ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

ভারতের নন-গ্রাজুয়েট সফলরা

হুসাইন আজাদ, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭১৬ ঘণ্টা, জুন ৪, ২০১৪
ভারতের নন-গ্রাজুয়েট সফলরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ধীরুভাই আম্বানি, শচীন টেন্ডুলকার ও মহেন্দ্র সিং ধোনি

ঢাকা:  সম্প্রতি বেশ আলোচিত হচ্ছে ভারতের নয়া শিক্ষামন্ত্রী স্মৃতি ইরানি নিজেই স্নাতক (গ্রাজুয়েট) নন। সমালোচকরা বলছেন, যে শিক্ষামন্ত্রী নিজেই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারেননি, তিনি কীভাবে ক্রমেই বিশ্ব পরাশক্তি হয়ে ওঠা ভারতের শিক্ষা বিস্তারে নেতৃত্ব দেবেন? কিন্তু সমালোচকদের এ কথা ইতিহাসের বিপরীত, অর্থাৎ দেশের হয়ে নেতৃত্ব দিতে হলে স্নাতক হতে হবে এমন কোনো ধরা-বাধা নেই, বরং স্নাতক না হয়েও দেশকে বিশ্ব আসনে বসিয়েছেন এমন আকাশছোঁয়া ব্যক্তিদের গল্পই বেশি।



সম্প্রতি একটি ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ভারতের সেই ব্যক্তিদের সাফল্যগাঁথা, যারা স্নাতক না হয়েও দেশের হয়ে ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছেন।

প্রতিবেদনে প্রকাশিত দশজন অ-স্নাতক অথচ সফল ব্যক্তিত্বের আকাশছোঁয়ার গল্প এবারের উপস্থাপন।

শচীন রমেশ টেন্ডুলকার
স্নাতক নন, অথচ দেশকে বিশ্ব দরবারে উচ্চ আসনে বসিয়েছেন এমন তালিকা ঘাঁটলে প্রথম দিকেই ‍আসবে শচীন টেন্ডুলকারের নাম। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শতকের শতক পূরণসহ অজস্র রেকর্ডের মালিক এ ক্রিকেট ইশ্বরকে ব্রায়ান লারা, মুত্তিয়া মুরালিধরন, ওয়াসিম আকরামের মতো গ্রেটরাও সেরা বলতে বাধ্য হন।

শচীনের এতোসব অর্জন তাকে তারুণ্যের আদর্শ বানিয়েছে নিঃসন্দেহে। অনেক মা-বাবা স্বপ্ন দেখেন তার ছেলেও শচীনের মতো হোক। কিন্তু কোনো মা-বাবা কি চাইবেন তার ছেলেটিও শচীনের মতো দশম শ্রেণীতেই পাঠ চুকে দিক?

ক্রিকেটের এ বরপুত্র তার ২২ বছরের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে যে বিপ্লব ঘটিয়েছেন সেটা তার শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রশ্নকে অন্ধকারে নিক্ষেপ করেছে এটা নিঃসন্দেহেই বলা যায়।

ধীরুভাই আম্বানি
ধরা যাক, ভারতের দারিদ্র্য জয়ের কোনো গল্পে লেখা আছে, ‘একটি শিশু মা-বাবা আর পরিবারকে সাহায্য করার জন্য বিদ্যালয়ে পাঠ চুকেই তেল শোধনাগারে চাকরি নেয়। একসময় সে অনেক বড় কোটিপতি হয়, প্রতিষ্ঠা করে বিশ্বের অন্যতম সর্ববৃহৎ ব্যবসায় গ্রুপ ‘রিল্যায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ’।

এই গল্পের কাহিনি সত্য ধরা হলে শিশুটি হচ্ছেন ধীরুভাই আম্বানি। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই অভাবের তাড়নায় তাকে পড়ালেখা শিকোয় তুলে ইয়েমেনে চলে যেতে হয়। এরপর তিনি যা করেছেন, সেটা ভারতীয় ডক্টরেট ডিগ্রিধারী ব্যবসায়ীদের জন্যও অনুকরণীয়।

মহেন্দ্র সিং ধোনি
এলাম, দেখলাম, জয় করলাম। বিশ্বজয়ী সেনাপতিদের এ মন্ত্র ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনির সঙ্গে মিল পান অনেকেই। কারণ খুব সোজা, ভারতীয় ক্রিকেট দলে জায়গা পাওয়ার পর তিনি ইতিহাসেও জায়গা করে নিয়েছেন। দলকে জিতিয়েছেন ওয়ানডে বিশ্বকাপ, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, টেস্ট ৠাংকিংয়ে রেখেছেন শীর্ষস্থানে। বলা হচ্ছে, যদি টেস্টের বিশ্বকাপ থাকতো সেটাও দলকে জিতিয়ে ছাড়তেন ‘কুল ক্যাপ্টেন’ ধোনি।

