ঢাকা: বর্ষবরণের উৎসবে নানা ছন্দে মেতেছে গোটা জাতি। উৎসবপ্রিয় বাঙালি জাতি উপলক্ষ পেলেই যে মেতে উঠতে জানে তা আরেকবার প্রমাণ হলো।
সোমবার বৈশাখের প্রথম দিনটিতে বেশিরভাগ রাজধানীবাসীর গন্তব্য ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি প্রাঙ্গণ, চারুকলা অনুষদ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, শাহবাগ মোড়, রমনা ও শিশুপার্কে।
সাতসকালে রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আর চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রাকে পাশ কাটিয়ে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের কথা চিন্তাই করা যায় না।
অবশ্য এবারও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। পুরো রমনা পার্ক আর টিএসসি, চারুকলার মধ্যবর্তী অবস্থানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এবং শিশুপার্ক থাকায় পহেলা বৈশাখের ভোর থেকেই মানুষের ঢল নামে এই এলাকায়। চারদিক থেকে স্রোতের মতো আসতে থাকে বর্ণিল সাজের সকল বয়সী মানুষেরা।
তবে এর মাঝে বিশেষভাবে দৃষ্টিকাড়ে শিশু-কিশোরদের উপস্থিতি।
বর্ণিল পোশাক ছাড়াও তাদের হাতে ও গালে আঁকা বৈশাখী নকশায় শিশুরা যেন আরো বর্ণিল হয়ে ওঠে। মা-বাবা, ভাই-বোনদের হাত ধরে অথবা চাচা-মামাদের কাঁধে চড়ে শিশু-কিশোরদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যায় বৈশাখী উৎসবে।
তবে রমনার বর্ষবরণের চেয়ে শিশুদের কাছে আগ্রহের কেন্দ্র বিন্দুতে ছিল কিন্তু শিশুপার্কই। কেন না বর্ষবরণ করতে শিশুপার্কের এতো কাছে এসে এর রাইডগুলোতে না চড়ে শিশুদের কি আর উৎসব উদযাপন হয়। তাই তো শিশুদের উৎসব উদযাপনে সম্পূর্ণতা আনতে বেশিরভাগ অভিভাবকই তার প্রিয় সন্তানটিকে নিয়ে গেলেন শিশুপার্কে।
তবে তাদের প্রচণ্ড ভিড় সামলে শিশুপার্কে প্রবেশ করতে হয়েছে। পরে পার্কে ঢুকেও যে কোনো রাইডে চড়তে অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘক্ষণ।
এ চিত্র সোমবার সকাল থেকেই দেখা গেছে।
বিশেষ দিনগুলিতে সকাল ১০টা থেকে শিশুপার্ক খুলে দেয়া হয়। শিশু ও অভিভাবকদের উপস্থিতি বিবেচনা করে চলে রাত ১০টা পর্যন্ত।
বিশেষ দিনগুলিতে রাত আটটায় টিকিট বিক্রি বন্ধ করে দেয়া হয়। তবে যে পরিমাণ ভ্রমণার্থী এর মধ্যে পার্কে ঢুকে জান তাদের সবাইকে রাইডে চড়াতে রাত সাড়ে দশটা-এগারটা বেজে যায় বলে জানান শহিদুল হক।
শিশুপার্কের সাপ্তাহিক ছুটি রোববার। এ দিন বাদে প্রতিদিন শিশুপার্ক খোলা হয় বেলা ২টায় আর বন্ধ হয় রাত ৮টায়। শুক্রবার জাতীয় ছুটির দিন হওয়াতে এ দিন বেলা আড়াইটায় খোলা হয় পার্ক চলে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত। এমনটাই জানালেন বিশেষ দায়িত্বে থাকা শিশুপার্কের গেট সুপার মো. শহিদুল হক।
তিনি জানান, বিশেষ দিনগুলিতে সকাল দশটা থেকে খোলার নিয়ম থাকলেও আজ শিশুপার্কের গেট খুলতে একঘণ্টা দেরি হয়েছে।
কারণ জানতে চাইলে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ফকির আলমগীরসহ আরো বেশ কয়েকজন শিল্পী শিশুপার্কের মূল গেটের সামনে মঞ্চ বানিয়ে অনুষ্ঠান করায় আজ গেট খুলতে এক ঘন্টা দেরি হয়েছে। সকাল দশটার মধ্যে তাদের অনুষ্ঠান শেষ করার কথা থাকলেও অনুষ্ঠান চলে বেলা ১১টা পর্যন্ত। এরপর মঞ্চ ভেঙে গেট উন্মুক্ত করতে আরো কিছু সময় লাগে।
