ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

ক্রিমিয়া নিয়ে পুতিনের জুয়া

রাইসুল ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১০৬ ঘণ্টা, মার্চ ৩, ২০১৪
ক্রিমিয়া নিয়ে পুতিনের জুয়া

ঢাকা: সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়েছে দুই যুগ। তবে রুশ ভল্লুকের নখরে এখনও রক্তাত্ত তার প্রতিবেশীরা।



দুই যুগে প্রতিবেশী সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলোর সঙ্গে একটার পর একটা ঝামেলায় জড়িয়েছে রাশিয়া। সর্বশেষ সংযোজন ইউক্রেনের সঙ্গে ক্রিমিয়া নিয়ে দ্বন্দ্ব।

ককেশাসের চেচনিয়া ও দাগেস্তানে ভয়াবহ রুশ আগ্রাসনের স্মৃতি মানুষ এখনও ভোলেনি। ক্ষুদ্র দু’টি সিটমহল ওশেটিয়া ও আবখাজিয়া নিয়ে জর্জিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার লড়াইয়ের রেশও এখনও কাটেনি।

২০০৮ এর সংঘাতে ক্ষুদ্রশক্তির জর্জিয়া পিছু হটলেও ইউক্রেন জর্জিয়া নয় আর ক্রিমিয়াও নয় আবখাজিয়া।

ক্রিমিয়াকে কেন্দ্র করে যদি সত্যিই মস্কো ও কিয়েভের মধ্যে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ বেধে যায় তবে এর ফলাফল হবে অকল্পনীয়।

শুধু ইউক্রেনই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না বরং দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির শিকার হতে হবে খোদ রাশিয়াকেই।

ক্রিমিয়ায় রুশ অভিযানে ইউক্রেনে সৃষ্টি হবে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের। ইউক্রেনের ৭৭ শতাংশ মানুষ ইউক্রেনি বংশোদ্ভূত। অপরদিকে ১৭ শতাংশ রুশ। অপরদিকে ক্রিমিয়ায় ৫৮ শতাংশ রুশ, ২৬ শতাংশ ইউক্রেনিয় এবং ১২ শতাংশ তাতার।

তাই রুশ অভিযান ইউক্রেনে সৃষ্টি হবে জাতিগত সংঘাত। কারণ তাতার ও ও ইউক্রেনিয়রা সম্মিলিতভাবে রুশ বিরোধী।

ফলে ইউরোপের পূর্ব সীমান্তে দেখা দেবে দীর্ঘমেয়াদী অস্থিতিশীলতা। অর্থনৈতিক ভাবেও রাশিয়াকে কোণঠাসা হতে হবে। মূল রপ্তানি পণ্য তেল ও গ্যাস রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হলে দুর্দশাগ্রস্ত হবে রাশিয়ার অর্থনীতি।

ইউরোপে নিজেদের তেল ও গ্যাস রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেলে রাশিয়াকেই বেশি সমস্যায় পড়তে হবে। বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ কমে গেলে রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে সৃষ্টি হবে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার।

পুতিনের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের দ্বন্দ্বের প্রভাব পড়তে পারে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চেও।

বদলে যেতে পারে সিরিয়া, ইরান ও মিশর সহ পুরো মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতের চিত্রও এমনকি আফগানিস্তানের ক্ষেত্রেও দেখা দিতে পারে নতুন হিসাব নিকাশ।

সত্যিই যদি রাশিয়া ক্রিমিয়া আক্রমণ করে বসে তবে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে তার সম্পর্ক নেমে আসবে শীতল যুদ্ধের আমলের পর্যায়ে ।

তবে মনে রাখতে হবে শীতল যুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন আন্তর্জাতিকভাবে যে সুবিধাজনক অবস্থায় ছিলো এখন আর সে অবস্থায় নেই তার উত্তরসূরী রাশিয়া ।

ক্রিমিয়া আক্রমণের জবাবে পুতিন দেখতে পাবেন রাশিয়ার চারধারে ন্যাটোর সম্প্রসারণ।

ন্যাটোর ছদ্মাবরণে যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে রাশিয়ার চারধারের পূর্ব ইউরোপীয় ও মধ্যএশীয় দেশগুলোকে অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত করতে পারে।

অপরদিকে ক্রিমিয়া দখল করলে ইউক্রেনিয়দের মনে জন্ম নেবে আজীবনের তীব্র রুশ বিদ্বেষ। পাশাপাশি অন্যান্য প্রতিবেশী সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলোও সন্দেহের চোখে দেখবে রাশিয়াকে।

এছাড়া ক্রিমিয়ার তাতার যারা আগে থেকেই রাশিয়ার প্রতি বীতশ্রদ্ধ তারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু করতে পারে।

এই তাতারদের রয়েছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে শতকের পর শতক ধরে প্রতিরোধ সংগ্রামের ঐতিহ্য। সর্বশেষে ১৯৪৪ সালে নিজেদের হাজার বছরের জন্মভূমি থেকে তাতারদের ঝাড়ে বংশে উচ্ছেদ করেন স্তালিন। ৯১ সালে সোভিয়েতের পতনের পরই কেবল তারা ফিরে আসার অনুমতি পায় নিজের বাসভূমে।

তাদের মনেও রয়েছে তীব্র রুশবিদ্বেষ। এক্ষত্রে তাদের সহায়তা দেবে ইউক্রেনিয়রা। ফলে ক্রিমিয়াতেও সৃষ্টি হতে পারে চেচনিয়া ও ককেশাসের মত পরিস্থিতি। ফলশ্রুতিতে দীর্ঘমেয়াদী অস্থিতিশীলতার শিকার হবে পুরো কৃষ্ণসাগরীয় অঞ্চল।

