ঢাকা: ‘সবার জন্য ইন্টারনেট’ এই স্লোগান এখন বাংলাদেশের সামনে। রয়েছে সবাই মিলে নতুন কিছু করার ডাক।
মঙ্গলবার সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাধীনতা পদক দেওয়ার সময় তার বক্তৃতায়ও এ কথাই বলেছেন। তিনি বলেন, দেশের সাধারণ মানুষের জীবনকে অনেক বেশি সহজ করে তুলতে ভুমিকা রাখছে মোবাইল ফোন। মানুষের জীবন ও জীবীকা অর্জনে রাখছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। দেশে ১১ কোটি মোবাইল ফোন সিম চালু রয়েছে। প্রায় চার কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে ইন্টারনেট সেবা। উন্নয়নের এই সেবা সরকার পৌঁছে দিয়েছে মানুষের দোরগোড়ায়।
সম্প্রতি এক কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন তথ্যযোগাযোগ প্রযুক্তি জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার মাধ্যমে জিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের অগ্রযাত্রায় মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর অগ্রণী ভুমিকার কথা বলেছেন। তিনি আশ্বাস দিয়েছেন, চলমান এ অগ্রযাত্রা আরো বেগবান করতে সম্ভাব্য সব ধরনের সহযোগিতা দেবে সরকার।
সরকারের এই সদিচ্ছা এবং মোবাইল ফোন অপারেটরদের অব্যাহত প্রচেষ্টা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে সেই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্ট সকলের।
পরিসংখ্যান বলছে, ১৬ কোটি জনসংখ্যার এই দেশে মোবাইল ফোনের গ্রাহকসংখ্যা সাড়ে ১১ কোটি ছাড়িয়েছে। সেই হিসাবে দেশের ৭২ শতাংশের বেশি মানুষের হাতে আজ মোবাইল ফোন। বিটিআরসি’র তথ্য মতে বছরে বছরে এই ব্যবহারকারীর প্রবৃদ্ধির হার ১১ শতাংশ।
একটি হিসাবে, ইন্টারনেট ব্যবহার করছে ৩ কোটি ৫৫ লাখ ২২ হাজার মানুষ। আর মোবাইল ফোন অপারেটরদের অন্যতম গ্রামীণ ফোন তার সবশেষ ক্যাম্পেইনে ‘সবার জন্য ইন্টারনেট’ এই স্লোগান সামনে রেখে গোটা দেশকেই থার্ড জেনারেশন ইন্টারনেট সেবার আওতায় নিয়ে আসার কাজ প্রায় সম্পন্ন করেছে। এই দৌড়ে পিছিয়ে নেই অন্য মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোও। রবি বলছে তাদের সার্ভিস এখন চতুর্থ প্রজন্মের ইন্টারনেট সেবার কাছাকাছি। ক্যাম্পেইন করছে থি পয়েন্ট ফাইভ-জি ‘সেইরাম ইন্টারনেট’ স্লোগান নিয়ে। বাংলালিংকেরও রয়েছে সমান তালে পথ চলা। সবাই মিলে নতুন কিছু করার প্রত্যয়ে এই টেলকো এখন দেশের সাধারণ মানুষের অনেক কাছাকাছি। আর এয়ারটেল টুজি’র দামেই দিচ্ছে থ্রিজি। প্রিপেইড গ্রাহকদের মোবাইল ফোন সিমগুলোই রাতারাতি বদলে গেছে ইন্টারনেটের সিমে। কেবল দরকার ইন্টারনেট চালানোর মতো স্মার্টফোন। যা এখন মানুষের হাতে হাতে। একই ব্যবস্থা অন্য অপারেটরেও।
গোটা দেশকে ইন্টারনেট সেবার আওতায় আনার এই অব্যাহত প্রচেষ্টা ডিজিটাল দেশ গড়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। চালু হয়েছে ই-ব্যাংকিং, ই-এডুকেশন, ই-হেলথ, ই-গভর্নেন্সসহ ইন্টারনেট-ভিত্তিক নানা ধরনের সেবা।
তরুণ প্রজন্মের কাছে এই সেবা পৌঁছে দিয়ে তাদের আধুনিক মনষ্ক করে তুলতে ভূমিকা রাখতে পারছে বাংলাদেশ। সেবার পাশাপাশি সরকার অর্থ আয়ও করতে পারছে। এই খাতে রাজস্ব আদায়ে উল্লেখযোগ্য সাফল অর্জন করেছে বিটিআরসি। একটি হিসাবে দেখানো হয়েছে, ২০০১-০২ অর্থ বছর থেকে ২০১২-১৩ অর্থবছর পর্যন্ত মোট ২৪ হাজার ৫৮৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় করেছে বিটিআরসি। যার মধ্যে কেবল ২০১১-১২ অর্থবছরেই রাজস্ব আয় হয়েছে ৬ হাজার ৯৫৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
আর কেবল থ্রিজি সেবা চালু করতে মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোকে সুযোগ দিয়ে সরকার আয় করেছে ৪ হাজার ৮১ কোটি টাকার রাজস্ব। ২০১৩ সালের ৮ সেপ্টেম্বর দেশের প্রধান চারটি মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংক ও এয়ারটেলকে থ্রিজি সেবা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য লাইসেন্স দেয় সরকার।