কোটি তরুণী মনের কাঙ্ক্ষিত পুরুষ ধোনি ফোর্বস ম্যাগাজিনের ২০১৩ সালের হিসেব মতে সবচেয়ে বেশি উপার্জনকারী ক্রীড়াবিদদের মধ্যে ১৬তম। ২০১১ সালে তিনি জায়গা পান টাইম ম্যাগাজিনের ১০০ প্রভাবশালী মানুষের তালিকায়।

ভারতের মা-বাবাদের ‍আকাঙ্ক্ষা তার ছেলেও পরবর্তী ধোনি হয়ে উঠুক। কিন্তু এই ধোনির পড়ালেখা কতদূর? না, বিশ্ব আসনে ভারতকে আসীন করা ধোনিও স্নাতক নন। কয়েক বছর আগেই রাঁচির সেন্ট জাভিয়ার কলেজে ভর্তি হলেও শিডিউল ব্যস্ততার কারণে প্রথম সেমিস্টারও কমপ্লিট করতে পারেননি।


প্রিতিশ নন্দী
বহুমাত্রিক গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও পদ্মশ্রী পুরস্কার প্রাপ্ত কবি, নকশাকার, চিত্রকর, চিত্রগ্রাহক ও সাংবাদিক প্রতিশি নন্দী। সম্পাদনা করেছেন দ্য ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অব  ইন্ডিয়া, দ্য অবজারভার অব বিজনেস অ্যান্ড পলিটিকস এবং দ্য সিডনি অবজারভারের মতো প্রভাবশালী পত্রিকা।

টেলিভিশনের মাঠে নামার পর প্রিতিশ বেশ কিছু জনপ্রিয় অনুষ্ঠানও উপস্থাপনা করেন। নির্মাণ করেন ‘প্রিতিশ নন্দী কমিউনিকেশনস’র ব্যানারে চলচ্চিত্র। তার নির্মিত নন্দিত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘হাজারোন খাবোশিন অ্যায়সি’, ‘চামেলী’ এবং সর্বশেষ ফারহান আখতার ও বিদ্যা বালান অভিনীত ‘শাদি কি সাইড ইফেক্টস’।

রুপালি পর্দায় ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়ে পা দেওয়া কিংবা স্বপ্ন দেখা ব্যক্তিদের জন্য বিস্ময়ের খবর হলো এ অঙ্গন কাঁপিয়ে দেওয়া প্রিতিশ অ-স্নাতক।

গৌতম আদানি
ভারতের নয়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঘনিষ্ঠ হিসেবে ইদানীং খবরের শিরোনামে এসেছেন গৌতম আদানি। গুজরাট ইউনিভার্সিটিতে বাণিজ্যে ডিগ্রি নেওয়ার সুযোগ থাকলেও সেটা স্বেচ্ছায় জলাঞ্জলি দিয়ে মুম্বাইয়ে গিয়ে একটি দোকানে হীরা বাছাইকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন আদানি। সেখান থেকে গুজরাটে ফিরে এসে ভাইকে প্লাস্টিকের ব্যবসায় সহযোগিতা করতে থাকেন। ভাইয়ের সঙ্গে মিলে আদানি লিখে ফেললেন নতুন ইতিহাস।

অ-স্নাতক সেই আদানি এখন ‘আদানি গ্রুপ’র মালিক। ফোর্বসের মতে, তার বর্তমান সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৬শ’ কোটি মার্কিন ডলার, ভারতীয় রুপিতে সেটি অংকে লিখলে ৩৫৩,২২০,০০০,০০০! (পঁয়ত্রিশ হাজার তিনশ’ ২২ কোটি রুপি)!

স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করতে পারেননি বলে কি দেশের অর্থনীতিতে পা পিছলে পড়ে গেছেন আদানি?

সুভাষ চন্দ্র
মাত্র ১৯ বছর বয়সে দ্বাদশ শ্রেণীর পড়াশোনা চুকিয়ে উদ্ভিজ তেলের ইউনিটের যাত্রা করেন সুভাষ চন্দ্র। এরপর খাদ্য শস্য রফতানির মাধ্যমে ১৯৮১ সালে এসেল প্যাকেজিং নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্যাকেজিং ব্যবসায় প্রবেশ করেন। তারপর বিভিন্ন ধরনের বিনোদনমূলক পার্ক নির্মাণ করে পর্যটন ব্যবসায় নেমে পড়েন।

সুভাষের সুবাস ছড়ানো এখানেই শেষ নয়, রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত দূরদর্শন টিভির বিপরীতে দেশটির টেলিভিশন শিল্পে নজর দেন আদানি। খোলেন জি টিভি, দ্য হিন্দি জেনারেল এন্টারটেইনমেন্ট চ্যানেল এবং প্রথম বেসরকারি সংবাদভিত্তিক চ্যানেল জি নিউজ।

বিশ্বের ১৩৯টি দেশের ৭০ কোটি মানুষকে বিনোদিত করছে বা খবর জানিয়ে যাচ্ছে আদানির ‘জি এন্টারটেইনমেন্ট’ পরিচালিত ৩৪টি চ্যানেল। তার এসব টিভি চ্যানেলেই কাজ করার জন্য সিভি দিয়ে লাইন দিয়ে রাখছে হাজারো স্নাতক-স্নাতকোত্তর!

