতার আগে পাঠকদের জানানো হলো এই নেতাজী ভবনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের সম্পৃক্ততা]

কলকাতা: দিনটা ছিল ৮ জানুয়ারি। মুক্তি পান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ঠিক তার ৯ দিন বাদে ১৭ জানুয়ারি ১৯৭২-এ কলকাতা থেকে এক দল চিকিৎসক মোটরগাড়ি চালিয়ে খুলনা হয়ে ঢাকায় যান।

এই চিকিৎসক দলের নেতৃত্বে ছিলেন ডক্টর শিশির কুমার বসু। তিনি ঢাকায় গিয়ে ১৭ জানুয়ারি বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সরাসরি দেখা করেন।

শিশির কুমার বসুকে দেখে জড়িয়ে ধরেন বঙ্গবন্ধু। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন 'আমার সব শেষ হইয়্যা গেছে'।

শিশির কুমার বসু বঙ্গবন্ধুকে বলেন, ‘যারা দেশের জন্য রক্ত দেয় তাদের কোনো কিছুই হারিয়ে যায় না। ’কলকাতায় নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের এই বাড়িটি মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন পরিকল্পনার সাক্ষী।  ছবি: বাংলানিউজনেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর পরিবারের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আত্মিক যোগাযোগের এরকম বিভিন্ন ঘটনার স্মৃতিচারণ করলেন প্রয়াত শিশির কুমার বসুর স্ত্রী ভারতের সাবেক সাংসদ কৃষ্ণা বোস। ডক্টর শিশির কুমার বসু হলনে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর ভ্রাতুষ্পুত্র। তিনি ছিলেন একজন খ্যাতিমান চিকিৎসক।

তবে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে বসু পরিবারের যোগাযোগ কেবল এটুকুই নয়। ১৯৭১ এর মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছিল এই নেতাজীভবনকে ঘিরে। কলকাতায় নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের এই বাড়িটি মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন পরিকল্পনার সাক্ষী।

তবে সুভাষ চন্দ্র বসুর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর যোগাযোগ হয়েছিল তারও অন্তত ৩১-৩২ বছর আগে। সেটা ছিল ১৯৪০ সাল। কলকাতার পুরনো ফোর্ট উইলিয়ামে, যেটি বর্তমানে বিনয়-বাদল-দীনেশবাগ বা বিবাদীবাগ নামে পরিচিত, একটি মিনার ছিল। যাকে বলা হতো ‘ব্ল্যাক হোল’। ব্রিটিশরা দাবি করতো, সিরাজ-উদ-দৌলা এই মিনারের অপরিসর জায়গায় কয়েকজন ব্রিটিশ সেনাকে ঢুকিয়ে হত্যা করেছিলেন। আদতে বিষয়টা সত্য ছিল না।

নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু এই ‘ব্ল্যাক হোল’ মিনারটিকে সরিয়ে ফেলার জন্য আন্দোলন শুরু করেন। শাসক ব্রিটিশ সরকার আন্দোলনের মুখে বাধ্য হয় এই মিনারকে সরিয়ে ফেলতে। সেই সময় শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন ইসলামিয়া কলেজ, বর্তমানে (বেকার হোস্টেল) মৌলানা আজাদ কলেজের ছাত্র হিসেবে কলকাতায় শিক্ষা গহণ করছিলেন। নেতাজীর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে বঙ্গবন্ধু এই ‘ব্ল্যাক হোল’ আন্দোলনে সামিল হন। এখানেই বঙ্গবন্ধুর সাথে নেতাজীর প্রথম সরাসরি পরিচয় হয়। এই কথা বঙ্গবন্ধু নিজে শিশির কুমার বসুকে জানিয়েছিলেন। এছাড়া নেতাজীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হবার কথাও একাধিকবার জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। কলকাতায় নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের এই বাড়িটি মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন পরিকল্পনার সাক্ষী।  ছবি: বাংলানিউজএখানেই শেষ নয়, দীর্ঘ প্রায় তিরিশ বছর পর সেই নেতাজীর বাড়িটিকে ঘিরেই চলেছিল মুক্তিযুদ্ধ-সংশ্লিষ্ট বেশ কিছু কার্যক্রম। এই নেতাজীর বাড়িতে বসেই পরিকল্পনা করা হয়েছিল ‘জয়বাংলা’ পত্রিকার। তবে সবচে’ উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল ‘নেতাজী ফিল্ড হাসপাতাল’। যশোর সীমান্তে একটি দোতলা বাড়িতে এই হাসপাতাল তৈরি করা হয়েছিল। ড. শিশির কুমার বসু, বিখ্যাত শল্য চিকিৎসক ড. সত্যেন বসু রায় সহ কলকাতার একদল চিকিৎসক নিয়মিত এই অস্থায়ী হাসপাতালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করতেন।

