ঢাকা: শুক্রবার ভারতের ৬৮তম স্বাধীনতা দিবসে নয়াদিল্লির লাল কেল্লা ময়দানে ভাষণ দেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
কোনো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠানের বুলেটপ্রুপ মঞ্চে দেওয়া ভাষণে মোদী সার্কভুক্ত দেশসহ বিশ্বব্যাপী সহযোগিতা বাড়ানোর ব্যাপারে কথা বলেন।
ঐতিহাসিকভাবে এই অনুষ্ঠান খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের (ভিআইপি) জন্য বরাদ্দ থাকলেও এবারই মোদীর ভাষণ শুনতে লাল কেল্লা ময়দানে আসন নেওয়ার সুযোগ পান ১০ হাজার সাধারণ মানুষ।
ভাষণের শুরুতেই নিজেকে ‘প্রধান সেবক’ হিসেবে উল্লেখ করে মোদী বলেন, ‘আমি আপনাদের কথা দিতে পারি, আপনারা যদি ১২ ঘণ্টা কাজ করেন, আমি করবো ১৩ ঘণ্টা, আপনারা যদি ১৪ ঘণ্টা কাজ করেন, আমি করবো ১৫ ঘণ্টা! কেন? কারণ আমি প্রধানমন্ত্রী নই, প্রধান সেবক। ’
ঐতিহাসিক এই ময়দানে ছোট হাতার কুর্তা, লাল পাগড়ি ও সাদা পাজামা পরিহিত মোদী যা বলেছেন তা বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য নিম্নে সংক্ষিপ্তাকারে উপস্থাপিত হলো।
*প্রধানমন্ত্রী নয়, আমি এখানে এসেছি প্রধান সেবক হিসেবে।
*এই দেশ রাজনীতিক, রাজা বা সরকারের হাতে গড়া নয়; এটা কৃষক, শ্রমিক, যুবক, মা ও বোনদের রক্ত-ঘামে গড়া। এ দেশ এগোচ্ছে এই লোকদেরই কঠোর পরিশ্রমে।
* হতদরিদ্র পরিবার থেকে আসা এক বালক লাল কেল্লায় আজ জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছে- এটা ভারতের সংবিধানের জন্য গর্বের বিষয়।
*প্রাক্তন কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারগুলো দেশের উন্নয়নে কাজ করেছে। আমি প্রাক্তন সকল সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।
*আমরা একসঙ্গে চলবো, কাজ করবো, উন্নয়ন করবো। এই মন্ত্রেই আমাদের এগোনো উচিত। ভারতবাসীকে এই একটি লক্ষ্যে একটি ইচ্ছায় একটি সিদ্ধান্তে পথ চলতে হবে।
* আমি এই ত্রিরঙা পতাকার তলে দাঁড়িয়ে ভারতবাসীকে নিশ্চিত করতে চাই, আমি এ দেশের উন্নয়নে নিজের সর্বোচ্চ উজাড় করে কাজ করবো।
*আমি দিল্লিতে বহিরাগত। কিন্তু দিল্লির একজন বহিরাগত গত দু’মাসে এখানকার ভেতরের অবস্থা প্রত্যক্ষ করেছে।
*আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, সরকারি কর্মকর্তারা চাকরি করছেন না, তারা জনসেবা দিচ্ছেন।
*চাপরাশি থেকে শুরু করে মন্ত্রিপরিষদ সচিব-প্রত্যেক সরকারি কর্মকর্তাই জনসেবায় প্রতিযোগী।
*আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিতিত্তে সামনে যেতে চাই না, মতৈক্যের ভিত্তিতে এগোতে চাই।
*আমি দেখেছি সরকারের ভেতরে অনেকগুলো সরকার রয়েছে। সেসব সরকার পরস্পর লড়াইয়ে রত। এভাবে লড়াই করলে আমরা দেশের জন্য কাজ করবো কীভাবে?
* স্বাধীনতাযোদ্ধাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নেই আমাদের দেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। এটা আমাদের দায়িত্ব।
*যখন ধর্ষণের খবর শুনি তখন আমাদের মাথা নত হয়ে যায়। যারা ধর্ষণ করে তারা নিশ্চয় কারও না কারও সন্তান। নষ্ট পথে যাওয়ার আগে অবশ্যই ছেলেদের থামানো উচিত। যখন কোনো মেয়ে ১২ বছর বয়সেও বাইরে যেতে চায়, তখন তাকে জেরা করে জানতে চাওয়া হয় ‘তুমি কোথায় যাচ্ছো?’ কিন্তু যে মা-বাবা তার মেয়েকে এ প্রশ্ন করেন, তারা কি তাদের ছেলেকেও এই প্রশ্ন করেন? আমি চিকিৎসকদের প্রতি আহ্বান জানাবো, মাতৃগর্ভে কোনো কন্যাভ্রুণকে হত্যা করবেন না। কমনওয়েলথ গেমসে ২৯ জন মেয়ে পদক জিতেছে। ‘আমি এমনও পরিবার দেখেছি, যেখানে পাঁচ ছেলের চেয়ে এক মেয়েই মা-বাবার সেবাযত্ন করেছে বেশি, মা-বাবাকে বেশি সন্তুষ্ট রেখেছে। ’ আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। তবে ছেলে-মেয়েদের ভুল-সঠিক বোঝানোর দায়িত্বও আমাদের মা-বাবাদের রয়েছে। সন্তানদের ভুল পথ থেকে ফেরানোর দায়িত্বও মা-বাবাদের।
*সহিংসতার রাস্তা পরিহার করুন। ব্রাদারহুডের (মিশরের নিষিদ্ধ ঘোষিত মুসলিম ব্রাদারহুড) পরিণতি ভাবুন এবং দেশের জন্য কাজ করুন।
*বর্ণবাদী ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়।
*বন্দুক দিয়ে মাটি লাল করা যায় কিন্তু কোদাল দিয়ে মাটি সবুজ করা যায়।
*যদি আমরা ১২৫ কোটি জনগণ একসঙ্গে কাজ করি, তবে ভারত ১২৫ কোটি ধাপ এগিয়ে যাবে।
*আমাদের কৃষকরা ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে আত্মহত্যা করেন। আমরা আমাদের দরিদ্র কৃষকদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে তাদের জন্য এক লাখ রুপির বিমা সুনিশ্চিত করতে চাই।
*বিশ্ববাসী আসুন, ভারতে বিনিয়োগ করুন। আমাদের প্রত্যেক খাতেই দক্ষ ও মেধাবী জনশক্তি রয়েছে। এখানে উৎপাদন করে আপনাদের যেখানে ইচ্ছা বিক্রি করুন।
*আমি আমাদের যুবসমাজকে আহ্বান জানাবো, আমরা এমনভাবে পণ্য তৈরি করতে থাকবো, যেন বিশ্ব দরবারে ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ স্লোগানটি শুনতে পাই।
*আমরা এমন পণ্য তৈরি করবো যেটাতে কোনো খুঁতও থাকবে না, যেটা পরিবেশের জন্য হুমকিও হবে না।
*বিশ্ব একসময় আমাদের মনে করতো এ দেশ সাপুড়ে ও জাদুকরের। কিন্তু আমাদের তরুণ প্রজন্ম তাদের তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) দক্ষতা দেখিয়েছে। আমি এখন ডিজিটাল ভারতের স্বপ্ন দেখি।
*আমরা ডিজিটাল ভারত গড়তে চাই। আমরা ই-গর্ভন্যান্সের মাধ্যমে ভালোভাবে সরকার পরিচালনা করতে চাই। ই-গর্ভন্যান্স সহজ ও কার্যকরী গর্ভন্যান্স।
*বিশ্বে পরিবর্তন এসেছে। ঠিক এসময়ে ভারত এক কোণে বসে থাকতে পারে না। ভারতবাসীকে তাদের ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
*আমরা ইলেকট্রনিক পণ্য আমদানি করি। কিন্তু আমরা যদি স্থানীয়ভাবেই এসব প্রস্তুত করি, তবে আমাদের দেশ লাভবান হবে।
