ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

তথ্যপ্রযুক্তি

অন্ধদের জন্য বিশেষ চশমা উদ্ভাবন কুয়েটে

মাহবুবুর রহমান মুন্না, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২১২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৩
অন্ধদের জন্য বিশেষ চশমা উদ্ভাবন কুয়েটে

খুলনা: দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের প্রতিকূলতাকে দূর করতে উদ্ভাবিত হল বিশেষ ধরনের চশমা। খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) দুই ছাত্র নাজমুল ও মোস্তফা তৈরি করেছেন অন্ধদের জন্য বিশেষ এই চশমা।



সোমবার সকালে বাংলানিউজের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে নাজমুল ও মোস্তফা জানান চশমা উদ্ভাবনের কথকতা।  

বিশেষ ধরনের এ চশমাটির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তারা বলেন, লাঠি দিয়ে ঠক ঠক করে পথ খুঁজে হাঁটার বদলে এখন ছোট্ট এই চশমাই বলে দেবে পথের ঠিকানা, সামনের পথ সম্পর্কে সচেতন করবে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের।

চারপাশের সব বস্তু চিহ্নিত করে পথ বলে দেবে ঠিকঠাক। পথ চলার আগে শুধু একটি বোতাম টিপে চশমাটি চালু করে দিলেই হল। সামনে, ডানে, বামে কোনো বাধা পেলেই সশব্দে সতর্ক করে দেবে ব্যবহারকারিকে। সামনের জন্য ‘ফ্রন্ট’, ডানের জন্য ‘রাইট’, বামের জন্য ‘লেফট’ উচ্চারণ করে বস্তুর সঠিক অবস্থানটি জানিয়ে দেবে সে।

ব্যবহারকারী থেকে বস্তুর দূরত্ব ভেদে উচ্চারণের তীব্রতাও হবে ভিন্ন। যা থেকে ব্যবহারকারী বস্তুর দূরত্ব সম্পর্কে একটি পূর্ণ ধারণা পাবেন।

ছোট এই যন্ত্রটি দিয়ে প্রায় তিন মিটার দূরত্ব পর্যন্ত কোনো বস্তুর অবস্থান ৯৮% নির্ভুলভাবে নির্ণয় করতে সক্ষম। দিনে-রাতে, এমনকি কুয়াশার মধ্যেও যন্ত্রটি ব্যবহার করা সম্ভব বলে জানান উদ্ভাবক দলটি।

বিশেষ এই চশমাটি তৈরি করতে কি কি ব্যবহার করা হয়েছে জানতে চাইলে তারা বলেন, যন্ত্রটিতে দূরত্ব নির্ণয়ের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে ‘আল্ট্রাসনিক সেন্সর’, ডাটা প্রসেসিং এর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে ‘পিআইসি’ সিরিজের মাইক্রোকন্ট্রোলার এবং আউটপুট ডিভাইস হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে সাধারণ এয়ারফোন।

যন্ত্রটির শক্তির উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে মোবাইল ব্যাটারি যা একবার চার্জ করলে ব্যবহার করা যাবে টানা ত্রিশ ঘণ্টা। এমনকি চার্জ শেষ হয়ে গেলেও বিশেষ ক্যাবল ইন্টারফেসের মাধ্যমে এটিকে মোবাইলের সঙ্গে সংযুক্ত করে সচল রাখা যাবে বাড়তি কয়েক ঘণ্টা।

তারা জানান, অন্ধদের জন্য বানানো হলেও সামান্য কিছু পরিবর্তন করে যন্ত্রটিকে ব্যবহার করা যাবে আরও অনেক ক্ষেত্রে।

নিরাপত্তার কাজে ব্যবহার করে কক্ষে অবাঞ্চিত ব্যক্তির প্রবেশ শনাক্ত করত পারবে এ চশমা। এছাড়া গাড়ি চুরি রোধেও এটি রাখতে পারবে সক্রিয় ভূমিকা। যেকোনো ধরনের রোবোটিক প্ল্যাটফর্মেও একে ব্যবহার করা যাবে। এর মাধ্যমে দূরত্ব পরিমাপ করা যেমন সম্ভব তেমনি অন্ধ ব্যক্তিরা এটি পরে পানিতে সাঁতারও কাটতে পারবেন বলে জানালেন উদ্ভাবকরা।

যন্ত্রটি তৈরি করতে মাত্র সাতশ’ টাকা খরচ হয়েছে বলে এর ক্রয়মূল্যও থাকবে হাতের নাগালেই। তবে বাজারজাত করতে পারলে খরচ আরও কমিয়ে আনা সম্ভব বলে জানালেন নাজমুল ও মোস্তফা।

ভবিষ্যতে এই প্রোজেক্টটিকে আরও অনেক দূরে নিয়ে যেতে চান উদ্ভাবক দলটি। খরচ কমিয়ে আরও নতুন নতুন সুবিধা সংযোজন এবং প্রযুক্তিবান্ধব করার পরিকল্পনাও আছে বলে জানান তারা।