আর ক্রিমিয়া নিয়ন্ত্রণে রাখার পেছনে রাশিয়ার যে রণকৌশলগত কারণের কথা বলা হচ্ছে তাও বেকার হয়ে যাবে যদি তুরস্ক কৃষ্ণসাগর এবং ভূমধ্যসাগরের সংযোগস্থল বসফরাস প্রণালী দিয়ে রাশিয়ার নৌবহরকে যাতায়াত করতে না দেয়।

যদিও আন্তর্জাতিক চুক্তির বাধ্যবাধকতার কারণে রাশিয়া সহ যে কোনো দেশকে এ প্রণালী ব্যবহার করতে দেয় তুরস্ক। কিন্তু ক্রিমিয়ায় আগ্রাসনের জবাবে ইচ্ছে করলেই রাশিয়াকে সে সুবিধা বন্ধ করে দিতে পারে তুরস্ক।

এ ক্ষেত্রে তার পেছনে থাকবে যুক্তরাষ্ট্র সহ ন্যাটোর সহযোগীরা। আর তুরস্ক নিজেও ন্যাটোর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী রাষ্ট্র।

আর যদি বসফরাসের দরজা রাশিয়ার জন্য বন্ধ হয়েই যায় তবে কৃষ্ণসাগরে রুশ নৌবহরের আসলে কোনো মূল্যই থাকে না।

এছাড়া আন্তর্জাতিকভাবে এক ঘরে হয়ে পড়লে এবং অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়লে নিজ দেশেই প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে পুতিন। সত্যিকার অর্থে নিজ দেশেও তিনি খুব একটা জনপ্রিয় নন। খোদ রাশিয়ানদের মধ্যেও পশ্চিমাপন্থি কম নেই।

সবথেকে বড় কথা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সমরশক্তি হয়েও সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়েছিলো অর্থনৈতিক কারণেই। তাই বিষয়টিকে ছোটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই।

অপরদিকে ক্রিমিয়ায় আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়ায় সিরিয়ায় সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিম‍া শক্তি।

সত্যিকার অর্থে যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমা বিশ্ব এখনও সিরিয়ার সংঘাতে দর্শকের ভূমিকা পালন করছে।

যদি সত্যিই পশ্চিমারা সিরিয়ায় হস্তক্ষেপ করে তবে সুন্নি অধ্যুষিত দেশটিতে শিয়া প্রভাবিত বাশার আল আসাদের ক্ষমতায় টিকে থাকাই মুশকিল হবে।

এক্ষেত্রে হয়তো রাশিয়াও ইরানকে পরমাণু অস্ত্রে সজ্জিত করতে পারে, তবে পাল্টা জবাব হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু অস্ত্রে সজ্জিত করতে পারে সৌদি আরব ও তুরস্ককে। সঙ্গে পাকিস্তান তো আছেই।


সিরিয়ার বাশার আল আসাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কারণে সিরিয়ায় অবস্থিত ভূমধ্যসাগরে নিজেদের একমাত্র নৌঘাঁটি তারতাউস নিয়ে চিন্তিত রাশিয়া। কারণ বাশারের পতন হলে তারতাউসে রুশ নৌ উপস্থিতি বজায় রাখা সম্ভব হবে না। তাই ইদানীং নিজেদের পুরনো মিত্র মিশরের দিকে ঝুঁকেছে রাশিয়া।

কিন্তু দেশটির সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী জেনারেল সিসির সঙ্গে পুতিনের মাখামাখি ভালো চোখে দেখছে না যুক্তরাষ্ট্র। সেক্ষেত্রে তারা যদি ব্রাদারহুডের সঙ্গে সমঝোতা করে বসে তবে মিশরও হাতছাড়া হবে রাশিয়ার।  

পাশাপাশি আফগানিস্তানের তালেবানদের সঙ্গে নিজেদের বিবাদও মিটিয়ে নিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। কারণ দীর্ঘদিন লড়াই করে তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই রণক্লান্ত। এছাড়া বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়লেও সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আফগানদের মনে রয়েছে অতীতের তীব্র ক্ষোভ ও বিদ্বেষ।

পাশাপাশি ভিয়েতনামের উদাহরণ তো রয়েছেই। কারণ ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দশকের পর দশক লড়লেও এখন দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার রাজনৈতিক বাস্তবতায় তারা যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বাণিজ্য সহযোগী, ক্ষেত্রবিশেষে মিত্রও।

সেক্ষেত্রে উত্তর কোরিয়াকে রাশিয়া হয়তো সহায়তা করতে পারে কিন্তু চীন অবশ্যই চাইবে না পিয়ংইয়ংয়ে রাশিয়ার প্রভাব বৃদ্ধি পাক। সেক্ষেত্রে বসে থাকবে না দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপান সহ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য উত্তর কোরিয়া বিরোধী রাষ্ট্রগুলোও।

 
তাই বলা যেতে পারে ক্রিমিয়ায় রুশ আগ্রাসন খুলে দিতে পারে প্যান্ডোরার বক্স, যার পরিণতি কি হবে তা কেউই বলতে পারে না।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে ক্রিমিয়াকে নিজের দখলে নেয়ার বিনিময়ে এত বড় ঝুঁকি রাশিয়া নেবে কি না?

ক্রিমিয়া নিয়ে পুতিনের বেপরোয়া মনোভাব দেখে মনে হচ্ছে তার আসলে হারানোর কিছুই নেই।

তবে পুতিনের হারানোর কিছু না থাকলেও রাশিয়ানদের যে হারানোর অনেক কিছুই আছে তা বলাইবাহূল্য।

বাংলাদেশ সময়: ০১০৭ ঘণ্টা, মার্চ ০৩, ২০১৪ 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।