ঢাকা: বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনের ২৮ মে তারিখে প্রকাশিতব্য সংখ্যায় ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অভিযানের অন্যতম কুশীলব দেশটির তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েলের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। টাইম ম্যাগাজিনের এ সংখ্যাটি অনলাইন পাঠকদের জন্য ইতিমধ্যেই উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।
‘কলিন পাওয়েলকে ১০ টি প্রশ্ন’ শিরোনামে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারটি বাংলানিউজ পাঠকদের জন্য ভাষান্তর করেছেন নিউজরুম এডিটর রাইসুল ইসলাম
প্রশ্ন:‘ইট ওয়ার্কড ফর মি’ বইতে আপনি লিখেছেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে আপনার চিন্তা ভাবনার দুইমাস ছিলো জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়, কিন্তু কেন?
উত্তর: আমার কখনোই রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ ছিলো না। আমি আপাদমস্তক একজন পেশাদার সৈনিক। কিন্তু সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়ার পর যখন আমার প্রথম বই প্রকাশ হলো, সে সময় আমার এ ব্যাপারে প্রচণ্ড আগ্রহ সৃষ্টি হয়। তবে এরপরই আমি আমার ভুল বুঝতে পারলাম। আমি নিজের ভেতরে অপরাধবোধে আক্রান্ত হলাম। একজন সৈনিক সবসময় তাই করতে চায় যা তার করা উচিত। কিন্তু সে সময়ে আমি এমন একটি সকালও পার করিনি যখন আমি বলতে পেরেছি, ‘এটাই আমার জন্য ঠিক। আমি এটাই করতে চেয়েছিলাম। ’
প্রশ্ন: এরপর আপনি ওবামাকে সমর্থন করেছিলেন। আপনি কি আবারও তাকে সমর্থন করবেন?
উত্তর: আমি জানি না। তবে দেখাই যাক না সামনে কী হয়।
প্রশ্ন: আপনি কি মনে করেন, রাজনৈতিক নেতারা কংগ্রেসে প্রয়োজনের থেকে বেশি সময় অবস্থান করেন?
উত্তর: যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন অভিজ্ঞতাসম্পন্ন লোক। আমাদের এমন লোক দরকার, যারা এদেশের সিস্টেম কিভাবে কাজ করে তা জানে। কিন্তু তার মানে এই নয়, তারা সেখানে সারাজীবন তাদের পদ আঁকড়ে বসে থাকবেন। যখন আমি তিন তারকা জেনারেল পদমর্যাদায় নিয়োগপ্রাপ্ত হই তখন আমাকে অভিনন্দন জানানো হয়েছিল। একই সঙ্গে আমাকে এও বলা হয়েছিলো, এখন থেকে দু’বছর পর আমি যদি পদোন্নতি না পাই অথবা আমাকে অন্য কোনো দায়িত্ব দেওয়া না হয়, তবে আমি যেন স্বেচ্ছায়ই পদত্যাগ করি। এবং আমার মতে সেটা মন্দ ছিল না।
প্রশ্ন: আপনি কি ব্যক্তিগতভাবে কোনো কংগ্রেস সদস্যের প্রতি অবসর গ্রহণের আহ্বান জানাতে চান?
উত্তর:(হাসতে হাসতে) আমার কাছে চিঠি লেখার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজ-কলম এই মুহূর্তে নেই।
প্রশ্ন: সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন সেনাবাহিনী বিভিন্ন কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ছে। কলম্বিয়ার পতিতা সংক্রান্ত অপ্রীতিকর ঘটনা থেকে শুরু করে নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির ঘটনাও বাড়ছে। শীর্ষ নেতৃত্বের ব্যর্থতাই কি এর প্রধান কারণ?
উত্তর: এটা মনে রাখা উচিত যে, যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীতে লাখ লাখ তরুণ-তরুণী কাজ করে। তাদের বেশিরভাগই অত্যন্ত সুশৃঙ্খল। তবে তারপরও যে কোনো অঘটন ঘটতে পারে। যদি এসব জানার পরও কোনো নেতা ব্যবস্থা না নিয়ে এসব সহ্য করেন, তবে নিশ্চয়ই সেটা তার ব্যর্থতা। আর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবশ্যই এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
প্রশ্ন: বইতে আপনি বলেছেন, ২০০৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি যেদিন আপনি জাতিসংঘে ইরাকযুদ্ধের যথার্থতার স্বপক্ষে কাগজপত্র উপস্থাপন করতে গিয়েছিলেন, সেই দিনটি ছিলো আপনার কাছে পীড়াদায়ক। ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্র খোঁজার জন্য পরিচালিত সেই অন্তঃসারশুন্য অভিযানের কারণে যে প্রাণহানি হয়েছিল তার জন্য আপনি কি নিজেকে অপরাধী মনে করেন?
উত্তর: যে কোনো সংঘাতে উভয়পক্ষের প্রাণহানিই আমার কাছে দুঃখজনক। তবে সেই সময় ইরাকের ব্যাপারে আমাদের কাছে যে তথ্য ছিল সে অনুযায়ী এ সিদ্ধান্ত আমার কাছে ন্যায়সঙ্গত বলেই মনে হয়েছে। আমি তাই করেছি। আর আমি বইয়ে তো লিখেছি, আমি সেটা করতে বাধ্য ছিলাম। আমি তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলাম। সেই অবস্থানের কারণেই আমি ঘটনাপ্রবাহ থেকে সরে দাঁড়াতে পারতাম না।
প্রশ্ন: ৯/১১’র ঘটনার সময় আপনি পেরুতে ছিলেন এবং আপনার এশিয়া সফরের সময় সিআইএ’র ব্লাক সাইটগুলো (গোপন কারাগার) পরিচালনার ব্যাপারে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আপনার কি মনে হয়, সে সময়গুলিতে যদি আপনি সেখানে উপস্থিত থাকতেন তবে ভিন্ন কিছু ঘটত?
