ঢাকা: বাংলাদেশের প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ড. আব্দুল খালেক আশা করেন যে তার আবিষ্কারগুলো মানবতার কল্যাণে ব্যবহার করা হবে। তিনি আরো আশা করেন, এই আবিষ্কারগুলো দেশের তথা বিশ্বের পরিবেশগত বিপর্যয় রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
ক্যাসিকাল ও জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ড. খালেক-এর রয়েছে পনরটি পেটেন্ট করা আবিষ্কার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণরসায়ন-এ পড়ালেখা শেষ করে তিনি লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ এ পিএইচডি করেন ‘ইমিউনোএনজাইমোলজি’ (Immunoenzymology)-র ওপর। এরপর তিনি শিক্ষকতা করেন যুক্তরাজ্যের রয়েল হলওয়ে কলেজে।
এই বিজ্ঞানীর প্রথম আবিষ্কার ‘ফাইটোহরমোন ইনডিউসার’ (Phytohormone Inducer)। ’স্বর্ণা’ নামের বহুল পরিচিত এই ‘জৈবসার’-টি পেটেন্ট করা হয় ১৯৯৩ সালে।
ইংল্যান্ডে থাকা কালে তিনি উদ্ভিদের ওপর গবেষণার কাজ শুরু করেন। ‘গাছ-পালার ওপর গবেষণা হয়েছে অনেক, আরো অনেক হচ্ছে। আমি কাজ করেছি মূলত মাটির প্রাকৃতিক উর্বরতা নিয়ে,’ ড. খালেক রাংলানিউজটোয়েন্টিফোরডটকম-এর সঙ্গে আলাপচারিতায় বলেন, ‘১৯৮০ দশকে মাটির কয়েকটি প্রাকৃতিক উপাদান নিয়ে আমি গবেষণার কাজ শুরু করি। অনেক শ্রমসাধ্য গবেষণার পর আমি একটি ‘ইনডিউসার’ আবিষ্কার করি, যা ফসল ফলানোর জন্য মাটির প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক গুণাবলী রক্ষা করতে সহযোহিতা করে। ’
‘আমি সবসময়ই মাটির প্রাকৃতিক উর্বরতা নিয়ে ভাবি। অতিমাত্রার চাষাবাদ এবং অপ্রাকৃতিক বা রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে মাটির স্বাভাবিক প্রাকৃতিক উর্বরতা আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে। এই অনুর্বরতা আমাদের সবার জন্য ক্ষতিকর,’ ড. খালেক তার প্রথম আবিস্কার সম্পর্কে বলতে গিয়ে আরো বলেন, ‘আমার এই আবিষ্কার ‘স্বর্ণা’ মাটির প্রাকৃতিক উপাদানগুলোকে সচল রাখতে সহযোগিতা করে। ’
‘এটি আমাদের চারপাশের জীববৈচিত্র রক্ষা করতেও সহযোহিতা করে। ’
জমিতে ‘স্বর্ণা’-র ব্যবহারের পরিমাণ সম্পর্কে এর আবিষ্কারক বলেন, ‘দেশে প্রচলিত রাসায়নিক বা অন্যান্য সারের তুলনায় খুব অল্প পরিমানের ‘ন্বর্ণা’ ব্যবহার করলেই চলে। ‘স্বর্ণা’ মাটির স্বাভাবিক গুণাবলীগুলো ফিরিয়ে আনতে সহযোগিতা করে। ফলে মাটির স্বাভাবিক গুণাবালী ফিরে এলে বাড়তি সারের প্রয়োজন পড়ে না। ’
রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ক্ষতিকারক দিকগুলো ব্যাখ্যা করে, ড. খালেক বলেন, ‘একথা সবাই জানেন যে, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক শুধু বিষাক্তই নয় এগুলো প্রাণীদেহের জন্য খুবই ক্ষতিকারক। এগুলোর ব্যবহারের ফলে মাটির প্রাকৃতিক উপাদনগুলো নষ্ট হয়ে যায়। মাটি পানি ধারণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ’
’এমন অবস্থায় ‘স্বর্ণা’ মাটির স্বাভাবিক গুণাবলী ফিরিয়ে আনতে সহযোগিতা করে। ’
বিজ্ঞানী খালেক তার সব আবিষ্কারকে তার সন্তান হিসেবেই গণ্য করে বলেন, ‘এগুলো আমার অনেক কষ্টসাধ্য গবেষণার ফসল। এগুলো সবই বিজ্ঞানের জগতে নতুন আবিষ্কার। ’
