কলকাতা: কলকাতার কলেজ পড়ুয়া থেকে শুরু করে বিপিও এবং আইটি সেক্টরের তরুণ প্রজন্মের একটা বড়ো অংশ জড়িয়ে পড়ছে ‘ডিজাইনার ড্রাগ’-এর কবলে।
শহরের ব্যস্ত জীবনের ফাঁকে একটু ভিন্ন আমেজের জন্য কলকাতায় আজকাল হামেশাই বসছে ‘রেভ পার্টি’।
‘ডিজাইনার ড্রাগস’ পাওয়া খুবই সহজে। আর তাতে ধরা পড়ার ঝুঁকিও কম। এতে নেই বিকট কোনো গন্ধ, জোগাড় করার ঝক্কি, নেই পুলিশের ঝামেলাও।
কয়েক বছর আগেও কলকাতায় ‘রেভ পার্টির’ প্রচলন খুব একটা ছিলো না। কিন্তু হাল আমলের সব চেয়ে ‘ফ্যাশানেবল কালচার’ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই ‘রেভ পার্টি’। উদ্দাম গান-বাজনা, মিশ্র ডিজে সংগীত আর আলো আঁধারির ফাঁকে ফাঁকে মাদক সেবন।
আগে এই ধরনের পার্টিতে থাকতো মদ, গাঁজা, চরস ধরনের মাদক। খুব সাহসী পার্টিগুলিতে পাওয়া যেত হেরোইন কিংবা ব্রাউনসুগার। কিন্তু বর্তমানে এ ধরনের পার্টিগুলোতে জায়গা করে নিয়েছে অ্যালপ্রেক্স, ইপোটিন, নাইট্রসান ১০, স্প্যাসমো পক্সিভান আথবা ট্রাইকা জাতীয় ট্যাবলেট।
এগুলো সবকটি বিভিন্ন ধরনের রোগের ওষুধ। বিভিন্ন রোগের জন্য চিকিৎসকরা এসব ওষুধ রোগীদের প্রেসক্রাইব করেন।
যেমন অ্যালপ্রেক্স, নেশার বাজারে এর চাহিদা এখন তুঙ্গে। আসলে এটি একটি অ্যালপ্রযেলাম জাতীয় ওষুধ। এটি মূলত দেওয়া হয় নার্ভের রোগীদের। আবসাদ, উদ্বেগ, তন্দ্রাছন্নভাবের চিকিৎসা করতে এই ওষুধ প্রয়োগ করা হয়।
কলকাতার নেশার জগতে বর্তমানে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করছে ইপোটিন। ইপোটিন মূলত দীর্ঘ দিনের মাথা ব্যাথা, বমি বমি ভাব, অনিদ্রা এবং হার্টের অসুখে ব্যবহার করা হয়।
নাইট্রসান ১০ ইনসোমেনিয়া গোত্রের ওষুধ। পেশী শিথিল করা এবং উদ্বেগ দূর করতে এ জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা হয়।
স্প্যাসমো পক্সিভান ব্যবহার করা হয় পেটের ব্যথা কমানোর জন্য। আর ট্রাইকা দেওয়া হয় অনিদ্রা রোগীদের।
এসব ওষুধ নিয়েই তৈরি হচ্ছে ‘ডিজাইনাইর ড্রাগ’। আর তাতেই ডুবে যাচ্ছে কলকাতার তরুণ-তরুণীদের বড় একটি অংশ।
কলকাতার নতুন অফিস পাড়া সল্টলেকের সেক্টর ফাইভ কিংবা রজার হাট টাউনশিপ সব জায়গাতেই চলছে এ নেশার রমরমা অবস্থা।
পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে সেক্টর ফাইভের এক আইটি কর্মচারী আলাপ করালেন তার বেশ কিছু সহকর্মীর সঙ্গে, যারা এই ‘ডিজাইনার ড্রাগ’ ব্যাবহার করেন।
প্রথমে কিছু বলতে না চাইলেও কফি শপের আড্ডায় তারা একে একে স্বীকার করলেন রাত জেগে কাজ করার ক্লান্তি, ফোনে ক্লায়েন্টদের মুখ-খেঁচানি, ছুঁতে না পাড়া টার্গেটের মানসিক চাপ, চাকরির অনিশ্চয়তা থেকে শুরু করে ভঙ্গুর সম্পর্ক কিংবা আশপাশের বন্ধুদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সফলতার সিঁড়ি টপকাতে না পারার যন্ত্রণা ভুলে থাকতেই কিছুক্ষণের জন্য তারা হাজির হন এই সব ‘রেভ পার্টিতে’ আর গ্রহণ করেন ‘ডিজাইনাইর ড্রাগ’।
নাইট শিফটে কাশির সিরাপের সঙ্গে রাম মিশিয়ে খাওয়ার দিন শেষ। এখন তার বদলে একটা `ইয়ারভা` মুখে ফেলে দিলেই একদম রিল্যাক্স। থাকেনা গন্ধ বা ধরা পড়ার চিন্তা।
কি এই `ইয়ারভা`?