প্রশ্ন রয়েছে, বাংলাদেশের জনগণ তৃতীয় প্রজন্মের (থ্রিজি) প্রযুক্তির জন্য কতটুকু তৈরি? সে প্রশ্নেরও উত্তর জানা গেছে গবেষণা থেকে। বলা হচ্ছে, ইন্টারনেটের স্পিড বেড়ে যাওয়ায় মানুষের মধ্যে এ প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রবণতা কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। সুইডেনভিত্তিক টেলিযোগাযোগ-প্রতিষ্ঠান এরিকসনের এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে- মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা শহুরে এলাকায় গত পাঁচ বছরে প্রায় ২০ শতাংশ বেড়েছে। স্মার্টফোনের মাধ্যমে শহুরে ব্যবহারকারীরা মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। আর শহরের চেয়ে গ্রামে মোবাইল ফোনের সংখ্যা বেশি বেড়েছে।
টেলিযোগাযোগের বিভিন্ন সেবা সহজলভ্য, গণমুখী করতে এবং এর প্রচার ও প্রসার নিশ্চিত করতে বিটিআরসি ২০১৩ সালের জুন পর্যন্ত ১ হাজার ৮৩৮টি লাইসেন্স দেয়। এর মধ্যে কেবল ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৮৪০টি ভিএসপি লাইসেন্সসহ মোট ৯২৪টি লাইসেন্স ইস্যু হয়। যার মধ্যে ২৯টি ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে (আইজিডব্লিউ) লাইসেন্স, ২৬টি ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিকেশন এক্সচেঞ্জ (আইসিএক্স) লাইসেন্স এবং ৩৭টি ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) লাইসেন্স রয়েছে।
ডিজিটাল ডিভাইডকে কার্যকরভাবে জয় করতে ভূমিকা রাখছে এসব মোবাইল ফোন অপারেটরগুলো। ডিজিটাল শিল্পায়নের এই যুগে তথ্যই স্থান করে নিয়েছে সবার আগে। অনলাইনেই মিলছে সকল মূল্যবান তথ্য। বলা হতো নতুন প্রযুক্তি শহুরে মানুষকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে, পিছিয়ে যাবে গ্রামের সাধারণ মানুষগুলো। ফলে ফারাক বাড়বে বহুগুনে। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে তা হতে দেয়নি মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো। গ্রামের মানুষকে বিশেষ টার্গেট করে সবগুলো প্রতিষ্ঠানই গ্রহণ করে বিশেষ কর্মসূচি। এতে ডিজিটাল ডিভাইড কমেছে তা জানা গেছে সুইডেনভিত্তিক টেলিযোগাযোগ-প্রতিষ্ঠান এরিকসনের গবেষণা প্রতিবেদনেই।
২০০৬ সাল থেকে এ বিষয়ে নিবিড়ভাবে কাজ করছে গ্রামীণ ফোন। এর অন্যতম উদ্যোগ কমিউনিটি তথ্য কেন্দ্র (সিআইসি) প্রতিষ্ঠা। সারা দেশে ৫০০টির বেশি সিআইসি স্থাপন করে অজপাড়াগাঁয়ে মানুষের কাছে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দেওয়ার এই কাজটি এখনো দায়িত্বের সঙ্গে করে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
এরিকসনের গবেষণায় এও দেখা গেছে বাংলাদেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের মধ্যে একাধিক মোবাইল ফোন অপারেটরের সংযোগ ব্যবহারের প্রবণতা রয়েছে। কেউ কেউ চারটি বা পাঁচটি সিমও রাখছেন। কোনটির নেটওয়ার্ক স্ট্রং, কোনটি কম খরচ, পিক-আওয়ার, অফ-পিক আওয়ারের হিসেব কসে তারা সিমগুলো ব্যবহার করেন। এবং এর মাধ্যমেই তারা নিজেদের অর্থ বাঁচিয়ে যোগাযোগ অক্ষুণ্ন রাখেন। মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোও এ জন্য দিয়ে যাচ্ছে হরেক রকম আকর্ষণীয় অফার। এরিকসনের গবেষণা দেখাচ্ছে, এই একাধিক সিম ব্যবহারের প্রবণতা শহরের চেয়ে গ্রাম এলাকায় বেশি।
গ্রামের মানুষের মধ্যে এই সচেতনতার মাত্রাকে দেশ এগিয়ে যাওয়ার মাপকাঠি বলেই মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। গত বছরের অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন থ্রি-জি ইন্টারনেট সেবার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন তখন বলেছিলেন সরকার সব নাগরিকের জন্য ‘প্রযুক্তি বিভেদমুক্ত ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে। জনগণের ক্ষমতায়নের জন্য অবাধ তথ্য প্রবাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্য অর্জনে অগ্রসরতাই নির্দেশ করে এই থ্রি-জি। প্রধানমন্ত্রী আরো বলেছিলেন, এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ‘এগিয়ে থাকা’ দেশগুলোর স্তরে উন্নীত হলো।
মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোই এই এগিয়ে থাকার পথ নিশ্চিত করছে।
বাংলাদেশ সময়: ১০৪৩ ঘণ্টা, মার্চ ২৭, ২০১৪