ড. খালেকের আরেকটি আবষ্কার হলো, ‘ফাইটোপ্লাঙ্কটন ফার্টিলাইজার’। ‘স্বর্ণা’ যেমন ব্যবহার করা হয় মাটিতে, এটি তেমন ব্যবহার করা হয় পানিতে। এই সার পানির প্রাকৃতিকগুণাবলীর ভারসাম্য রক্ষা করতে সহযোগিতা করে। পানির উপরিভাগে ‘ফাইটোপ্লাঙ্কটন’ বা ‘অনুউদ্ভিদ’ জন্ম নিতে সাহায্য করে। মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী এইসব অনুউদ্ভিদ খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে।
এই ‘ফাইটোপ্লাঙ্কটন ফার্টিলাইজার’ পানিতে অক্সিজেন সরবরাহ বৃদ্ধি ও কার্বনডাই অক্সাইড শোষণে সাহায্য করে। এছাড়াও, বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করতে সহযোগিতা করে।
জীববিজ্ঞানের বিভিন্নক্ষেত্রে এই বিজ্ঞানীর অন্যান্য আবিষ্কার হলো, ‘হাড্রোপনিক ফার্টিলাইজার’, ‘ফ্লাওয়ার ফার্টিলাইজার’, ’কিউরেটিভ অব ফিস অ্যান্ড প্রন ইনফেক্টিভ ডিজিজ’, ‘পটেটো প্রিজারভেটিভ’, ‘স্পাউটিং অব পটেটো টিউবার’ এবং ‘অর্গানিক কার্বন সাপ্লিমেন্ট ফর ফিল্ড ক্রপ প্লান্টস’।
‘যেসব দেশ মাটির উর্বরতা হ্রাস ও পানিদূষণ সমস্যায় ভুগছে, সেসব দেশ এই আবিষ্কারগুলো ব্যবহার করে উপকার পেতে পারে। এগুলোর ব্যবহার পরিবেশের কোন ক্ষতি না করেই ফসলের উৎপাদন বাড়াতে পারে। ’
জীববিজ্ঞানের পাশাপাশি ক্ল্যাসিকাল বিজ্ঞানেও ড. খালেকের সাফল্য রয়েছে। ‘আন্ডারওয়াটার এস্কাভেশন অব রিভার বেড’, ‘ল্যান্ড রিক্লেমেশন ইন সী ফ্রন্ট’ ‘ইডিবল সল্ট প্রডাকশন’ এবং ‘কাইনেম্যাটিক ইঞ্জিন’।
১৯৯৮ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত এই বিজ্ঞানী কাজ করেন ‘কাইনেম্যাটিক ইঞ্জিন’-এর ওপর। তিনি এই নতুন ধরণের ইঞ্জিনের বিভিন্ন ক্যাটাগরির ওপর পেয়েছেন চারটি পেটেন্ট।
‘কাইনেম্যাটিক ইঞ্জিন অতাপীয় একটি কৌশল যন্ত্র যা কোনরকম তাপশক্তি ব্যবহার না করে যান্ত্রিক গতিশক্তি দিয়ে যান্ত্রিক শক্তি প্রবাহ তৈরি করে গতিরোধ শক্তি (resistance) বা বাধা অতিক্রান্ত করে। ইঞ্জিন উদ্যমী বা প্রয়োগকৃত বলকে (force) বহুগুণ বৃদ্ধি করে যান্ত্রিক ক্ষমতা প্রবাহ তৈরির মাধ্যমে যান্ত্রিক সুবিধা উৎপন্ন করে। ’
এই আবিষ্কারের ব্যবহারিক সুবিধা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এই ইঞ্জিনটি কোনপ্রকার বাড়তি জ্বালানি সরবরাহ ছাড়াই চাহিদা অনুযায়ি বিদ্যুত সরবরাহ করতে পারে। এই ইঞ্জিনটি কোনরকম পরিবেশ দূষণ করবেনা। ’
এই বিজ্ঞানীর মতে, যেসব দেশ তীব্র জ্বালানী সঙ্কট বা বিদ্যুত-ঘাটতিতে ভুগছে তারা এই আবিষ্কারটি ব্যবহার করে সুফল পেতে পারে।
ড. খালেকের জন্ম টাঙ্হাইলে ১৯৪৪ সালে। তিনি চান তার আবিষ্কারগুলোর তথ্য দেশের জনগণের মাঝে পৌঁছাক, যাতে তারা এগুলো ব্যবহার করে সুবিধা পেতে পারেন।
‘আমি আজ গণমাধ্যর সঙ্গে কথা বলছি এজন্য যে, এর মাধ্যমে দেশের জনগণ জানতে পারবেন বিজ্ঞনের ক্ষেত্রে আমাদের এই দেশের বিজ্ঞানীদের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সাফল্য রয়েছে। আমি আরো বিশ্বাস করি, একটি জাতি গঠনে মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ’
সবশেষ প্রশ্নের জবাবে ড. আব্দুল খালেক বলেন, ‘আমার সমস্ত গবেষণাকাজ চলাকালে আমি প্রাধাণ্য দিয়েছি পরিবেশের ওপর। পরিবেশের কোন উপাদানই যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকেই সবসময়ই লক্ষ্য রেখেছি। যাতে, আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম ক্ষতিগ্রস্থ না হয়।
বাংলাদেশ সময় ১৪৫৩ ঘন্টা, নভেম্বর ০৬, ২০১৩
এমএমকে/আরকে