ঢাকা: তার উত্থানের গল্প ছিল স্বপ্নের মতো। জন্মস্থানে সারাক্ষণ গোলাগুলি-খুনোখুনির ঘটনা ঘটলেও তিনি প্রায় নিষ্পাপ হিসেবেই বেড়ে ওঠেন।
অনবদ্য সঙ্গীত পরিবেশনের জন্য ফাদেল শাকের নামের এই লেবানিজ সুপারস্টার আরব বিশ্বে ‘দ্য কিং অব রোমান্স’ খ্যাতি লাভ করে ফেলেন। শুধু খ্যাতিই নয়, সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দিয়ে করেছেন বাড়ি-গাড়ি, সমুদ্র সৈকতের কাছে গড়ে তুলেছেন রাজকীয় রেস্টুরেন্ট। বরেণ্য অতিথিদের সম্মানে এখানেই আয়োজন করেন বড় বড় কনসার্টের আসর।
কিন্তু গত বছর বন্ধু-ভক্ত সবাইকে হতবাক করে দিয়ে সঙ্গীতশিল্পী শাকের ঘোষণা দেন, ইসলামে নিষিদ্ধ এমন গান আর করবেন না তিনি। মুখভর্তি দাঁড়ি রেখে রীতিমত কট্টরপন্থি ‘শেখ’ বনে যান।
গত মাসেই লেবাননের সিডন উপশহরে সেনাবাহিনীর সঙ্গে শাকেরের সশস্ত্র গোষ্ঠীর সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষের পর তিনি শত্রুদের ‘কুকুর ও শূকর’ বলে সম্বোধন করেন এবং উচ্ছ্বাসভরে দাবি করেন, দু’জন শত্রুকে খতম করে দেওয়া হয়েছে।
শাকের এখন জনসম্মুখে অনুপস্থিত থাকলেও ধারণা করা হচ্ছে শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত শরণার্থী শিবিরের কাছেই কোনো গোপন আস্তানায় গা-ঢাকা দিয়েছেন তিনি।
৪৪ বছর বয়সী শাকেরের বালকসুলভ চেহারা থেকে কিভাবে এখন এমন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বের হয় তা ভাবতেই সবাইকে হতবাক হতে হয়। একই সঙ্গে এই প্রশ্নটির জবাব এখন সবার মাথায়ই ঘুরপাক খাচ্ছে যে, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ কি লেবাননের সমাজেও ভয়ংকর প্রভাব ফেলছে না?
শাকেরের মালিকানাধীন রেস্টুরেন্টের সাবেক সেবক আহমেদ আল-নাজ বলেন, ‘আমরা স্থম্ভিত! বিশ্বখ্যাত একজন গায়কের কেন হঠাৎ এই পরিবর্তন হলো?’