তারা বলেন, ভবিষ্যতে যন্ত্রটিতে থাকবে জিপিএস টেকনোলজি এবং একে স্মার্টফোনের সাথে সংযুক্ত করা হবে, যাতে অন্ধ ব্যক্তিরা সহজে তাদের নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেন। সেই সঙ্গে থাকবে অন্ধ ব্যক্তিদের ওপর সার্বক্ষণিক অনলাইন পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা এবং ব্যবহারকারীদের সুবিধার্থে সব নির্দেশনা দেওয়া হবে বাংলা ভাষায়।

বাংলাদেশের মত একটি দরিদ্র ও অনুন্নত দেশে যন্ত্রটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করছেন নাজমুল ও মোস্তফা।

বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার মত আধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবনে আগ্রহী কুয়েটের এই কৃতী শিক্ষার্থীরা। প্রয়োজনীয় আর্থিক সহযোগিতা পেলে তারা তাদের উদ্ভাবন ক্ষেত্রকে আরও সম্প্রসারিত করতে পারবেন।

এ ব্যাপারে সরকার ও গবেষণাবান্ধব প্রতিষ্ঠানগুলোর আন্তরিক সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা কামনা করেছেন নাজমুল ও মোস্তফা।
Khulna-kuet-glass
তারা জানান, তাদের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে ছিলেন কুয়েটের কম্পিউটার সাইন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রফেসর ড. মুহাম্মদ শেখ সাদি।

প্রফেসর ড. সাদি যন্ত্রটি সম্পর্কে বাংলানিউজকে বলেন, দেশের বাইরেও এ ধরনের প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা হয়েছে, তবে এত হালকা ও ব্যবহারবান্ধব করা যায় নি। ব্যবহারের বিভিন্ন দিক বিবেচনা করলে প্রাথমিক অবস্থায় যন্ত্রটি বেশ ভাল সহায়তা প্রদান করছে, তবে প্রযুক্তি ব্যবহার করে একে আরও ব্যবহারবান্ধব করা সম্ভব।

উদাহরণ দিয়ে তিনি জানান, ওজন কমানো, ব্যবহার উপযোগী বাণিজ্যিক আকার প্রদান, ইন্টারনেট সংযোগ ও জি.পি.এস. সুবিধার মাধ্যমে যন্ত্রটিকে আরও ব্যাপকতা দান করা সম্ভব। এতে খরচ কমিয়ে এবং উৎপাদন হার বাড়িয়ে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর নতুন আশার দিগন্ত উন্মোচন করা সম্ভব হবে বলে আশা করেন তিনি।

নাজমুল হাসান তড়িৎ ও ইলেক্ট্রনিক কৌশল বিভাগে এবং মোস্তফা কামাল কম্পিউটার সাইন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পড়ছেন। দু’জনই তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।

তাদের সম্পর্কে সদ্য ড্রোন কপ্টার তৈরি করে আলোড়ন সৃষ্টিকারী কুয়েটের তড়িৎ ও ইলেক্ট্রনিক্স বিভাগের ০৮ ব্যাচের ছাত্র আব্দুল্লাহ আল মামুন খান দীপ বাংলানিউজকে বলেন, দুজনেই ক্যাম্পাসে নানা রকম উদ্ভাবনী প্রতিভার প্রমাণ দিয়ে চলেছেন প্রতিনিয়ত। নাজমুলের আগ্রহ ইলেক্ট্রনিক্সের দিকে আর মোস্তফার আগ্রহ মেকানিক্যাল কাজে। তারা দু’জনই মূলত রোবটিক্স নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী এবং আমার বিশ্বাস তাদের এ প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে সামনে এ ধরনের আরো অনেক কার্যকর উদ্ভাবন সম্ভব হবে।

উল্লেখ্য, দেশের প্রকৌশল বিদ্যার অন্যতম বিদ্যাপীঠ খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট)। বিশ্বের প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে পিছিয়ে নেই এখানকার কারিগররাও।

লাইন ফলোয়ার, মেজ সলভার, অবস্টাকল এভয়ডার, গারবেজ ক্লিনার, ভয়েস কন্ট্রোল রোবট তাদের অনেক আগেই তৈরি করা কুয়েটের শিক্ষার্থীদের। সম্প্রতি তারা তৈরি করেছেন চালকবিহীন এবং নিঃশব্দে চলা উড়োজাহাজ (ড্রোন কপ্টার) ও ইউনিভার্সাল স্মার্ট এনার্জি মিটার। এরই ধারাবাহিকতায় এবার তৈরি করলেন অন্ধদের জন্য এই বিশেষ চশমাটি।

বাংলাদেশ সময়: ১১১১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৩/আপডেট ১২৪২ ঘণ্টা
এমআরএম/এসএটি/বিএসকে/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।