কলকাতা: মঙ্গলে যখন উড়ছিল নাসার ইনজেনুয়িটি নামের ড্রোন, ঠিক সেই সময় মঙ্গল থেকে ৩ কোটি ৮৬ লাখ মাইল দূরে পৃথিবীর বুকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে করোনা ভাইরাস। আর তাতে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত ভারত।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে ভারতে যখন মারাত্মক অবস্থা তখন বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন মারণ ভাইরাসের খেলা আরও বাকি। ধেয়ে আসতে পারে করোনার তৃতীয় ঢেউ।
ভারতের মুখ্য বিজ্ঞান পরামর্শদাতা বিজয়রাঘবন বলেন, যেভাবে ভাইরাস ছড়াচ্ছে তাতে করোনার তৃতীয় ঢেউ এড়ানো যাবে না। তবে কোন সময় ভারতের বুকে করোনার তৃতীয় ঢেউ আছড়ে পড়বে তা স্পষ্ট নয়। আমাদের তার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আগের সংক্রমণ ও ভ্যাকসিনেশনের জন্য ভাইরাস তার চরিত্র বদল করেছে। ফলে আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। একইসঙ্গে তৈরি করতে হবে নতুন ধরনের ভ্যাকসিন।
বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে ভারতে গতবার ৬৪ দিনের লকডাউনের পর সংক্রমণ যখন কমতির দিকে সেই সময় পরবর্তী ধাক্কার জন্য সজাগ থাকা উচিত ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের। কারণ অতীতে যেকোনো মহামারির ক্ষেত্রে একাধিক ঢেউ এসেছে। তাই করোনার ক্ষেত্রেও যে তা হবে তা নিয়ে বারবার সতর্কও করেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু বিরোধীদের অভিযোগ তাতে বিন্দুমাত্র কান দেয়নি মোদী সরকার। আর তাই করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ভারতের। যদিও কেন্দ্র সরকার এই দাবি কোনোমতেই মানতে নারাজ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান বলছে, গত এক সপ্তাহে বিশ্বে যতজন করোনা শনাক্ত হয়েছেন তার ৪৬ শতাংশ ভারতেই। এবং গত সাতদিনে বিশ্বে যতজন করোনায় মারা গেছেন তার ২৫ শতাংশ দেশটিতেই।
পশ্চিমবাংলারও পরিস্থিতি ভয়াবহ। একদিনে রাজ্যে মৃত্যুর সংখ্যা শতাধিক (১১৭ জন), অর্থাৎ মৃত্যুমিছিল অব্যাহত। এরই সঙ্গে করোনা ভাইরাসের শনাক্তও অব্যাহত। শুক্রবার (৭ মে) ফের রেকর্ড করে বাংলায় একদিনে শনাক্ত হয়েছেন ১৮ হাজারেরও বেশি। এ নিয়ে রাজ্যে করোনা রোগীর সংখ্যা বেড়ে হলো ৯ লাখ ৩৫ হাজার ৬৬ জন। প্রাণ গেছে ১১ হাজার ৯৬৪ জনের। অর্থাৎ সর্বত্র পরিস্থিতি ভয়াবহ।
রাজ্যে বেডের আকাল বলে হাসপাতালে রিসিপশনে করোনা রোগীদের ভর্তি করতে হচ্ছে। ব্যবহার করা হচ্ছে সল্টলেকের যুব ভারতী ক্রীড়াঙ্গন। দেখা দিয়েছে ভ্যাকসিন ও অক্সিজেনের আকাল।
ভারতের বহু প্রান্তে অক্সিজেনের অভাবে রোগীরা মারা যাচ্ছেন। সম্প্রতি যোগী রাজ্য উত্তরপ্রদেশের লখনৌ ও মিরাটের হাসপাতলে অক্সিজেনের অভাবে রোগী মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। বুধবার (৫ মে) এক জনস্বার্থে মামলায় যোগী সরকারকে ভর্ৎসনা করে এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি সিদ্ধার্থ বর্মা ও অজিত কুমারের ডিভিশন বেঞ্চ মন্তব্য করেন, যা ঘটছে তা গণহত্যার চেয়ে কম কিছু নয়। যারা অক্সিজেন কেনা ও সরবাহের সঙ্গে যুক্ত তারা নিজেদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করেননি। এটা অপরাধের শামিল।
এ বিষয়ে তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট কর্তাদের শুক্রবার (৭ মে) বেলা ১১টায় রিপোর্ট দিতে নির্দেশ দিয়েছে এলাহাবাদ হাইকোর্ট। বিচারপতিরা দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যুর ঘটনায় আদালত মর্মাহত।
আদালতের নির্দেশকে স্বাগত জানান উত্তরপ্রদেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। ফেসবুকে তিনি লেখেন, যোগী সরকারকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন হাইকোর্ট। অক্সিজেনের সংকটের কথা মানতেই চাইছিল না যোগী সরকার। উল্টে যারা এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তাদের হুমকি দেওয়া হয়েছে। সত্যি সত্যিই অক্সিজেনের অভাবে অনেকে মারা গেছেন। কীভাবে এমন ঘটলো তার জবাবদিহি করা উচিত সরকারের। এই প্রেক্ষাপটেই বুধবার সুপ্রিমকোর্ট জানিয়েছেন, গভীর সংকটের মধ্যে অক্সিজেন ম্যানেজমেন্টের বিষয়টা মুম্বাইয়ের কাছ থেকে শিখতেই পারে কেন্দ্র সরকার।
অপরদিকে, করোনার জেরে বিপর্যস্ত ভারতের রেল পরিষেবা। সংক্রমণের চেন ভাঙতে একের পর এক ট্রেন পরিষেবা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্র সরকার। ৯ মে থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হচ্ছে রাজধানী, শতাব্দী, দুরন্তের মতো সুপারফার্স্ট ২৮টি ট্রেন। বুধবারই পশ্চিমবঙ্গ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ৬ মে থেকে রাজ্যে সমস্ত লোকাল ট্রেন পরিষেবা বন্ধ করার। শুধু লোকাল ট্রেনই নয়, শুক্রবার (৭ মে) থেকে বাতিল করে দেওয়া হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে আসা বিহার, ঝাড়খণ্ডের আরও ১৬টি ট্রেন।
এভাবেই করোনা সংক্রমণের বাড়বাড়ন্ত রুখতে গতবছর ২৩ মার্চ থেকে গোটা ভারতে লোকাল থেকে স্পেশাল সব ধরনের ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিল কেন্দ্র সরকার। শুধু চালু ছিল পণ্যবাহী ট্রেন। পরে পরিযায়ী শ্রমিকদের ফেরাতে চালু হয়েছিল শ্রমিক স্পেশাল এক্সপ্রেস। এরপরই গোটা ভারতে ২৬ মার্চ লকডাউন ঘোষণা দিয়েছিল সরকার।
বর্তমান পরিস্থিতি গতবারের চেয়ে ভয়াবহ। করোনা সংক্রমণ রোজই রেকর্ড ভাঙছে। ভারতের সর্বত্রই মৃত্যু মিছিলের সংখ্যা বাড়ছে। অন্যদিকে একের পর এক ট্রেন বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। তাতেই সাধারণ মানুষের মনে নতুন করে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ফের কি তাহলের লকডাউনের পথে হাটছে ভারত সরকার?
বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৮ ঘণ্টা, মে ০৭, ২০২১
ভিএস/এএ