ঢাকা: টাকা পাওয়া যাবে- এমন খবর শুনেই বৃষ্টি উপেক্ষা করে জুনের ৭ তারিখ কয়েক হাজার মানুষ ছুটে এসেছিলেন সাভারের একটি সামরিক স্কুলে। তাদের সবাই গত এপ্রিল মাসে ধসে পড়া বাণিজ্যিক ভবন রানা প্লাজার শ্রমিক।
দেশের পোশাক খাতের ভয়াবহতম দুর্ঘটনার পর ছয় সপ্তাহ কেটে গেছে, কিন্তু এখনও কাটেনি তথ্যের অপূর্ণতা। রানা প্লাজা ধসে নিহতের সংখ্যা সরকারি হিসাবে ১১২৯ জন, যাদের মধ্যে ৩০১ জনের পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। অথচ শ্রমিক অধিকার সংগঠনগুলোর মতে, মৃতের সংখ্যা আরও বেশি।
৭ তারিখ সকালে যারা নাম নিবন্ধন করার জন্য স্কুলটিতে জড়ো হয়েছিলেন, তারা জানতেন না কেন তাদের সেখানে আসতে বলা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে প্রত্যেককে এক হাজার টাকা করে কে দিলো, তা-ও তাদের জানা নেই। রানা প্লাজার চারতলায় থাকা ফ্যান্টম অ্যাপারেলসে কাজ করতেন খাদিজা বেগম। তিনি জানান, একজন প্রতিবেশী তাকে এখানে আসতে বলেছে। বলেন, “আমাকে এক হাজার টাকা দেওয়া হলো, একটা তালিকায় নিজের নাম লিখলাম। কে টাকা দিলো, আমি জানি না। ”
টাকাটা এসেছিল ব্রিটেনের খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান প্রিমার্কের কাছ থেকে। রানা প্লাজার একটি কারখানা তারা পোশাক কিনতো। জুনের ১ তারিখ তারা স্থানীয় পত্রিকাগুলোয় বিজ্ঞাপন দেয়, যাতে রানা প্লাজায় কর্মরত শ্রমিকদের ওই স্কুলমাঠে জড়ো হতে বলা হয়। সেখান থেকে শ্রমিকদের পূর্ণ তালিকা তৈরি করা হবে।
প্রিমার্কের মুখপাত্র ক্রিস ব্যারি জানান, নিবন্ধনকৃত সব রানা-প্লাজা শ্রমিককে তারা সাহায্য করতে চান, শ্রমিকদের তিন মাসের বেতনের সমান টাকা দিতে চান। যারা প্রিমার্কের পোশাক তৈরির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না, তাদেরও।
ধসে পড়ার দিন ভবনে ঠিক কারা কারা ছিলেন, তাদের পরিচয় বের করার দায়িত্বটি নিলো একটি বিদেশি প্রাইভেট কোম্পানি। এখান থেকে বাংলাদেশের পোশাক খাতের অনেক কিছু শেখার রয়েছে।
১৯৯০ সালের পর থেকে পোশাকখাত সমৃদ্ধ হওয়ার পাশাপাশি নিরাপত্তার অভাবে এ খাতের হাজার হাজার শ্রমিকের প্রাণহানি হয়েছে। বিভিন্ন সরকার এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা করলেও কেউই সফল হয়নি। ঢাকায় কর্মরত মানবাধিকার আইনজীবী সারা হোসেন এ ব্যাপারে বলেন, “ব্যাপারটা এরকম- যেন অ্যালার্ম বেজেই যাচ্ছে আর বেজেই যাচ্ছে, কিন্তু ঘুম ভাঙছে না। ”
তবে রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পর নড়েচড়ে বসেছে বড় বড় আন্তর্জাতিক ক্রেতারা। মে মাসে দেশের গার্মেন্টস রপ্তানির হার ১৫ শতাংশ বেড়েছে। সরকারসহ নানা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের ইতোমধ্যে কিছু ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। কিন্তু পঙ্গু হয়ে যাওয়া শ্রমিক ও তাদের ক্ষতিগ্রস্ত ভবিষ্যতের জন্য দীর্ঘমেয়াদে কি সাহায্য দেওয়া হবে, তা এখনও অজানা।
শুধু তাই নয়, দেশের সাড়ে পাঁচ হাজার নিবন্ধিত পোশাক কারখানা ও সেসবের শ্রমিকদের ভাগ্যে কি আছে- তা এখনও অনিশ্চিত। সরকার তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবে কিনা, শ্রম আইনের সংশোধন ও শ্রমিক অধিকার নিশ্চিত করবে কিনা- তাও পরিষ্কার নয়।
দুর্ঘটনার পর রানা প্লাজার মালিকসহ ওই ভবনে অবস্থিত কারখানাগুলোর মালিকদের গ্রেফতার করা হয়েছে। অনিরাপদ পোশাক কারখানাগুলো শনাক্ত করে সেগুলো পরিদর্শন শুরু করেছে সরকার, এরই মধ্যে কিছু কারখানা বন্ধও করে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এখানেও প্রশ্ন রয়েছে। কি হবে বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানার শ্রমিকদের? সেসবে কর্মরত হাজার হাজার শ্রমিকের পরিবার তো তাদের আয়ের উপরই নির্ভর করে।
অবশ্য বাংলাদেশের পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) মতে, বর্তমানে দেশে ৩০ ভাগ শ্রমিক ঘাটতি রয়েছে, আর শ্রমিক সংখ্যার চেয়েও কাজের সংখ্যা বেশি রয়েছে। বিজিএমইএ সভাপতি আতিকুল ইসলাম তাই নিশ্চয়তা দিয়ে জানান, কেউ চাকরি না পেলে তাকে চাকরি দেওয়া সম্ভব।
তবে সুযোগ পেলেও রানা প্লাজায় বেঁচে যাওয়া অনেক শ্রমিকের আর সেলাই মেশিনের পাশে ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। সেরকম ইচ্ছাও নেই অনেকের।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ২৫ বছর বয়সী রোজিনা ফাইদুল তিনদিন একটি বিমের নিচে আটকে ছিলেন। উদ্ধারকারীরা তার হাতে একটি ছোট করাত দিলে তিনি তা নিয়ে নিজের হাত কাটার চেষ্টা করেন। কিন্তু মাংস পেরিয়ে হাড় পর্যন্ত গিয়েই তিনি জ্ঞান হারান। উদ্ধারকর্মীরা পরে তাকে উদ্ধার করলেও রোজিনার বোনের কোনো খোঁজ এখনও মেলেনি। রোজিনা জানান, তিনি আর ফিরে যাচ্ছেন না কোনো গার্মেন্ট কারখানায়। তার স্বামী একটি পাট কারখানায় কাজ করেন, সেখানেও তাকে যেতে দেবেন না।
এক্ষেত্রে অবশ্য এগিয়ে এসেছে ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান প্রিমার্ক। পঙ্গু হয়ে যাওয়া শ্রমিকদের জন্য দীর্ঘমেয়াদী সাহায্য দেবে তারা। তাদের কথা কাজে পরিণত হওয়ার অপেক্ষায়ই আছেন রোজিনারা। সরকার তাকে অন্য কোথাও কাজ জুটিয়ে দেবে, এমনটাও আশা করেন তিনি।
এভাবে সবাই এগিয়ে এলেই হয়তো বাংলাদেশের পোশাকখাতের জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৮০৫ ঘণ্টা, জুন ১১, ২০১৩
সম্পাদনা: হাসান শাহরিয়ার হৃদয়, নিউজরুম এডিটর;জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর