ঢাকা: ইরাকের স্বৈরশাসক সাদ্দাম হুসেইনের পতনের পর সন্ত্রাসী সংগঠন আল কায়েদা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ইরাক-সিরিয়ার সীমান্তবর্তী এলাকা ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলে চোরাগোপ্তা হামলা শুরু করে একটি জঙ্গি সংগঠন। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সংগঠনটির হামলার ভয়াবহতা বাড়তে থাকে, বিস্তৃত হতে থাকে পরিচিতিও।
সম্প্রতি ইরাকের উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি শহর আইএসআইএল’র পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় এ অঞ্চলের সার্বিক নীতি ও অবস্থা নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে বিশ্লেষকদের মাথায়। উত্তরও আসছে মাঠ পর্যায় এবং বিশ্লেষকদের পক্ষ থেকে।
আসলে কী ঘটছে ইরাকে এবং কেন? আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইরাকের বর্তমান পরিস্থিতি, এতদঞ্চলের পররাষ্ট্র, কৌশলগত ও সমরনীতি এবং ‘ইসলামী রাষ্ট্রে’র ভবিষ্যৎ বিশ্লেষণ করছে বাংলানিউজ।
কেন ইরাকে এখন এমনটি ঘটছে?
মাঠের সূত্র বলছে, একদশক ধরে যুদ্ধরত সুন্নিপন্থি সংগঠন আইএসআইএল রণক্ষেত্রে বিভিন্ন দিক থেকে সুবিধা নিয়ে আসছে। তবে এখন প্রধানত দু’দিক থেকে সুবিধা নিচ্ছে তারা।
প্রথমত, শিয়া সম্প্রদায়ের প্রধানমন্ত্রী নূরি আল মালিকির নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে স্থানীয় সুন্নি সংখ্যালঘুদের অসন্তোষের মাত্রা বৃদ্ধি করে সেটির সুবিধাভোগ করছে। দ্বিতীয়ত, শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের নেতৃত্বাধীন সিরিয়া সরকারের বিরুদ্ধে ওই অঞ্চলের সুন্নি গ্রুপগুলোর লড়াই উস্কে দিয়ে এ অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের মাত্রা বাড়িয়ে সেটি থেকেও সুবিধা ভোগ করছে।
এছাড়া, প্রধানত ইরাকে লড়াই করলেও সিরিয়া রাষ্ট্রের ভাঙনকে কাজে লাগিয়ে এখন দেশটির সীমান্ত অতিক্রম করে সেখানেও ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় লড়াই করছে আইএসআইএল। সেক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে বলা যায়, ২০০৩ সালে সাদ্দামের পতনের পর আইএসআইএল’র শক্তি যেমন ছিল, ২০১১ সালের মার্চে সিরিয়া অশান্ত হওয়ার পর সে শক্তি কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়।
ইরাকের মসুল, তিরকিত ও বাজি শহর জঙ্গিদের এতো দ্রুত দখলের কারণ জানতে গিয়ে পাওয়া যায় চমকপ্রদ তথ্য। সূত্রগুলো বলছে, এসব অঞ্চল সুন্নি নিয়ন্ত্রিত, আর সুন্নিরা অন্তত এই মুহূর্তে মনে করছেন আগে থেকে বঞ্চিত হলেও শিয়াপন্থি প্রধানমন্ত্রী মালিকি বর্তমানে তাদের প্রধান হুমকি। পাশাপাশি সুন্নি সম্প্রদায়ের সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হুসেইনের সরকারের কর্মকর্তারা জঙ্গিদের এ লড়াইয়ে মদত যোগাচ্ছেন বলেও আলামত স্পষ্ট হচ্ছে।
ইরাক কি ভাঙছেই?
