ঢাকা: নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডাম শহরতলীর একটি বাড়ির সদা উৎফুল্ল ছেলে মিগেল পান্ডুবিনাতা ক’দিন ধরেই মাকে বলে উঠছিল, ‘মা, আমি কি তোমাকে জড়িয়ে ধরতে পারি, তোমার বুকে মুখ গুজে ঘুমুতে পারি?’
সামিরা কালেহর পরম আদরে দু’হাত বাড়িয়ে দেন ১১ বছর বয়সী প্রিয় কলিজার টুকরো সন্তানের দিকে। তাকে জড়িয়ে বুকে আগলে নেন।
জন্মলগ্ন থেকেই উচ্ছ্বাসী মিগেল ক’দিন ধরে কীসের ভয়ে যেন ভীত, কেমন যেন চুপটি মেরে থাকে। উদ্ভট সব প্রশ্ন করে যাকে তাকে, মৃত্যু নিয়ে-আত্মা নিয়ে-ঈশ্বর নিয়ে।
১৭ জুলাই সকালে মিগেল ও তার বড় ভাই শাকাকে এয়ারপোর্টে এগিয়ে দিয়ে আসার কথা সামিরার। দুই ভাই নিজেদের নানীকে দেখতে প্রথমবারের মতো ইন্দোনেশিয়ার বালিতে যাবে। মাধ্যম মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের এমএইচ১৭ নং ফ্লাইট।
রুপোলি স্যুটকেসে যাবতীয় কাগজপত্র প্রস্তুত এবং বালিতে প্রিয় জেট স্কি ও সার্ফিং খেলা অপেক্ষা করছে বলে উচ্ছ্বাসী ও ভ্রমণপিপাসু মিগেলের আন্দোলিত হওয়ার কথা থাকলেও তার চোখে যেন কীসের ডর ভর করছিল।
ফ্লাইটে চড়ার আগের দিন বিকেলে ফুটবল খেলার সময় মিগেল হুট করেই সবাকে হতভম্ব করে জিজ্ঞেস করতে লাগলো, ‘আচ্ছা, তোমরা কীভাবে মরতে চাও? আমাকে যদি সমাহিত করা হয় তবে আমার দেহের কী হবে? আমার আত্মা যদি ঈশ্বরের কাছে চলে যায়, তবে কি আমি কিছু অনুভব করবো না?’
সামিরা প্রিয় সন্তানকে এসব উদ্ভট চিন্তা ঝেড়ে ফেলতে বলে বুকে জড়িয়ে নেন।
নিজের সবচেয়ে বড় ‘ভ্রমণে’র আগে ঘুমানোর সময় মায়ের আলিঙ্গন ছাড়তে চাইছিল না মিগেল।
সামিরা বলেন, ‘সে আমাকে খুব মিস করছিল। তাই আমি তাকে বুকে জড়িয়ে নিলাম এবং সারারাত পরম মমতায় আকড়ে রাখলাম। ’
১৭ জুলাই সকালে সামিরা তার বান্ধবী অ্যানকে নিয়ে প্রিয় দু’ সন্তানকে এয়ারপোর্টে এগিয়ে দিতে যান। যাত্রাপথে সামিরা ও অ্যান মিগেলকে উৎফুল্ল রাখার চেষ্টা করছিলেন এবং বালির মজার মজার খেলা ও পর্যটন স্পটগুলোর কথা বলছিলেন। টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে প্রথম বর্ষ শেষ করা ১৯ বছর বয়সী শাকাও যাত্রাপথে মিগেলের ওপর সার্বক্ষণিক চোখ রাখার কথা বলছিলেন। চলতি ফ্লাইটে টিকিট না পাওয়ায় পরের দিনের আরেকটি ফ্লাইটে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করা মিগেল-শাকার ভাই ১৬ বছর বয়সী মিকাও সহোদরদের সঙ্গে পরের দিন মিলিত হওয়ার কথা বলছিল। কিন্তু ভীষণ উদাস দেখাচ্ছিল মিগেলকে।
এয়ারপোর্টে গিয়ে সামিরা তার সন্তানদের লাগেজগুলো ভালভাবে পরখ করছিলেন। তখন শাকা বুঝতে পারলেন, তার মোজা আনা হয়নি। মা আশ্বাস দিলেন, মোজা কিনে পরের দিন মিকার মাধ্যমে পাঠিয়ে দেবেন।
তারপর সামিরা, অ্যান ও মিকা কাস্টমসের বাইরে চলে যান। দুই ভাই মাকে জড়িয়ে ধরে বিদায় জানিয়ে পাসপোর্ট কন্ট্রোল বিভাগের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো।
হঠাৎ মিগেল পেছনে ছুটতে থাকলো, কাস্টমসের বাইরে এসে জড়িয়ে ধরলো মাকে। এয়ারপোর্টের সবাই তখন হতভম্ব।
মিগেল বলতে থাকলো, ‘মা আমি তোমাকে খুব মিস করতে যাচ্ছি। যদি উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হয়, তবে কী হবে মা?’
