পোটস্ডাম: গেল শুক্রবার বিকেলে চায়ের আসরে বসে কথা প্রসঙ্গে বলে ফেললাম, পুরনো ধাঁচের বাড়ি-ঘর আর স্থাপনা আমার খুব ভাল লাগে। অমনিই আমাদের কোর্স অ্যাসিস্ট্যান্ট মুনিয়া লাফিয়ে উঠল।
সানসুসি প্রাসাদ বার্লিনের কাছের শহর পোটস্ডামে অবস্থিত। রাজা দ্বিতীয় ফ্রেডেরিখের গ্রীষ্মকালীন অবকাশ যাপনের জন্য তৈরি হয় বিখ্যাত এ প্রাসাদটি।
রোববার সকাল সকাল ট্রেনে উঠে পড়লাম ১৫/২০ জনের দলটি। প্রায় দেড় ঘণ্টা ট্রেন আর বাস জার্নির পরে আমরা পৌঁছে গেলাম স্যানসুসিতে।
বাস থেকে নেমেই ভীষণ ভালো লাগল। শহরের কোলাহল থেকে বের হয়ে প্রকৃতির বুকে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। জায়গাটা আসলেই খুব সুন্দর। এখানে আসার পর এই প্রথম আমি সবুজ গাছ আর ফুল দেখলাম।
সবুজ বনের মাঝে বিশাল একটি ভবন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ভবনটি তৈরি করা হয়েছিল ১৭৬৩ থেকে ১৭৬৯ সালের ভেতরে। অথচ বয়সের ভারে এখনও নুয়ে পড়েনি। অতীতের সব গৌরব নিয়ে এখনও ঠায় দাঁড়িয়ে।
ভবনটির বিভিন্ন ঘর এবং স্থানের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিল ব্রিজিট, একজন ব্রিটিশ গাইড।
সানসুসি রাজা ফ্রেডেরিখ দ্য গ্রেটের গ্রীষ্মকালীন অবকাশযাপন কেন্দ্র। রাজার একান্ত ইচ্ছায় ১৭৪৫ থেকে ১৭৪৭ সালের মধ্যে জর্জ ওয়েনজস্লাউস নোবেলসড্রফ ভবনটির ডিজাইন করেন। নাম রাখা হয় সানসুসি, যার অর্থ নিশ্চিন্ত থাকা। এটিই প্রমাণ করে ভবনটি ছিল নিছকই অবকাশযাপন কেন্দ্র, সেই অর্থে কোনও রাজপ্রাসাদ নয়।
এতে রয়েছে মাত্র ১০টি কক্ষ। স্থান নির্বাচন এবং নকশার দিক দিয়ে বিচার করলে এটি মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির যে চিরন্তন মেলবন্ধন তারই পরিচয় বহন করে।
প্রধান কক্ষটির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এর নকশাদার দখিনা জানালাগুলি। এটি সাধারণত ব্যবহৃত হতো রাজার সঙ্গে দর্শনার্থীদের অপেক্ষাগৃহ হিসেবে।
অন্যান্য ঘর গুলোর মধ্যে রয়েছে চারটি অতিথি কক্ষ। যার একটি ব্যবহৃত হতো রানীর কাছে আগত নারী অতিথিদের জন্য।
একটি খাবার ঘর, একটি পড়ার ঘর, ঠিক তার পাশেই রয়েছে বিশাল লাইব্রেরি। এখানে রয়েছে প্রায় ২১ হাজার গ্রিক এবং রোমান রচনা সংগ্রহ।
আরও রয়েছে সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতকের বিভিন্ন ফরাসি রচনা সংগ্রহ। সবগুলো বই-ই লাল এবং বাদামী চামড়ার মলাটে মোড়ানো।
আরও রয়েছে ফ্রেডেরিখ দ্য গ্রেটের নিজস্ব শোবার ঘর, ছবিঘর এবং সঙ্গীত শোনার ঘর।
প্রতিটি ঘরের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন নকশা। কোনওটিতে গ্রিক, কোনওটিতে রোমান আবার কোনওটির জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে ভারতীয় অথবা চৈনিক স্থাপত্য নকশা।
তবে প্রতিটি ছাদই নকশাকাটা। সেখানে শোভা পাচ্ছে নানা ফল-ফুল এবং দেব-দেবীর মূর্তি। দরজায় আঙুরলতা আর হরেক পাখির চোখজুড়ানো মূর্তি ।
আর মেঝেতে কাঠ এবং মার্বেলের নকশা। প্রতিটি ঘরেই শোভা পাচ্ছে বড় বড় আয়না আর জানালা। সবচে’ মজার ব্যাপার, প্রতিটি ঘরের মধ্যেই রয়েছে অন্য ঘরে যাওয়ার দরজা।
এভাবে একবার এক ঘরে ঢুকলে পর্যায়ক্রমে সবগুলো ঘরেই ঢোকা যায়।
তবে আসবাবপত্র তেমন বেশি নেই বললেই চলে। তার মধ্যে বেশির ভাগই পরে তৈরি করা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এবং কালক্রমে প্রায় সব আসবাবপত্রই হারিয়ে গেছে বা নষ্ট হয়ে গেছে।
তবে যতদূর সম্ভব পরের আসবাব তৈরির সময় পূর্বেকার আদল দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
পুরো এলাকাটি শুধু এই ভবনটির জন্যই বিখ্যাত নয়। এখানে রয়েছে ছোটবড় আরও ২০টির মতো স্থাপনা। কোনওটি তৈরি হয়েছে প্রথম ফ্রেডেরিখের সময়, আবার কোনওটি তৈরি করেছে দ্বিতীয় ফ্রেডেরিখের উত্তরসূরীরা।
বিশাল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত পার্কের মাঝে মাঝে এসব স্থাপনা স্থানটিকে করেছে বৈচিত্র্যময়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এখানে রয়েছে অষ্টাদশ শতকের তৈরি একটি চৈনিক চা-ভবন। সেই সময়ের ঐতিহ্য অনুযায়ীই এটি বানানো হয়েছিল।
পার্কে রয়েছে নানা আকৃতির ফোয়ারা। বৃক্ষের সারি। এর মধ্যে রয়েছে প্রায় ৩ হাজার ফলজ বৃক্ষ। আরও রয়েছে এটি বিশাল হাওয়াকল বা উইন্ড মিল। এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। পরে আগেরটির আদলেই নতুনটি করা হয়েছে।
মূল এলাকায় প্রবেশের পরেই হাতের বাঁ পাশে অর্ধচন্দ্রাকৃতি একটি স্থাপনা চোখে পড়বে। এটিই হচ্ছে ফ্রেডেরিখ দ্য গ্রেটের সমাধি। এখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছে এই ভবনটির এককালের কর্ণধার।
দুই জামার্নির মিলনের পর ১৯৯৫ সালে গঠন করা হয় `দ্য ফাউন্ডেশন অফ প্রুসিয়ান প্যালেসেস অ্যান্ড গার্ডেনস ইন বার্লিন-ব্রানডেনবুর্গ। ` বর্তমানে এই সংস্থাটিই ভবনটির দেখভালের দায়িত্বে। প্রতিবছর প্রায় দুই মিলিয়ন দর্শনার্থী এলাকাটি পরিদর্শন করে থাকে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৩০ ঘণ্টা, মার্চ ০৬, ২০১১