নোবেল শান্তি পুরস্কার, যার পেছনে থাকা উচিত ছিল নিখাদ মানবতা, সহনশীলতা আর সংঘর্ষহীন পৃথিবীর স্বপ্ন— সেই পুরস্কারই আজ নানা সময়ে বিতর্ক, রাজনৈতিক পক্ষপাত এবং ইতিহাসের বিবেকহীন মোড়কে ঢাকা পড়ে গেছে। সর্বশেষ বিতর্কের কেন্দ্রে উঠে এসেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
সম্প্রতি পাকিস্তান এবং ইসরায়েল থেকে শান্তিতে নোবেল দেওয়ার জন্য ট্রাম্পকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এরপর থেকেই অনলাইনে হাস্যরস, সমালোচনা আর রাজনৈতিক বিতর্ক ছড়িয়ে পড়ে। তবে শুধু ট্রাম্প নয়, শান্তিতে নোবেল পাওয়া অনেক ব্যক্তির পুরস্কার নিয়েই আগে থেকেই প্রশ্ন আছে, আছে গভীর ঐতিহাসিক বিতর্ক। মনোনয়নে স্বচ্ছতার অভাব ও ঐতিহাসিকভাবে ইউরোপকেন্দ্রিক পক্ষপাতিত্ব আছে এর নির্বাচন কমিটির। মাঝে মাঝে লিঙ্গবৈষম্য, বর্ণবাদ এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকার অভিযোগও উঠেছে।
তা ছাড়া নোবেল শান্তি পুরস্কারের প্রতিষ্ঠাতা আলফ্রেড নোবেলের জীবনই এক বিশাল বিতর্ক। ডিনামাইট আবিষ্কার করে তিনি সরাসরি যুদ্ধ, ধ্বংস আর হত্যাযজ্ঞের প্রযুক্তিগত পথ খুলে দেন। কামান, রকেটসহ বহু যুদ্ধাস্ত্রের উন্নতিতে তার অবদান আছে। এই যুদ্ধই তাকে এনে দেয় বিপুল সম্পদ। বলা হয়, নিজের মৃত্যুর আগ মুহূর্তে তার উপলব্ধি হয়, তার নাম ইতিহাসে রক্তের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে। সেই পাপমোচনের লক্ষ্যেই হয়তো তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘নোবেল পুরস্কার’।
নোবেল পুরস্কারের ইতিহাসে যে প্রশ্ন সবচেয়ে বেশি ওঠে, তা হলো– এ পুরস্কারের নির্বাচন কতটা স্বচ্ছ ও ন্যায়নিষ্ঠ? ১৯০৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট শান্তিতে নোবেল পান, যা অনেকের মতে ছিল যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি করতে নরওয়ের কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত।
এরপর ১৯৬০ সাল পর্যন্ত এ পুরস্কার মূলত ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার ব্যক্তিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। ১১১ জন বিজয়ীর মধ্যে মাত্র ১৭ জন এশীয় এবং মাত্র ১৩ জন আফ্রিকান হওয়ায় এই ইউরোকেন্দ্রিক পক্ষপাত প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে।
বিশ্বজুড়ে অহিংস আন্দোলনের পথিকৃৎ মহাত্মা গান্ধী পাঁচবার মনোনয়ন পেলেও কখনোই শান্তিতে নোবেল পাননি। অথচ তার আদর্শ অনুসরণ করে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র এবং নেলসন ম্যান্ডেলা পরে এ পুরস্কার পান। গান্ধীর নোবেল না পাওয়া আজও ইতিহাসের এক রহস্য ও লজ্জার অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত।
১৯৯১ সালে অং সান সু চি মিয়ানমারে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলনের জন্য শান্তিতে নোবেল পান। কিন্তু যখন তিনি ক্ষমতায় আসেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর সেনাবাহিনীর গণহত্যা, ধর্ষণ, জ্বালাও-পোড়াও এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় তিনি নীরব থাকেন। এরপর থেকেই তার নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে নেওয়ার দাবি ওঠে।
১৯৭৩ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধ বন্ধে অবদান রাখার জন্য হেনরি কিসিঞ্জার শান্তিতে নোবেল পান। কিন্তু তিনি নিজেই ছিলেন বহু গোপন সামরিক অভিযানের রূপকার। তার পুরস্কার ঘোষণার পর দুজন নোবেল কমিটি সদস্য প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন। নিউ ইয়র্ক টাইমস তখন এই সিদ্ধান্তকে আখ্যা দেয় ‘নোবেল ওয়ার প্রাইজ’ হিসেবে।
২০১৯ সালে ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ প্রতিবেশী ইরিত্রিয়ার সঙ্গে সীমান্ত শান্তিচুক্তির কারণে নোবেল পান। কিন্তু পুরস্কার পাওয়ার এক বছরের মধ্যেই তিনি টাইগ্রে অঞ্চলে সেনা অভিযান চালান, যা ভয়াবহ গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। হাজারো মানুষ নিহত হন, লাখ লাখ মানুষ উদ্বাস্তু হন। তার পুরস্কার নিয়েও বিশ্বজুড়ে সমালোচনা ছড়ায়।
২০০৯ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র কয়েক মাস পরেই নোবেল শান্তি পুরস্কার পান। অথচ তখন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ও ইরাকে সামরিক অভিযান চালাচ্ছিল। ফলে তার অর্জন নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক হয়। ট্রাম্প বারবার অভিযোগ করে বলেন, ওবামা কিছু না করেই নোবেল পেয়েছেন, আমি কেন পারি না?
এমএইচডি/এমজে