উত্তর: ৯/১১ নিয়ে ভিন্ন কিছু ঘটত না। তবে সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীদের জিজ্ঞাসাবাদ ও তাদের অন্তরীণ করে রাখার ব্যাপারে কিছু কিছু ঘটনা ঘটেছিলো যা নিয়ে পরবর্তীতে বিস্তারিত কোনো আলোচনা হয়নি। তবে আমি উপস্থিত থাকলে হয়তো এ ব্যাপারে কোনো আলোচনা হলেও হতে পারতো।
প্রশ্ন: উইকিলিকস প্রসঙ্গে আসা যাক, ইন্টারনেট কি কূটনীতির জন্য কল্যাণকর?
উত্তর: কখনো কখনো এটি খুবই ইতিবাচক, আবার কখনো খুবই নেতিবাচক। কিন্তু আপনি যদি একুশ শতকে বসবাস করতে চান তাহলে আপনাকে তো এই প্রজন্মের সাথে তাল মিলিয়েই চলতে হবে। আমরা যে পৃথিবীতে বাস করছি, সেটা প্রতি সেকেন্ডে ১ লাখ ৮৬ হাজার মাইল বেগে ঘুরছে। আমার এই চ্যালেঞ্জিং জীবন আসলে একটি ছোট ক্যামেরার মতো। আমি এমন কিছু পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছি যার সামনে আসলে আমার পড়া উচিৎ হয়নি।
প্রশ্ন: আপনি কি ‘বাথরুম’ প্রসঙ্গের কথা বলতে চাচ্ছেন ?
উত্তর: বাথরুম নিয়ে অথবা আমার কাছাকাছি এলাকায় অবস্থিত বিপনীকেন্দ্রে সংঘটিত ঘটনা নিয়ে। সেখানে পার্কিংয়ের সময় একটি খুটি এড়ানোর জন্য আমি আমার নতুন গাড়িটি একটু বাঁকা করে দাঁড় করিয়েছিলাম। আর তখনই এক শিক্ষার্থী সেটার ছবি তুলে সঙ্গে সঙ্গে অনলাইনে ছেড়ে দিল। ইন্টারনেটে খবরটা খুব দ্রুতই ছড়িয়ে গেল। লোকে ভেবে নিল যে আমি আসলে গাড়িটিকে অবৈধভাবে পার্ক করেছি। তারা এমনকি আমার সম্পর্কে এমন একটি শব্দ ব্যবহার করল যেটা আমি এর আগে কখনো শুনিনি।
প্রশ্ন:ইরাক আক্রমণ পরবর্তী পরিস্থিতিতে আপনি কি আপনার ‘পটারি বার্ন’ নীতি থেকে সরে এসেছেন?
উত্তর: আমি নই ‘পটারি বার্ন রুল’ কথাটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন একজন সংবাদকর্মী। এর দ্বারা বোঝায় ‘ যেহেতু আপনি ভেঙ্গেছেন তবে এর দায়িত্বও আপনার’। তবে স্পষ্ট করে বললে পটারি বার্নে এ ধরনের কোনো নিয়ম নেই।
( ইরাক যুদ্ধের আগে আগে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশকে যুদ্ধের ফলে বেসামরিক লোকদের পরিণতি নিয়ে সর্তক করার চেষ্টা করেন কোনো কোনো সাংবাদিক। তারা এ পরিস্থিতিকে পটারি বার্ন নিয়মের সঙ্গে তুলনা করেন। পরবর্তীতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েলও এই উদ্ধৃতিটি ব্যবহার করেন। মূলত যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কোনো শপিং মলে ইচ্ছাকৃত অথবা অনিচ্ছাকৃতভাবে শো কেসে সাজিয়ে রাখা জিনিস ভাঙ্গলে সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের থেকে পণ্যের দাম আদায় করে নেওয়া হয়। একেই বলা হয় পটারি বার্ন নীতি। ইরাক আক্রমণের সঙ্গে এর আড়াইকোটি লোকের ভাগ্যও জড়িত ছিলো, তাই তখন বুশকে বলা হয় যেহেতু তিনি ইরাকে হামলা চালাতে যাচ্ছেন তবে ইরাকের জনগণের দায়দায়িত্বও তার নিতে হবে। এ প্রসঙ্গেই সাংবাদিকরা পটারি বার্নের কথা প্রথম উল্লেখ করেন)
প্রশ্ন: তার মানে সেখানে গিয়ে ইচ্ছেমতো যে কোনো কিছু ধ্বংস করা (বৈধ)?
উত্তর: ‘সেখানে যান আর আপনার যা ইচ্ছে তাই ভাঙুন। আপনাকে এর জন্য কোনো মূল্য পরিশোধ করতে হবে না। ’ আমি অন্তত এরকম কিছুই বলিনি।
বাংলাদেশ সময়: ২২৩২ ঘণ্টা, মে ২৪, ২০১২
সম্পাদনা: শামসুন নাহার ও রাইসুল ইসলাম, নিউজরুম এডিটর; আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর
ahsan@banglanews24.com