যদিও শাকেরের এই পরিবর্তনের হিসেব কেউ এখনও স্পষ্টত মেলাতে পারছে না, তবু কেউ কেউ মনে করছেন লেবানন ও আরব অঞ্চলের সাম্প্রদায়িক বিভাজনই এ অঞ্চলের মানুষকে ভয়ঙ্কর রণাঙ্গনে ঠেলে দিচ্ছে।
জানা যায়, সুন্নি অধ্যুষিত সিডন অঞ্চলে লেবাননের শিয়া সামরিক গোষ্ঠী হেজবুল্লাহ-ই প্রভাব খাটিয়ে আসছিল। কিন্তু প্রতিবেশি সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ এখানকার রাজনৈতিক ও সামরিক সমীকরণ সম্পূর্ণ পাল্টে দেয়। শিয়াদের সংগঠন হেজবুল্লাহ বাশার আল-আসাদের পক্ষ নিলেও শাকেরের সম্প্রদায় অর্থাৎ সুন্নিরা সমর্থন জানাতে থাকে সিরিয়ার বিদ্রোহী যোদ্ধাদের।
আর এইসব জটিল ব্যাপারের মারপ্যাচে নিজ সম্প্রদায়ের বা ঘনিষ্ঠজনদের প্রাণহানিই মর্মাহত করে তোলে শাকেরকে এবং তাকে দ্রুত সন্ত্রাসবাদের দিকে ঠেলে দেয়।
নিজেকে আড়াল করার আগে এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে শাকের হুমকি দিয়ে বলেন, ‘সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় আমরা আমাদের অধিকার আদায় করবো, কারণ কোনো রাষ্ট্র, আইন কিছুকেই মানি না আমরা। এটা (পৃথিবী) একটা জঙ্গল। ’
শাকেরের প্রাথমিক জীবনের গল্প আরব টেলিভিশনের নাটকের স্ক্রিপ্টের মতো। ফিলিস্তিনি মা এবং লেবানিজ বাবার ঘরে জন্মগ্রহণ করা শাকের বেড়ে উঠেন সিডনে অবস্থিত ‘এইন এল-হিলওয়েহ’ নামের একটি ফিলিস্তিনি শরণার্থী ক্যাম্পের পাশে গড়ে ওঠা শহরতলীতে। শিক্ষাক্ষেত্রে মাধ্যমিকের গণ্ডিও পেরোতে পারেননি। কিন্তু একজন প্রতিবেশি তার মধ্যে সঙ্গীত প্রতিভা দেখতে দেখে বিভিন্ন বিয়ে ও অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশনের জন্য চুক্তিবদ্ধ করে নেন।
তারপর শুধুই সাফল্যের গল্প। শাকেরের গানের সুর ছড়িয়ে পড়ে আরব বিশ্বসহ সারা সঙ্গীত দুনিয়ায়। খ্যাতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লেবানন এবং বহির্বিশ্বে বড় বড় কনসার্টের ডাক পড়তে থাকে তার। একের পর এক বাজারে আসতে থাকে তার অডিও ও ভিডিও সঙ্গীতের অ্যালবাম। আরব বিশ্বের সঙ্গীতপ্রেমী প্রতিটি মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে শাকেরের নাম।
তার জনপ্রিয় রোমান্টিক সঙ্গীতগুলোর মধ্যে ‘ও অ্যাবসেন্ট ওয়ান’, ‘আই ফরগট টু ফরগট ইউ’ এবং ‘কাম, মাই লাভ’ এখনও ভক্তদের মুখে মুখে বাজে।
শাকেরের গাড়ির সাবেক ড্রাইভার হানি এল-সিন বলেন, ‘তিনি ধার্মিক ছিলেন কিন্তু চরমপন্থি ছিলেন না। তিনি নামাজ-রোযা করতেন, কিন্তু তার রেস্টুরেন্টে অ্যালকোহল জাতীয় পানীয়ও বিক্রয় হতো, তিনি নিজেও কার্ড (তাস) খেলতে পছন্দ করতেন। ’
জানা যায়, শাকেরের আচরণে প্রাথমিক পরিবর্তন একেবারেই ধীরে ধীরে আসে। কয়েকবছর আগে তিনি রেস্টুরেন্টে এসে তার স্টাফদের কোনো কারণ ছাড়াই বলেন, এখানে আর অ্যালকোহল বিক্রয় হবে না।
তার ওই ঘোষণায় ঘনিষ্ঠজনরা ভেবেছিলেন হয়তো পরিবারের চাপের কারণেই তিনি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
