বুড়ো লোকটা যাচ্ছে। ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল ডেমোক্রাটিক পার্টির নেতৃত্ব (হোসনি মোবারকের ছেলে গামালসহ) গত রাতে পদত্যাগ করেছে।
বিভ্রান্ত সৃষ্টিকারী মোবারকের নতুন প্রধানমন্ত্রী আহমেদ শফিক গতকাল মিশরের মানুষকে বলা ‘সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসছে’ তাহরির স্কয়ারের বিক্ষোভকারীদের কাছে প্রমাণ করে--এই শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠেছে কার্ডবোর্ড (মোটা কাগজ) দিয়ে। অথচ ৩০ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা ওই লোকটির নির্বাসনের গণদাবি জানিয়ে আসছে গত ১২ দিন ধরে। সেনাবাহিনীর কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ব্যক্তিগতভাবে লাখ লাখ গনতন্ত্রপন্থীদের বাড়ি ফিরে যেতে বললে তারা স্রেফ তা নাকচ করে দেয়।
গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস তার দ্য অটাম অব দি প্যাট্রিয়ার্ক উপন্যাসে হুমকির মুখে একজন একনায়কের আচরণ ও পুরোপুরি নাকচ করে দেওয়ার মনস্তত্ত্বের ছবি এঁকেছেন। গৌরবের সময়ে এই স্বৈরশাসক মনে করেন, তিনি একজন জাতীয় নায়ক। তার দয়ার ও নিরঙ্কুশ শাসনের বিরুদ্ধে রহস্যময় বিদ্রোহের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এতে বিদেশি শক্তির হাত ও গুপ্ত এজেন্ডার ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করেন। এগুলোর ফলেই ‘বিদ্রোহীরা বিদেশি শক্তির (যারা আমাদের দেশকে ভালবাসে না) মাধ্যমে ব্যবহৃত ও পরিচালিত হচ্ছে’ এমন তত্ত্ব খাড়া করেন। এরপর এখন আমি মিশরের মহান লেখক আলা আল-আসওয়ানির বরাত দিয়ে মার্কেসের একটি কথা তুলে ধরছি: ‘ইঞ্জিনের ক্ষমতা পরখ করতে একনায়ক সবই করলেন, কেবল নিজের যা করা উচিৎ সেটা ছাড়া। তিনি ভয়ংকর হয়ে উঠলেন। এরপর তারা যা চাই তিনি তা-ই করতে রাজি হলেন। শেষে তিনি বিদায় নিলেন।
মিশরের হোসনি মোবারক চতুর্থ অংকের শেষভাগে চলে এসেছেন--চূড়ান্ত বিদায়। ৩০ বছর ধরে তিনি ছিলেন জাতীয় নায়ক। ১৯৭৩ সালের যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, বিমান বাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন, স্বাভাবিকভাবেই তিনিই ছিলেন গামাল আবদেল নাসের ও আনোয়ার সাদাতের উত্তরসূরী। এরপর তিনি এবং তার একনায়কী শাসন, পুলিশী রাষ্ট্র, নিপীড়ন ও দুর্নীতি সবকিছুই জনগণের বিক্ষোভের মুখে পড়ে। তিনি এর জন্য তার কাল্পনিক শত্রু আল কায়েদা, মুসলিম ব্রাদারহুড, আলজাজিরা, সিএনএন ও আমেরিকাকে দায়ী করলেন। আর আমরা মাত্র ভয়ংকর দশা উৎরাতে পেরেছি।
বৃহস্পতিবার মোবারকের নিরাপত্তা পুলিশ ২২ জন আইনজীবীকে গ্রেপ্তার করেছে। এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা গ্রেপ্তার হওয়া ও জেলেবন্দী ৬০০ বিক্ষোভকারীদের পক্ষে আইনী লড়াইয়ে সহায়তা করেছেন। দাঙ্গাবিরোধী যেসব পুলিশকে নয় দিন আগে দয়াবশত কায়রোর রাস্তা থেকে প্রত্যাহার করা হলো, তারাই মাদক-উন্মাদ গোষ্ঠীগুলোকে বেতন দেয়। এই গ্যাংস্টাররা সরাসরি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হয়ে কাজ করে--এরাই গত শুক্রবার রাতে তাহরির স্কয়ারে গুলি করে তিনজনকে হত্যা করেছে এবং সকালে ৪০ জনকে জখম করেছে। গত সপ্তাহে ক্রিস্টিয়ান আমানপোরকে দেওয়া মোবারকের কান্নাবিজড়িত সাক্ষাৎকারে তিনি দাবি করেন, তিনি প্রেসিডেন্ট থাকতে চান না। তবে নৈরাজ্য থেকে মিশরকে বাঁচাতে তাকে আরও সাত মাস থাকতে হবে। নাটকের চতুর্থ অংকের পথে এটাই ছিল তার প্রথম ইঙ্গিত।
এই রোমান্টিক বিপ্লব আল-আসওয়ানিকে রাস্তায় টেনে এনেছে। প্রতিদিন বিদ্রোহে অংশ নেওয়ার আগে তিনি তার সব সকালকে ‘সাহিত্যসকাল’ হিসেবে উদযাপন করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। গত সপ্তাহেই তিনি বললেন, একটি বিপ্লব একজন মানুষকে সম্মানিত করে তোলে, যেমনভাবে প্রেমে পড়লে কেউ মর্যাদাবান হয়।
মোবারক যদি আজ অথবা এ সপ্তাহের শেষের দিকে বিদায় নেয়, মিশরীয়রা বিতর্ক তুলবে এই কাগুজে একনায়কের কবল থেকে নিজেদের মুক্ত করতে তাদের কেন এতো সময় লাগল। সমস্যাটা হলো নাসের, সাদাত, মোবারকের (এরপর ওয়াশিংটন যাকেই সমর্থন করুক না কেন) মতো স্বৈরশাসকের অধীনে মিশরীয়রা তাদের পক্ক অভিজ্ঞতার দুটি প্রজন্ম পার করেছে। একজন একনায়কের অপরিহার্য কাজ হচ্ছে তার জনগণকে নির্বোধ বানিয়ে ফেলা। রাজনৈতিকভাবে জনগণকে ছয় বছর বয়সী শিশু হিসেবে দেখা। একজন পুরুষতান্ত্রিক হেডমাস্টারের কথা মান্য করা। জনগণকে দেওয়া হবে ভুয়া সংবাদপত্র, ভুয়া নির্বাচন, ভুয়া মন্ত্রী-আমলা আর অনেকানেক মিথ্যা প্রতিশ্রুতি। তারা যদি মেনে চলে, কেউ একজন মন্ত্রী হতে পারেন আর না মানলে স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে তাদের পেটানো হবে। জেলে ভরা হবে। সহিংস হয়ে উঠলে ফাঁসিতে ঝোলানো হবে।
ব্রিটেনের দৈনিক দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট-এর মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক সংবাদদাতা রবার্ট ফিস্ক। রোববার প্রকাশিত ‘দ্য রং মোবারক কুইটস। সুন দ্য রাইট ওয়ান উইল গো’ প্রবন্ধটির সংক্ষিপ্ত অনুবাদ করেছেন নিউজরুম এডিটর রানা রায়হান।
বাংলাদেশ সময়: ২২২৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৬, ২০১১