৬৩ বছর বয়সী সুভাষের বর্তমান সম্পদের পরিমাণ প্রায় দুইশ’ কোটি মার্কিন ডলার!


জয় আলুক্কাস
১৯৮৭ সালে যখন স্কুল ছেড়ে বাবাকে স্বর্ণ ব্যবসায় সহযোগিতা করার সিদ্ধান্ত নেন তখন কি জয় আলুক্কাস ভেবেছিলেন ভারতের স্বর্ণ খাতই জয় করতে নেমে পড়েছেন তিনি? হয়তো ভাবেননি, কিন্তু আলুক্কাস এখন ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বব্যাপী ৮৫টি দোকান দিয়ে স্বর্ণ ব্যবসায় চালিয়ে যাচ্ছেন।

২০১৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত আলুক্কাসের মোট সম্পদের পরিমাণ ৬৪ কোটি মার্কিন ডলার ছিল। ফোর্বসের মতে, তিনি ভারতের সবচেয়ে সেরা ধনীদের মধ্যে ৯৯তম।

পি এন সি মেনন
১৯৭৬ সালে কোচির হোটেল লবিতে ওমানের রাজপরিবারের প্রতিনিধি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সুলেইমান আল আদাবির সঙ্গে দেখা হয়ে যায় পুথান নেদুবাক্কাত চেন্থামারাক্ষা মেননের। ওই সময় বাবার মৃত্যুর পর থ্রিসার কলেজের পাঠ চুকিয়ে একটি ছোটখাট ব্যবসা খুঁজছিলেন তিনি।

মাছ ধরার নৌকা কিনতে কোচিতে আসা ওমান রাজপরিবারের প্রতিনিধি ব্রিগেডিয়ার সুলেইমানের ভালো লেগে যায় তরুণ পি এন সি মেননকে। তিনি তাকে ডেকে পাঠান শখের মাছ ধরার কাজে তাকে সহযোগিতা করার জন্য।

মেনন কোচি থেকে বাড়ি ফিরে যান এবং একটি ম্যাপ নিয়ে ওমান খুঁজে বের করেন। এরপর ওমানের উদ্দেশে যাত্রা করেন। কিন্তু মেননের সে যাত্রা ছিল স্বপ্নজয়েরর, সেই যাত্রায় সাফল্য পেতে পেতে একসময় ‘সোভা ডেভেলপার্স লিমিটেড’ নামে একটি আবাসন প্রতিষ্ঠানের যাত্রা করে তিনি। এই সোভা ডেভেলপার্সই এখন বিশ্ব আবাসন ব্যবসায় ভারতের হয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে।

ফোর্বসের হিসেব মতে, মেননের বর্তমান সম্পদমূল্য প্রায় একশ’ ত্রিশ কোটি মার্কিন ডলার।

কলেজের পাঠ চুকে চাকরি খুঁজতে নেমে মেনন কি খুব খারাপ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন?

বিনোদ গোয়েনকা
কলেজের পাঠে মন না বসলেও মুম্বাইয়ে গিয়ে ব্যবসায় মনোযোগ দেন বিনোদ গোয়েনকা। এখানে প্রাথমিক সাফল্য শেষে নিজের ‘ডায়নামিকস গ্রুপ’র ব্যবসাকে বাড়াতে শহিদ বাওলার সঙ্গে ‘ডিবি রিয়েলটি’ নামে একটি বড় আবাসন প্রতিষ্ঠান খোলেন বিনোদ।

এরপর? বিনোদ হয়ে গেলেন দেশটির সেরা ব্যবসায়ীদের নেতা! বিনোদের বর্তমান সম্পদমূল্য প্রায় একশ’ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলারেরও বেশি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
অ-স্নাতক হয়েও নোবেলে পেয়ে যাবেন কেউ এটা কারও ভাবনায় থাকে? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্তত সেই বিপ্লবই ঘটিয়েছেন।

ইংল্যান্ডের ব্রিংটনে স্কুলে ভর্তি হলেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাড়িকেই স্কুল বানিয়েছিলেন।

লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজে ভর্তি হলেও গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি সম্পন্ন না করেই ইংল্যান্ড ত্যাগ করেন।

নন-গ্রাজুয়েট রবীন্দ্রনাথ কেবল বাংলা সাহিত্য ও সংগীত জগতের পরিভাষা-ই বদলে দেননি। প্রথম অ-ইউরোপীয় হিসেবে জিতে নেন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারও (১৯১৩)।

ভারতকে বিশ্ব অর্থনীতি-সাহিত্যসহ বিভিন্ন দিক থেকে নেতৃত্ব দেওয়া এই ব্যক্তিদের তালিকা দেখলে কি নেতৃত্বের শর্ত থেকে ‘উচ্চশিক্ষা’ শব্দটি উঠিয়ে দেওয়া যায় না?

বাংলাদেশ সময়: ১৭১৫ ঘণ্টা, জুন ০৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।