হিটলারের নাৎসি বাহিনীকে চাঙ্গা রাখতে এ ওষুধ ব্যবহার করা হতো।
থাইল্যান্ডে এ ধরনের ড্রাগ হেরোইনের থেকেও বেশি জনপ্রিয়। ওই আইটি কর্মী বাংলানিউজের কলকাতা করেসপন্ডেন্টকে জানান, অফিসের কাজে থাইল্যান্ড গিয়ে তিনি প্রথম এই ড্রাগ সেবন করেন।
`ইয়ারভা` দেখতে ট্যাবলেটের মতো। লাল, সবুজ কিংবা নীল রঙের। কাজের শেষে গাড়িতে করে বাড়ি ফেরার সময় একটা `ইয়ারভা` মুখে ফেলে, কানে হেডফোন গুঁজে গান চালিয়ে দিলে দিনের সমস্ত ক্লান্তি এক নিমিষে ভুলে যাওয়া যায় বলে জানালেন বছর তিরিশের এই তরুণ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মায়ানমারের সীমান্ত এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে `ইয়ারভা`। নাফ নদী দিয়ে ছোট ছোট মাছ ধরার নৌকায় অথবা গবাদি পশু নিয়ে যে ট্রেলারগুলি আসে সেগুলোর মাধ্যমে কক্সবাজারের টেকনাফে পৌঁছায় এ ট্যাবলেট। সেখান থেকেই ছড়িয়ে যায় গোটা দেশে তার পর ঢাকা হয়ে কলকাতায় পৌঁছাতে বেশি সময় লাগেনা ইয়ারভার।
`ইয়ারভা` তৈরি হয় মুলত হেরোইন তৈরির অবশিষ্ট অংশ থেকে। এছাড়াও এতে লাগে লবন, পরিশুদ্ধ করা কাশির সিরাপ, ক্ষার প্রভৃতি।
বাংলাদেশে এই নেশার কিছুটা চল থাকলেও কলকাতায় এই নেশা একেবারে নতুন। কলকাতায় একটি `ইয়ারভা` ট্যাবলেটের দাম পড়ে প্রায় ৪০০-৪৫০ রুপি।
দক্ষিণ কলকাতার একটি বিখ্যাত শপিং মলের ফুড টকিজে বসে কথা হচ্ছিল প্রকৌশল বিদ্যা পাঠরত কয়েকজন ছাত্রের সঙ্গে। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে তারাও জানালেন বেশ কিছু তথ্য।
তারা জানান, `ইয়ারভা` বা `এসটাসি`-এর মতো দামি নেশা তারা করেন না। তারা মূলত ব্যাবহার করেন অ্যালপ্রেক্স, ইপোটিন, নাইট্রসান ১০ জাতীয় ওষুধ।
কারণ জানতে চাইলে তারা যে হিসাব দেখায় তাতে চক্ষু চড়কগাছ। যেখানে `ইয়ারভা` বা `এসটাসি`-এর দাম ৪০০ থেকে ৮০০ রুপি প্রতি ট্যাবলেট। যেখানে ১০ গ্রাম চরসের দাম ৩৫০-৫০০ রুপি, ১০ গ্রাম গাঁজার দাম ১৫০-২০০ রুপি। সেখানে অ্যালপ্রেক্সের একটি ট্যাবলেটের দাম ২.৬০ রুপি, ইপোটিন এর দাম ২.২০ রুপি। বাড়ি থেকে নেওয়া হাত খরচের টাকায় দিব্যি কুলিয়ে যায় তিন চার ঘণ্টার দেদার নেশা।