ইরাক কি ভাঙনের পথেই? চলমান গৃহযুদ্ধ এ প্রশ্নটি আরও উস্কে দিয়েছে। আর উত্তরে ‘হ্যাঁ’-ই উচ্চারিত হচ্ছে বেশি।
এক দশকেরও বেশি আগে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আশঙ্কা করা হয়েছিল, ইরাক তিনটি পৃথক অঞ্চলে পরিণত হবে। একটি হবে শিয়া অধ্যুষিত অঞ্চল; এ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করবে বাগদাদ, এটি গঠিত হবে দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলীয় ইরান সীমান্ত এলাকা নিয়ে। দ্বিতীয়টি হবে সুন্নি বিচ্ছিন্নতাবাদী অধ্যুষিত অঞ্চল; পশ্চিম ইরাক ও দেশটির কিছু উত্তরাঞ্চলীয় এলাকা নিয়ে গঠিত হবে এ অঞ্চল। আর তৃতীয়টি হবে কুর্দি অঞ্চল; এটি গঠিত হবে পতিত স্বৈরশাসক সাদ্দামের স্বপ্নের আরব জনপদ ইরবিল, কারকুক ও ইরাকের উত্তরাঞ্চল নিয়ে।
যেহেতু সুন্নি অধ্যুষিত অঞ্চলে আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা অনেক বেশি স্পষ্ট হয়ে গেছে, সেহেতু অন্য দু’টি অঞ্চলে ভিন্ন শাসন আসার আশঙ্কাও নাকচ করা যাচ্ছে না, বরং সে আশঙ্কাই সত্যি হতে চলেছে!
ইরাকের নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা কী?
কেবল প্রশাসনই নয়, দুর্নীতি ও সাম্প্রদায়িক বিভাজন ছড়িয়ে পড়েছে ইরাকের নিরাপত্তা বাহিনীর শিরা-উপশিরায়ও। সূত্র বলছে, দুর্নীতি ও অনৈক্য নিরাপত্তা বাহিনীতে এমন আকার নিয়েছে যে, কেবল গুটিসংখ্যক সামরিক কর্মকর্তাই বাগদাদ সরকারের প্রতি আনুগত্যশীল বলে অভিযোগ রয়েছে।
রাষ্ট্র ভাঙার উপক্রম হলে সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সামরিক বাহিনীর জোর প্রচেষ্টা থাকার কথা থাকলেও ইরাকে রহস্যময়ভাবে নিশ্চুপ থাকছে তারা।
মসুল ও আনবারের মতো এলাকায় জঙ্গিরা সুন্নি সৈন্যদের পক্ষ থেকে আলাদা সুবিধা ভোগ করেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া, সুন্নি সম্প্রদায় থেকে সামরিক বাহিনীতে কর্মরত সৈন্যদের স্বসম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে পরিবারের পক্ষ থেকে অনুৎসাহিত করা হয়। আর পরিবারকে এ ব্যাপারে চাপ দিয়ে থাকে আইএসআইএল নিয়ন্ত্রিত স্থানীয় ছোট ছোট সংগঠনগুলো।
অপরদিকে, পুলিশসহ বেসামরিক বাহিনীগুলোয় মূলত স্থানীয় বাসিন্দাদেরই প্রাধান্য রয়েছে। এ হিসেবে সুন্নি অধ্যুষিত অঞ্চলের পুলিশসহ বেসামরিক বাহিনী পরিবার ও স্থানীয় চাপে সরকারের পক্ষে অস্ত্র ধরতে অনুৎসাহী হয়। তাছাড়া, স্বজাতির বিরুদ্ধে বন্দুক ধরায় জঙ্গিরা এক পুলিশ কর্মকর্তার শিরশ্ছেদ করে কয়েকভাগে বণ্টনের দৃশ্য ধারণ করে অনলাইনে ছেড়ে দেয়। জঙ্গিদের এ ধরনের সামরিক কৌশলও বেসামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করে চলেছে।
কীভাবে বিদ্রোহীরা এতো দ্রুত এ অবস্থানে আসতে পারলো?
যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মতে, আইএসআইএলভুক্ত প্রায় ১০ হাজার যোদ্ধা ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠায় লড়াই করছে।
সংগঠনটির সমরনীতি এখনও রহস্যেই থেকে গেছে। তবে, আইএসআইএল সদস্যরা স্থানীয়দের মন জয়ে বেশ ধূর্ততার সঙ্গেই কাজ করছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় সূত্র।
আইএসআইএল নিয়ন্ত্রিত সিরিয়ার কিছু অঞ্চলে সংগঠনটির আদর্শ ও উদ্দেশ্য একেবারেই খোলাসা। ইতোমধ্যে তারা কঠোর ইসলামী আইন প্রয়োগ করতে শুরু করেছে, গান নিষিদ্ধ করছে। তাদের নিয়ন্ত্রিত রাক্বা শহরের প্রধান চত্বরে অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখিও করা হচ্ছে বলে জানা যায়। তাদের এ নীতি কট্টরপন্থি সুন্নিদের কাছ থেকে সহানভূতি লাভে বেশ সহায়ক হয়েছে।
অপরদিকে, সুন্নি অধ্যুষিত ইরাকের বঞ্চিত ও অবহেলিত এলাকায় আইএসআইএল নিজেদের নূরি আল মালিকি সরকারের বিরোধী এবং সুন্নিদের ত্রাণকর্তা হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করছে। শেষ পরিস্থিতি বলছে, তাদের এ প্রচেষ্টাকে সহজেই গ্রহণ করে চলেছে স্থানীয়রা।
এ যুদ্ধে কুর্দিরা কী ভূমিকায়?
ইরাকের সুন্নিদের সিরিয়ার সুন্নিরা সামরিক সহযোগিতা দিয়ে গেলেও নূরি আল মালিকি সরকারকে পেছন থেকে সহযোগিতা করে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাবিরোধী যুদ্ধে লড়ছে ইরাকেরই উত্তরাঞ্চলের স্বাধীন উগ্রপন্থি একটি কুর্দি গ্রুপ। তাদের ভূমিকা অবশ্য দৃশ্যত ‘সংঘাতপূর্ণ’। সুন্নিদের বিরুদ্ধে লড়লেও তারা শিয়া সম্প্রদায়কেও কুর্দি অধ্যুষিত অঞ্চল দখলে লালসাপূর্ণ বলে মনে করে।
বলা বাহুল্য, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলে তো কুর্দি গ্রুপটিকে অনেক মাশুল গুণতে হবেই, নূরি আল মালিকিরা শাসনভারে থেকে গেলেও কুর্দিদের কোনো লাভ নেই।
ইরানের অবস্থান কী?
ইরাকের গৃহযুদ্ধ নিয়ে ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রৌহানি ইতোমধ্যেই বিস্ফোরক মন্তব্য করে বলেছেন, ‘আইএসআইএল বর্বর। ’ পাশাপাশি দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেছেন, ইরাককে সহায়তা করতে তার দেশ প্রস্তুত এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রণাঙ্গণে লড়তেও প্রস্তুত।
যদিও তেহরান ইতোমধ্যে বাগদাদগামী সকল ফ্লাইট স্থগিত করেছে এবং সীমান্তে নিরাপত্তা বাড়িয়েছে, তথাপি স্বসম্প্রদায় নিয়ন্ত্রিত বাশার আল-আসাদ ও নূরি আল মালিকির সরকারকে রক্ষা করতে সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখার চেষ্টাই করবে শিয়া সম্প্রদায় নিয়ন্ত্রিত ইরান সরকার।
আইএসআইএল’র চূড়ান্ত লক্ষ্যে আতঙ্কিত মধ্যপ্রাচ্য?
‘ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড দ্য লেভ্যান্ট’ বলা হলেও সংগঠনটি ‘ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া’ নামেও পরিচিত। গ্রুপটির প্রধান উদ্দেশ্য, ইরাক ও বৃহত্তর সিরিয়াসহ এতদঞ্চলে মধ্যযুগীয় খেলাফত শাসন প্রতিষ্ঠা। তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী, কেবল ইরাক-সিরিয়াতেই এ লড়াই থেমে থাকবে না, দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্ক, এমনকি ভূমধ্যসাগরবর্তী মিশরের দিকেও খেলাফত রাষ্ট্রের বিস্তারে লড়াই করবে আইএসআইএল।
সুন্নিপন্থি এ সংগঠনটির এমন উত্থানে তাই কেবল তুরস্ক, জর্ডান, লেবানন ও মিশর নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যকেই নতুন করে হিসাব-নিকাশ কষতে হবে। নাক ডেকে ঘুমানোর অবকাশ নেই ইসরায়েল বা তার মিত্র যুক্তরাষ্ট্রেরও!
বাংলাদেশ সময়: ২২১৫ ঘণ্টা, জুন ১৪, ২০১৪