কলকাতা: ভারতের লোকসভা ভোট ২০২৪ সালে। আর সেই ‘মিশন ২৪’-এর লক্ষ্যে পশ্চিমবঙ্গে নতুন করে ঘুঁটি সাজানোর কাজ পুরোদমে শুরু করে দিয়েছে বিজেপি।
সম্প্রতি, দিন ছয়েক আগেই দক্ষিণ ভারতের তেলেঙ্গানা রাজ্যের রাজধানী হায়দরাবাদে বিজেপির কেন্দ্রীয় কর্মসমিতির বৈঠক শেষ হয়েছে। জানা যায়, সেই বৈঠকে ভারতের একাধিক রাজ্যের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। মোদী, শাহ, নাড্ডাসহ দলের উচ্চ নেতৃত্বের ধারণা ২৪-এর লোকসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ফের একবার সাফল্যের মুখ দেখতে পারে। সেই ‘মিশন ২৪’- এর লক্ষ্যে জুলাই মাস থেকেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)।
২০১৪ সালে প্রথম মোদী সরকার গঠনের সময় বিজেপি পেয়েছিল ২৮২ আসন। ২০১৯ সালে আরও ২১টি আসন বাড়িয়ে বিজেপি পায় ৩০৩টি আসন। সাথে আঞ্চলিক দল অর্থাৎ যারা বিজেপিকে সমর্থন করে, সেই শরিক দল মিলিয়ে মোদীর ঝুলিতে আসে মোট ৩৩৬টি আসন। সেই নিরিখে মোট ৫৪৫টি লোকসভা আসনের মধ্যে বাকি ২০৯টি আসনের মধ্যে ১৪৪টি বেছে নিয়েছে বিজেপি।
গত লোকসভা ভোটে অর্থাৎ ২০১৯ -এর নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে মোট ৪২ লোকসভা আসনের মধ্যে বিজেপি পেয়েছিল ১৮টি আসন। বাকিগুলির মধ্যে তৃণমূল পায় ২২ এবং কংগ্রেস জেতে দু’টি আসনে। সেই হিসাব কষে ২০২১ সালের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে জোড় প্রচার চালিয়েছিল মোদীবাহিনী। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। বরং মমতাই ক্ষমতা আসে। তবে তা ছিল বিধানসভা নির্বাচন। এবার আসন্ন লোকসভা। ভারতীয় সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, দুই ভোটে দু’রকম মানসিকতা কাজ করে দেশবাসীর। রাজ্য ভিত্তিকস্তরে যেই মানসিকতা তারা পোষণ করেন তা, জাতীয়স্তরে আমূল পরিবর্তন হয়ে যায়।
তবে বিজেপি কোনও সমীকরণকে গুরুত্ব দিতে নারাজ। সে কারণে তাদের বাছাই করা এই ১৪৪টি আসনে দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের ওপর। শুধু লোকসভা আসন নয়, তার অন্তর্গত বিধানসভা আসনগুলোতেও সংগঠন কী অবস্থায় রয়েছে, কী পরিবর্তন দরকার, তা ঠিক করবেন ওই মন্ত্রীরা। এ জন্য ১৪৪টি আসনেই চলতি মাসেই দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীরা সফর শুরু করেছেন। সেই সফরের সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষের চাহিদা বুঝে নির্বাচনে কোন কোন বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া দরকার, কোথায় ভুল ছিল, কি হবে পরবর্তী পদক্ষেপ? তাও দেখবেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা।
সেই নিরিখে পশ্চিমবঙ্গে মোট ৪২টি লোকসভা আসনের মধ্যে ৩০টি কেন্দ্রকে চিহ্নিত করেছেন তারা। ওই কেন্দ্রগুলিতে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে পূর্ণশক্তি দিয়ে ঝাঁপাতে চায় মোদীবাহিনী। সম্প্রতি, বিজেপির হায়দরাবাদের জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকে প্রতিটি রাজ্য ধরে ধরে দলের সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে আলোচনা করেন দলের শীর্ষ নেতারা। সেখানেই ভারতের ১৪৪ আসনের মধ্যে বাংলার ৩০ আসন বেছে নিয়েছেন তারা। তবে কোন কোন আসন বাছা হয়েছে, তা দলের রাজ্য নেতৃত্বকে জানানো হলেও আপাতত তা গোপন রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বিজেপির এই কর্মসূচির নাম দেওয়া হয়েছে ‘লোকসভা প্রবাস যোজনা’। এই কর্মসূচি রূপায়ণের জন্য কেন্দ্রীয় কমিটির পাশাপাশি প্রতিটি রাজ্যেও আলাদা কমিটি গড়া হয়েছে। এই কমিটিরও নেতৃত্বে থাকবেন একজন করে মন্ত্রী। কর্মসূচির বিস্তারিত নির্দেশে বলা হয়েছে, বেছে নেওয়া প্রতিটি লোকসভা এলাকায় একজন পর্যবেক্ষক থাকবেন, যিনি ওই এলাকার বাসিন্দা নন। তবে আহ্বায়ক হবেন এলাকারই বাসিন্দা। প্রত্যেক জায়গায় ফুল টাইমার কর্মী নিয়োগ করতে হবে। পর্যবেক্ষকদের ঘনঘন দায়িত্বে থাকা এলাকায় গিয়ে থাকতে হবে। নিয়মিত রাত্রিবাসও করতে হবে।
জানা যায়, ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় সাফল্য আনতে আলাদা করে আলোচনা করেন মোদী-শাহরা। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই বিজেপির কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের বাংলায় পাঠানোর তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছেন দলের সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডারা। বঙ্গ সফরে গিয়ে কীভাবে দলের সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধির কাজ করতে হবে, সে বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রত্যেকের সাথে আলাদা করে ক্লাস নিয়েছেন দলের সর্বভারতীয় সভাপতি নাড্ডা।
দলের সেই শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশে রোবারর (১০ জুলাই) বঙ্গ সফরে আসেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি। ধাপে ধাপে বাংলায় আসার কথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এসপি সিং বাঘেল, ধর্মেন্দ্র প্রধান-সহ আরও কয়েকজন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা-মন্ত্রীদেরও। এসব কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন কেন্দ্রে গিয়ে নিজেদের পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণের বিস্তারিত রিপোর্ট তৈরি করে তা জমা দেবেন দলের সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডাকে। সেই রিপোর্ট খতিয়ে দেখার পরেই ‘মিশন ২৪’-এর লক্ষ্যে রণকৌশল সাজাবেন মোদী-শাহ-নাড্ডারা।
প্রাথমিকভাবে ঠিক হয়েছে, মন্ত্রীরা এক একটি লোকসভা এলাকায় তিনদিন করে থাকবেন। সেই সময়ে বিভিন্ন স্তরের সাংগঠনিক বৈঠকের পাশাপাশি স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে কথাও বলতে হবে। জেলার বিশিষ্টদের সঙ্গে, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা সভায় যোগ দিতে হবে। পাশপাশি দলের বিভিন্ন শাখা সংগঠনকেও পরামর্শ দেবেন মন্ত্রীরা। দলের কর্মী, সমাজসেবী বা কোনও প্রান্তিক পরিবারের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করতে হবে মন্ত্রীদের।
তবে সেই দিক থেকে দেখলে, ২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনের আগে পশ্চিমবঙ্গে একই ধরনের কর্মসূচি নিয়েছিল বিজেপি। তাও বিজেপি আশানুরূপ ফল করতে না পারায় দলের ভিতরেই এমন কর্মসূচি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। অনেকেই বলেছিলেন, অবাঙালি নেতাদের নিয়ে এসে বাংলার রাজনীতিতে লাভ করতে পারেনি বিজেপি। তবে দলের এই নতুন কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত হওয়া এক নেতা বলেছেন, ‘সেসময় কে কী বলেছিলেন, জানি না। তবে দল এমনটা মনে করে না। বাংলায় ক্ষমতা দখল করতে না পারলেও জাতীয়স্তরে বিজেপির ফল খারাপ তা তো বলা যাবে না। আমরা সর্বভারতীয় দল। এটাই আমাদের পদ্ধতি। গোটা দেশে এইভাবে কাজ করেই সাফল্য এসেছে। ’
আগামী বছর ২০২৩-এ রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন (গ্রামস্তরের ভোট), তার পরের বছরই লোকসভা নির্বাচন। ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনের পরে ভারতে একটি আসন হাতছাড়া হয়েছে বিজেপির। সেটি হল পশ্চিমবঙ্গের আসানসোল। বাবুল সুপ্রিয় পদত্যাগ করার পর উপনির্বাচনে সেই আসনটি দখল করে তৃণমূল। পাশাপাশি ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে মমতার বিপুল জয়। ফের মনোবল চাঙ্গা হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের। ১৯-এ হেরে যাওয়া লোকসভার আসন পুনরুদ্ধারে মমতার দল ঝাঁপিয়ে পড়বে তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
ইতিমধ্যে উপনির্বাচনে বিজেপির হাত থেকে আসানসোল কেন্দ্র ছিনিয়ে নিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। বাবুল সুপ্রিয় এখন মমতার লোক। অপরদিকে, ব্যারাকপুরে বিজেপি সাংসদ সদস্য অর্জুন সিং দলত্যাগ করে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। তারমধ্যেই তৃতীয়বার নরেন্দ্র মোদীকে প্রধানমন্ত্রী বানানোর লক্ষ্যে চূড়ান্ত প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে বিজেপি। সমীক্ষা অনুযায়ী, শক্তিক্ষয় হলেও মমতার থেকে শতহস্ত এগিয়ে আছেন মোদী। তবে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে দিল্লির মসনদ কার হাতে থাকবে তা তো বলবে ভারতের ১৩৫ কোটি জনগণ।
বাংলাদেশ সময়: ১৯১১ ঘণ্টা, জুলাই ১৪, ২০২২
ভিএস