শুধু মুক্তিযোদ্ধা নয়, সেসময় শরণার্থীদের চিকিৎসা দেওয়া হতো এই ‘নেতাজী ফিল্ড হাসপাতাল’-এর পক্ষ থেকে। শুধু পুরুষ চিকিৎসকরা নয়, মহিলাদের সংগঠিত করে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার বিষয়টি দেখভাল করতেন বিপ্লবী বীণা ভৌমিক। এই বীণা ভৌমিকের নেতৃত্বে সাবেক সাংসদ কৃষ্ণা বসুসহ পারদর্শী মহিলারা কলকাতা থেকে ওষুধের বড় বড় বাক্স যশোরে ‘নেতাজী ফিল্ড হাসপাতাল’-এ নিয়ে আসতেন। কলকাতায় নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের বাড়ি পরিদর্শনে কয়েকজন।  ছবি: বাংলানিউজতারা এই আহতদের সেবা শুশ্রূষা করতেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বুলেটে আহত রোগীর সংখ্যাই বেশি থাকতো সেখানে। ড. সত্যেন বসু রায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই বুলেটে আহত রোগীদের অস্ত্রোপচার করতেন। তারা সুস্থ হয়ে আবার যুদ্ধে ফিরে যেতেন। প্রায় প্রতিদিনই কলকাতা থেকে চিকিৎসকরা গাড়ি চালিয়ে ‘নেতাজী ফিল্ড হাসপাতাল’-এ যেতেন। তবে শুধু হাসপাতাল নয়, নিয়মিতভাবে মুক্তিযোদ্ধারা নেতাজীভবনে আসতেন এবং বৈঠকে মিলিত হতেন। এইভাবেই নেতাজীর অনুপস্থিতিতেই নেতাজীভবন অচ্ছেদ্য অংশ হয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের।

ভবনটি কলকাতার ভবানীপুরে। এই ভবনকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর জীবন ও কর্ম। ১৯০৯ সালে এই বাড়ি নির্মাণ করেন সুভাষ চন্দ্র বসুর বাবা জানকীনাথ বসু। ১৯৪১ সালে ব্রিটিশ সরকার-কর্তৃক গৃহবন্দী থাকার সময় এই বাড়ি থেকেই সুভাষ চন্দ্র বসুর অন্তর্ধান ঘটে। বর্তমানে এই ভবনটি নেতাজী মিউজিয়ামে পরিণত হয়েছে। এখান থেকেই পরিচালিত হয় নেতাজী রিসার্চ ব্যুরোর কাজকর্ম। একদা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ও জওহরলাল নেহেরু এই ভবনে পরিদর্শনে এসেছিলেন। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে এসেছেন ভারতের একাধিক রাষ্ট্রপতি। এবার বাংলাদেশ থেকে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এই ভবনপ্রাঙ্গণে পা রাখতে চলেছেন বঙ্গবন্ধুতনয়া শেখ হাসিনা।

বাংলাদেশ সময়: ১৪০৯ ঘণ্টা, মে ২১, ২০১৮
ভিএস/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।