*আমি যখন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিই, তখন আমার প্রথম পদক্ষেপ ছিল পরিচ্ছন্নতা। অনেকে এতে বিস্মিত হয়েছিল। কিন্তু আমরা যদি আমাদের দেশকে পরিচ্ছন্ন রাখতে পারি কেউ এটাকে বাইরে থেকে এসে নষ্ট করতে পারবে না। আমি জানি, লাল কেল্লার ভাষণে নোংরা শৌচাগার নিয়ে কথা বলায় আপনারা কী মনে করছেন। কিন্তু আমি দরিদ্র পরিবার থেকে এসেছি বলে এতো স্বাচ্ছন্দ্যে বলতে পারছি।
*প্রত্যেক বাড়ির মতো সব স্কুলেই শৌচাগার থাকা উচিত। স্কুলে ছেলে-মেয়েদের জন্য আলাদা শৌচাগার নির্মাণ করতে হবে। আমি সকল সংসদ সদস্যকে শৌচাগার তৈরির জন্য এক বছরের তহবিল ব্যবহারের অনুরোধ করছি।
*২০১৯ সালে মহাত্মা গান্ধীর ১৫০তম জন্মদিন। দেশকে পরিচ্ছন্ন করে গড়ে তোলার মাধ্যমেই পরিচ্ছন্নতাপ্রিয় গান্ধীজীর প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান দেখানো যেতে পারে।
* আমাদের মেয়েদের বাইরের শৌচাগারে যাওয়ার জন্য অন্ধকার নামা (রাত) পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়, এটা অনেক লজ্জার। আমরা কি তাদের নিরাপত্তার জন্য ঘরের পাশেই বা ঘরসংলগ্ন শৌচাগার নির্মাণ করতে পারি না?
*প্রধানমন্ত্রী ও এমপিদের নামে অনেক প্রকল্প হয়। আজ আমি সংসদের নামে একটি প্রকল্পের ঘোষণা দিচ্ছি। একটা গ্রামীণ প্রকল্প হবে, নাম সংসদ আদর্শ গ্রাম যোজনা। এই প্রকল্পের আওতায় ২০১৬ সালের মধ্যে কমপক্ষে একটি গ্রামকে আদর্শ গ্রামে পরিণত করবেন প্রত্যেক এমপি। পাঁচ বছর পর পাঁচটি গ্রামকে আদর্শ গ্রামে পরিণত করবেন তারা।
*ভারতকে উন্নত করতে হলে গ্রামকে উন্নত করতে হবে।
*পরিকল্পনা কমিশন নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। একসময়ের চাহিদার প্রেক্ষিতেই কমিশনটি গঠিত হয়েছিল। দেশ পরিবর্তন হয়েছে। সময় পরিবর্তন হয়েছে। কমিশনেরও পরিবর্তন দরকার। পরিকল্পনা কমিশনকেও আমরা বিদায় দিচ্ছি।
*যদি রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই, তবে রাজ্যগুলোকে এগিয়ে নিতে হবে। কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যগুলোর যোগাযোগ রক্ষার জন্য শিগগিরই নতুন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হবে।
*মাঝে মাঝে পুরোনো বাড়ি নির্মাণে প্রচুর খরচ হয়। তার চেয়ে নতুন বাড়ি নির্মাণ ভালো।
*আমরা স্বাধীনতার জন্য একসঙ্গে সংগ্রাম করেছিলাম। আমাদের কোনো সরকার ছিল না, অস্ত্রশস্ত্র ছিল না। কোনো ধরেনর অস্ত্র ছাড়াই বিশ্বের বড় একটি শক্তিকে পরাজিত করেছিলাম আমরা। এখন দারিদ্র্যকে হারাতে হবে আমাদের। বিশ্ববাসীর সঙ্গে আমাদের লড়তে হবে।
* দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থাভুক্ত (সার্ক) দেশগুলোকে (বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, ভুটান, ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা) নিয়ে একসঙ্গে কাজ করে আমরা বিশ্বপরাশক্তি হয়ে উঠতে পারি। সার্কভুক্ত দেশগুলো দারিদ্র্য দূরীকরণে একসঙ্গে কাজ করতে পারি।
বাংলাদেশ সময়: ২২০৮ ঘণ্টা, আগস্ট ১৫, ২০১৪