কিন্তু সুন্নিদের সশস্ত্র সংগঠন জুন্দ আল-শাম এর সদস্য ভাই আবদেল রহমানের অনুপ্রেরণায় নাকি চরমপন্থি কোনো জঙ্গি নেতার সংস্পর্শে শাকের এমন হয়েছেন তা আজও অজানা।
২০১০ সালে মক্কায় হজ্জ করা শেষে দেশে ফিরে মাত্র অল্প কিছু অনুষ্ঠানে পারফর্ম করেন শাকের। সবশেষে গত বছর ঘোষণা দেন, আর কোনো দিন গান করবেন না তিনি।
তবে সাম্প্রতিক দিনগুলোতে নিজের সশস্ত্র সংগঠনের উদ্যোগে আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ‘জিহাদি’ সঙ্গীত পরিবেশন করে আসছেন শাকের।
সূত্র জানায়, শুধু তাই নয় এ অঞ্চলের ভয়ংকর যোদ্ধা আহমদ আল-আসিরের সঙ্গে নিয়মিত উঠা-বসা করেন তিনি। আর আসিরের সংগঠন ‘আল আসিরের’ সক্রিয় কর্ণধার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
কোনো সঙ্গীতানুষ্ঠানে না গেলেও এখন জঙ্গি নেতা আসিরের সঙ্গেই টিভি অনুষ্ঠানে হাজির হন শাকের। এক সাক্ষাৎকারে জিহাদি সঙ্গীত গেয়ে শাকের ঘোষণা করেন, ‘কেঁদো না গো বন্ধু যদি আমি হারিয়ে যাই/ মৃত্যুকে আমি ভয় পাই না/ আমি শহীদী মৃত্যু চাই। ’
শাকেরের সংগঠন আল আসিরের বর্তমান কার্যক্রমের লক্ষ্য হচ্ছে এই অঞ্চলে সুন্নিদের আধিপত্য বিস্তারে পথ সুগম করা।
গত মাসে আল আসির মসজিদের কাছে লেবানিজ আর্মি ও শাকেরের জঙ্গি গ্রুপের সংঘর্ষ হয়। আল আসিরের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, সংঘর্ষে হেজবুল্লাহও সেনাবাহিনীর সঙ্গে অংশগ্রহণ করে। ওই সংঘর্ষে প্রায় ৩০ জন নিহত ও শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়।
ওই লড়াইয়ের পর শাকেরকে জনসম্মুখে দেখা যায়নি। কিন্তু অনলাইনে প্রকাশিত এক ভিডিও বার্তায় দেখা যায় হাস্যোজ্জ্বল শাকের দুই আঙ্গুল উঠিয়ে বিজয় চিহ্ন দেখাচ্ছেন এবং বলছেন, ‘আমরা গতকাল তোমাদের মৃতদেহগুলি গোরস্থানে পাঠিয়ে দিয়েছি, কুত্তা, শূকর!’ কেউ একজন পাশ থেকে বলছিলেন যে ১৬ সেনা আহত হয়েছে, তখন তিনি বলছিলেন, ‘স্রষ্টা, তাদের এই হতাহতের সংখ্যা বাড়িয়ে দাও!’ এই লড়াইয়ের পর নিজে গর্বিত বলেও ভিডিও বার্তায় দাবি করেন শাকের।
তার এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনে ভক্ত ও সিডনের পুরাতন প্রস্তর মার্কেটের সিডি দোকানদার আজম আল-মাল বলেন, ‘ঠিক আছে, আপনি সঙ্গীত ছেড়ে দিয়ে ধার্মিক হওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, কিন্তু তার মানেতো এই নয় যে আপনি মানুষ হত্যা করবেন!’
আজম বলেন, তিনি এখনও শাকেরের সিডি বিক্রয় করেন, তবে খুব কম লোকই এখন তার সিডি কেনে।
আজম বলেন, ‘আমার বোধে আসে না কিসে তিনি এতো পরিবর্তন হয়ে গেলেন? এসব করে তার কী লাভ?’
আজমের মতো অনেক শাকের ভক্তই এখন এই প্রশ্নের উত্তরই খুঁজে বেড়ান, ‘একটি নিষ্পাপ শিশুসুলভ চেহারা থেকে কেন এতো অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ঝরে, কারা দায়ী এ জন্য?’
(নিউইয়র্ক টাইমস থেকে ভাষান্তর)
বাংলাদেশ সময়: ১১৪০ ঘণ্টা, জুলাই ২৯, ২০১৩