মা বিস্মিত হয়ে ছেলেকে ধমকালেন, ‘কী বলছো এসব, এভাবে বলো না বাবা, সবকিছু ঠিক থাকবে। ’
শাকা বারবার মা ও অ্যানকে কথা দিচ্ছিল, ‘আমি মিগেলের প্রতি লক্ষ্য রাখবো, সে আমার প্রাণের ভাই। ’
অ্যান-মিকাসহ এয়ারপোর্টের অন্য যাত্রীদের কাছ থেকে সান্ত্বনা পেয়ে মিগেল ভাইয়ের হাত ধরে আবার পাসপোর্ট কন্ট্রোল বিভাগের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলো। কিন্তু বারবার পেছন ফিরে চাইছিল, যেন তার বড় বড় বড় বাদামি চোখ দু’টোয় অশ্রু ছলছল করছিল। একসময় দু’ভাই মায়ের চক্ষুর অন্তরালে চলে গেলো।
মিগেল ও শাকাসহ ২৯৮ আরোহী নিয়ে ১৭ জুলাই দুপুর ১২টা ১৫ মিনিটে উড্ডয়ন করলো ফ্লাইট এমএইচ১৭। দীর্ঘ ১১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট পর তাদের কুয়ালালামপুরে অবতরণ করার কথা।
কিন্তু দুই ঘণ্টার বেশি উড়তে পারলো না মিগেল-শাকাসহ ২৯৮ আরোহীকে বহনকারী উড়োজাহাজটি।
সামিরা এয়ারপোর্ট থেকে ফেরার সময় তখন শাকার জন্য মোজা কিনছিলেন, হঠাৎ ফোন করে কেঁদে উঠলেন তার বান্ধবী অ্যান। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘তুমি কোথায়? তোমার কলিজার টুকরোদের বহনকারী উড়োজাহাজটি তো বিধ্বস্ত হয়ে গেছে!’
সামিরা তখন পুরো বিশ্ববাসীর কথাও বিশ্বাস করতে চাইছিলেন না। ‘কী বলছো’ বলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
ঘণ্টাকয়েক পর বাসায় বসে চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে উঠছিলেন সামিরা, ‘বাবা, তোর কথা আমি শুনলাম না! বাবা, তুই কেন আমাকে অবাক করে দিয়ে ফ্লাইট ছেড়ে চলে আসতে পারলি না। ’
সামিরা এমন চিৎকার করে মিগেল-শাকাকে ডাকতে চাইলেও বুঝতে পারছিলেন, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার হওয়া হবে না শাকার, গো-কার্ট রেস ড্রাইভার হওয়া হবে না মিগেলের! তারা চলে গেছে লাশের মিছিলে!
মৃত্যুর সঙ্গে আগ থেকে পরিচিত হয়েই আলিঙ্গন করলো মিগেল, সঙ্গী পেলো প্রিয় ভাইকে!
বাংলাদেশ সময়: ২২১৫ ঘণ্টা, জুলাই ২৩, ২০১৪