শহিদুল জানালেন, সকাল থেকেই অনেক অভিভাবক শিশুদের নিয়ে এসে ফিরে গেছেন। তবে একঘণ্টা বিলম্বে খোলা হলেও ভীড় সমলানো বরাবরের মতো কঠিন হয়ে পড়েছে। ধারণা করা হচ্ছে এই ভীড় সন্ধ্যার পরও অব্যাহত থাকবে।
শিশুপার্কের সবক'টি কাউন্টার থেকে টিকিট বিক্রি করেও কুলিয়ে উঠা যাচ্ছে না বলেও তিনি জানান।
শিশু পার্কের আরেক কর্মচারী জানান, প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৭০ হাজার দর্শনার্থী আসলেও ছুটির দিনগুলোতে এক লাখের বেশি দর্শনার্থী আসেন।
গত পহেলা বৈশাখে প্রায় ছয় লাখ দর্শনার্থী শিশুপার্কে এসেছিল। এবার এর চেয়েও বেশি হবে বলে আশা করছেন তিনি। এবার দর্শনার্থীর সংখ্যা প্রায় ৮ লাখ ছাড়াতে পারে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
তবে পার্কের বেশিরভাগ রাইড পুরাতন এবং বেশ কিছু বিকল থাকায় শিশুরা সেগুলোতে চড়তে পারছে না। আর তাতে বিরক্ত হচ্ছেন অভিভাবকরা। তাছাড়া বিশেষ দিনগুলিতে বরাবরই ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি তৈরী হচ্ছে। এমনই মন্তব্য শিশুদের নিয়ে ঘুরতে আসা অভিভাবকদের।
এ দিন মিরপুরের বেনারশী পল্লী এলাকা থেকে আসাদুজ্জামান তার যমজ দুই সন্তানকে নিয়ে এসেছিলেন পার্কে। তার দুই সন্তানের নাম নিলয় ও নিঝুম। সঙ্গে তার স্ত্রী লাবণীও এসেছেন, তবে প্রচন্ড গরম আর ভুবুজেলা সদ্দৃশ বাশিঁর বিকট শব্দে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন।
এ নিয়ে আসাদুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, পহেলা বৈশাখের উৎসবটা নষ্ট করে দিচ্ছে এসব বাশিঁর শব্দ। আমার ছেলে দুটো এক সময় কাঁন্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে বিকট এই শব্দের ভয়ে। আমাদেরও কান ঝালাপালা হয়ে গেছে।
আসাদুজ্জামান মনে করেন আইন করে এই বাঁশি বা এই জাতীয় বিকট শব্দের যন্ত্র নিষিদ্ধ করা উচিৎ।
তিনি বলেন, শব্দ থেকে নিস্তার পেতেই শেষমেষ ছেলেদের নিয়ে ছুটে এসেছি শিশুপার্কে। কিন্তু এখানেও একই যন্ত্রণা। তাছাড়া অনেকগুলো রাইড নষ্ট থাকায় দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে।
সচল প্রতিটি রাইডের সামনেই অভিভাবক ও শিশু-কিশোরদের দীর্ঘ লাইন। কেউ কেউ বিরক্ত হয়ে চলে যাচ্ছেন। কেই দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ছেন।
রাজধানীর মুগদা এলাকা থেকে মেয়েকে নিয়ে এসেছেন সাবিনা আক্তার। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে এক সময় মেয়েকে কোলে নিয়ে বসেই পড়লেন। এখান থেকে বের হওয়া আরো কষ্টকর জানালেন সাবিনা।
বাস্তব অবস্থা কতটা ভয়ঙ্কর তা শিশু পার্কের ভেতর থেকে বাইরে বের হতে গিয়েই টের পাচ্ছেন ভ্রমণার্থীরা। দুপুর গড়াতেই চারদিকে মানুষের এমন ঢলে যেন পা ফেলার উপায় নেই।
তাছাড়া ধুলা আর শব্দে সব রকমের মারাত্মক দূষণ ঘটছে এই এলাকায়। অনেককে অসুস্থ হয়ে যেতেও দেখা গেছে। এর মধ্যে শিশুরাই বেশি।
ঘুরতে আসা অনেক সচেতন অভিভাবকের মতে, সঠিক ব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনার সুষ্ঠু অভাব, বিকট শব্দ আর মানুষের প্রচণ্ড ভীড়ে শেষ পর্যন্ত বর্ষবরণের এ উৎসব অনেকটাই ম্লান হয়ে যাচ্ছে।
তাদের মত, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি উৎসবের এ সময়টায় পর্যাপ্ত মোবাইল টয়লেট এবং সুপেয় পানির ব্যবস্থা থাকা দরকার। আর তবেই বর্ষবরণ হবে প্রত্যেক বয়সীদের জন্য মহানন্দের।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৪, ২০১৪