রাজশাহী ঘুরে এসে: শিক্ষা নগরী হিসেবে পরিচিতি থাকলেও শিল্পায়নে বরাবরই পিছিয়ে রাজশাহী। তবে ডিজিটাল বাংলাদেশের এই সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হাইটেক পার্ককে ঘিরে নিজেদের নতুন দিনের সম্ভাবনা দেখছে রাজশাহীবাসী।
সম্প্রতি রাজশাহী ঘুরে দেখা যায়, শহরের এক প্রান্তে পদ্মার পাড়ে গড়ে তোলা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হাইটেক পার্ক। প্রায় ৩১ দশমিক ৬৩ একর জায়গা জুড়ে ২৮৮ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত করা হচ্ছে পার্কটি। পার্কটির প্রধান দুই অংশের মধ্যে ‘শেখ কামাল আইটি ইনকিউবেশন অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার’ এর কাজ ইতোমধ্যে শেষ। আর ‘সজীব ওয়াজেদ জয় সিলিকন টাওয়ার’ এর কাজও শেষ হবে আসছে নতুন বছরেই। সবমিলিয়ে প্রকল্পের প্রায় ৭০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে বলে জানায় হাইটেক পার্ক সংশ্লিষ্টরা।
শেখ কামাল আইটি ইনকিউবেশন অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার অফিস পরিচালনার জন্য ইতোমধ্যে স্থান বরাদ্দ পেয়েছে ১০টি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান। এদের মধ্যে ছয়টি প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে। কাজ করছে প্রায় দুই শতাধিক কর্মী। চোখের সামনেই প্রযুক্তি শিল্পায়নের দিকে এগিয়ে যাওয়ার এমন দৃশ্য রাজশাহীবাসীর মনে নতুন দিনের আশার সঞ্চার করেছে। বিশেষ করে তরুণ পেশাজীবীরা স্বপ্ন দেখছেন রাজশাহীতে থেকেই সম্ভাবনাময় এক ক্যারিয়ার গড়ার।
পার্কটিতে বরাদ্দ পাওয়া ফ্লিট বাংলাদেশ নামক এক আইটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন আফরোজা আরবি তুষি। গ্রাহক সেবা নির্বাহী তুষি বাংলানিউজকে বলেন, যখন ছাত্রী ছিলাম তখন ভয় পেতাম যে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষে ভালো একটা ক্যারিয়ার গড়তে হলে হয় রাজধানীতে যেতে হবে আর নয়তো ক্যারিয়ারই হবে না। এখানে (রাজশাহী) তেমন কোন সুযোগ ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাইবোনদের দেখেছি ক্যারিয়ারের জন্য ঢাকা যেতে। কিন্তু আমার খুব ইচ্ছা ছিল পরিবার পরিজন নিয়ে রাজশাহীতে থেকেই একটা ক্যারিয়ার গড়ার। আমাকে সেই সুযোগটা দিয়েছে ফ্লিট বাংলাদেশ আর ফ্লিট বাংলাদেশকে সেই সুযোগটা দিয়েছে এই হাইটেক পার্ক। এখানকার পরিবেশও বেশ সুবিধাজনক বিশেষ করে নারী কর্মীদের জন্য।
মোবাইল গেমস এবং অন্যান্য সফটওয়্যার সেবা দেওয়া আরেক প্রতিষ্ঠান টেক রাজশাহী’র প্রধান নির্বাহী মাহফুজুর রহমান বলেন, আমার প্রতিষ্ঠানে মোট ১৪২ জন কর্মী। এখানে হাইটেক পার্কটি হলে স্থান পেলে ২৮ জন কর্মী এখন এখানে কাজ করছেন। নামের সঙ্গে রাজশাহী শব্দ থাকা প্রতিষ্ঠানটির অফিস শেষ পর্যন্ত রাজশাহীতেই হলো। হাইটেক পার্কটির অবস্থান এবং অন্যান্য আধুনিক সুবিধার পাশাপাশি এখানে একটি অফিস থাকা মানে প্রতিষ্ঠানের ‘ব্র্যান্ড ভ্যালু’ অনেকখানি বেড়ে যাওয়া। তরুণ পেশাজীবী এবং বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ীরা প্রতিষ্ঠান নিয়ে আস্থা অনুভব করবে।
হাইটেক পার্ক হলে রাজশাহী মহানগরীর পাশাপাশি পুরো জেলার তরুণ-তরুণীরা রাজশাহীতেই চাকরি করার বা উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ পাবেন বলে মনে করেন রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের (রাসিক) মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন। তিনি বলেন, রাজশাহীতে কখনোই সেভাবে শিল্পায়ন হয়নি। এখানে চারটি মিল-কারখানা আছে তবে তাও এখন বন্ধ। এখানে বিসিক শিল্পনগরী, ইকোনমিক জোন এবং চামড়া শিল্প কারখানা হওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু সেগুলো পুরোপুরি হতে আরও ১০ থেকে ২০ বছর লাগবে। এই সময়ে এখানকার তরুণ-তরুণীদের আমরা কী দেব আমরা নতুন গ্র্যাজুয়েটদের কোন ‘জব অফার’ দিতে পারছি না। যারা ঢাকা যেতে পারছেন যাচ্ছেন; যারা পারছেন না তাদের অনেকেই হতাশাগ্রস্ত হচ্ছেন। কেউ কেউ বিপথগামী হচ্ছেন। তবে এখানে একটি হাইটেক পার্ক হলে তরুণদের জন্য চাকরির সুযোগ থাকবে, কেউ উদ্যোক্তা হতে চাইলে তার জন্য নানান সুযোগ সুবিধা থাকবে। এখানে ১৪ হাজার তরুণ-তরুণীর কর্মসংস্থান হতে পারে।
হাইটেক পার্কের ফলে রাজধানীর ওপর চাপ কমবে বলেও মনে করেন রাজশাহীর নগরপিতা। রসিক মেয়র লিটন বলেন, আমরা বিকেন্দ্রিকরণের কথা বলি কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে তরুণদের সুযোগ দিতে পারি না। এখানে যদি তাদের ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ দেওয়া যায় তাহলে তো আর তারা ঢাকা যাবে না। এর ফলে এই অঞ্চলের মানুষেরা অর্থনৈতিকভাবে আরও সমৃদ্ধ হবে। অত্র অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক চিত্র পালটে দিতে পারে এই হাইটেক পার্ক।
অন্যদিকে ইন্ডাস্ট্রি এবং অ্যাকাডেমিয়ার মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান হাইটেক পার্ক কাজ করবে বলে মনে করেন রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক তাসনিম বিনতে শওকত। ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এই শিক্ষিকা বলেন, এদেশের মেধাবীরা বাইরে যাচ্ছে যাকে আমরা বলছি ‘ব্রেইন ড্রেন’ আবার আমরা বাইরে থেকে বিশেষজ্ঞ নিয়ে আসছি এখানকার কোম্পানি পরিচালনার জন্য। এই দ্বিমুখী সমস্যার সমাধান করবে হাইটেক পার্কগুলো। রাজশাহী অঞ্চলের জন্য এই কাজটি করবে এখানকার পার্কটি। ইন্ডাস্ট্রি এবং অ্যাকাডেমিয়ার মধ্যে যে দূরত্ব থাকার কথা আমরা বলি সেই দূরত্ব মিটিয়ে দিতে সেতুবন্ধন হবে এই হাইটেক পার্ক।
বাংলাদেশ সময়: ২৩৫৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০২০
এস এইচ এস/এসআইএস