এছাড়াও রয়েছে কেটামাইনের মতো ভেটানারি ওষুধ। এক ছাত্র বললেন, ‘আয়োডেক্স (মাথা ব্যথার মলম)’ একবার নাক দিয়ে টেনে দেখুন মনে হবে আপনি বিশ্বের সব থেকে সুখি মানুষ। আর যদি সবকটা একটু করে মিশিয়ে নেওয়া যায় তবে নেশা জমবে অনেক বেশি।
তবে এটা করতে হবে খুব সাবধানে। এটাকেই বলা হচ্ছে "ডিজাইনার ড্রাগ"।
কিভাবে?
বন্ধু-বান্ধব ও কিছু ওষুধের দোকানের মাধ্যমে তরুণ-তরুণীদের কাছে পৌঁছাচ্ছে এই ‘ডিজাইনার ড্রাগ’। চলে আসছে হাতের মুঠোয়। একটি পুরানো প্রেসক্রিপশন জোগাড় করতে পারলেই হলো।
প্রেসক্রিপশন ছাড়াই অনেক জায়গায় সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে পাওয়া যায় অ্যালপ্রেক্স, ইপোটিন, নাইট্রসান ১০, স্প্যাসমো পক্সিভান অথবা ট্রাইকা জাতীয় ওষুধ।
‘ডিজাইনার ড্রাগ’ ওভারডোজের ফলে যেকোনো সময় হতে পারে মৃত্যু। দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে খারাপ হবে কিডনি, হার্ট ও ব্রেন।
কিন্তু কেন বাড়ছে ‘ডিজাইনার ড্রাগের’ ব্যবহার?
চিকিৎসকরা জানান, অতিরিক্ত পড়াশোনার চাপ, প্রতিযোগিতা, সফল হওয়ার ইঁদুর দৌঁড় থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে অনেক ছাত্রই এই ভয়ঙ্কর নেশায় আচ্ছন্ন হচ্ছেন। আবার নিছক কৌতূহলের বশে শুরু করে নেশার মুঠোয় বন্দি হয়ে পড়ছেন অনেকে।
অপরদিকে অফিসের চাপ, অবাস্তব টার্গেট, ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ার ভয়, চাকরির অনিশ্চয়তায় সমাজ জীবন থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যাওয়া তরুণ প্রজন্ম একটুখানি মুক্তি খুঁজতে গিয়ে জড়িয়ে পড়ছে এ নেশার জালে। যে জাল ছিঁড়ে বের হওয়া বাস্তবে প্রায় অসম্ভব।
তাই দিন দিন ভিড় বাড়ছে নেশা ছাড়াবার সেন্টারগুলোতে। একের পর এক ভেঙে যাচ্ছে সংসার। আর এভাবেই ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে কলকাতা ও তার আশেপাশের অঞ্চলগুলোর তরুণদের-তরুণীদের একটা বড়ো অংশ।
বাংলাদেশ সময়: ০৫৩৬ ঘণ্টা, জুন ১৪, ২০১৩
ভাস্কর সরদার/সম্পাদনা: কামরুল হাসান কাইউম ও শিমুল সুলতানা, নিউজরুম এডিটর
eic@banglanews24.com