ঢাকা: মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গা মুসলমিদের সঙ্গে অনাগরিকসুলভ আচরণ, জাতিগত বৈষম্য ও সহিংসতা তাদের শরণার্থী হয়ে অভিবাসী হতে বাধ্য করেছে।
এ সহিংসতা থেকে বাঁচতে কেউ কেউ বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন।
এদিকে, মায়ানমারের সহিংসতা থেকে বাঁচতে হাজার হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে পাচারকারীদের কবলে পড়েও সর্বস্ব হারিয়েছেন।
এ সময় তাদের নৌকায় মারধরের শিকার হতে হয়েছে। কখনো পাচারকারীরা তাদের সবর্স্ব লুট করে নিয়েছে। এমনকী তাদের দিনের পর দিন না খাইয়ে রাখা হয়েছে।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এক প্রতিবেদনে এ সব তথ্য প্রকাশ পেয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এ বছরের জুন মাস পর্যন্ত মোট ১২ মাসে ৫৩ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী মায়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে মালয়েশিয়া সাগরপথে মালয়েশিয়া গেছেন।
যদিও আশার কথা, এদের ৬১ শতাংশ পরিবারই কোনো না কোনোভাবে মালয়েশিয়া পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছেন।
মায়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য একটি নৌকায় মোট সাতশ জনকে নেওয়া হতো। আর এ জন্য মানব পাচারকারীদের ৫০ ডলার থেকে তিনশ ডলার পর্যন্ত দিতে হয়েছে শরণার্থীদের।
শরণার্থীরা যাতে করে পাচারকারীদের নৌকা থেকে অন্য কোথাও পালাতে না পারেন, সে জন্য পাচারকারীদের অনেকেই এ সময় সশস্ত্র অবস্থায় থাকেন। তারা শরণার্থীদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ এবং মারধর করতে। এমনকী দিনের পর দিন শরণার্থীদের না খাইয়েও রাখা হতো।
ইউএনএইচসিআরের প্রতিবেদন মতে, সাগরপথে মালয়েশিয়া যেতে সাত দিন থেকে দুই মাস পর্যন্ত সময় লেগে যেতো। এ সময়টায় শরণাথীদের কেউ কেউ নষ্ট ভাত কিংবা নুডুলস খেয়ে জীবন ধারণ করতেন। কাউকে কাউকে আবার পুরো যাত্রাপথে না খেয়েই থাকতে হতো।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এই বছর সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে দুই শতাধিক শরণার্থী মারা গেছেন। অসুস্থতাজনিত, অত্যাধিক গরমে, খাবার ও পানীয়ের অভাব এবং ক্রমাগত মারধরের কারণে এদের মৃত্যু হয়েছে।
মায়ানমারে জাতিগত বৈষম্য:
ইউএনএইচসিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়, মায়ানমারে জাতিগত বৈষম্যের শিকার হওয়ার কারণে হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।
সে দেশের রাখাইন প্রদেশে প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গা অধিবাসী বাস করতেন। এর মধ্যে সহিংসতার শিকার হয়ে দেড়লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী হয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। তারা অস্থায়ী ক্যাম্পে বাস করতে বাধ্য হয়েছেন।
শুধু তাই-ই নয়, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, ৪০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিমকে বিচ্ছিন্নভাবে আলাদা গ্রামে থাকতে হচ্ছে।
এবিষয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ফিল রবার্টসন বলেন, এটা আসলেই একটা মানবিক বিপর্যয়!
তিনি বলেন, যখন শরণার্থীদের অবস্থা খুবই খারাপ, তখন মায়ানমার সরকারের বাধা সত্ত্বেও মেডিসিনস স্যানস ফ্রন্টিয়ার্স রাখাইন প্রদেশে চিকিৎসা সেবা দিয়েছে।
এদিকে, মায়ানমার সরকার জুলাই মাসের শেষ দিকে রাখাইন প্রদেশের ওপর থেকে বিধি-নিষেধ তুলে নিয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্ত হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম নাগরিকের কাছে কোনো খাবার পৌঁছেনি। অনেকই ক্ষুধার্ত রয়েছেন এবং অনেকেই অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় অস্থায়ী ক্যাম্পে সময় কাটাচ্ছেন।
অপুষ্টিতে মালয়েশিয়ায় অবস্থান:
এদিকে, মালয়েশিয়ায় ৩৮ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী মালয়েশিয়ায় শরণার্থী হিসেবে নিজেদের নাম তালিকাভুক্ত করেছেন। তবে ২০১৩ সাল থেকে অনেকেই মালয়েশিয়া গেছেন। কিন্তু তাদের শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ দেখা গেছে।
এ বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত ১৪০ জন রোহিঙ্গা শরণার্থী মারা গেছেন। দেখা গেছে, এদের বেশির ভাগ অংশই অপুষ্টিজনিত এবং ভিটামিন বি ঘাটতিতে ভুগেছেন। এ সমস্যা হলে একজন মানুষ প্যারালাইজড কিংবা মারাও যেতে পারেন।
ফিল রবার্টসন বলেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মায়ানমারে পদে পদে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। সে দেশের সরকার, প্রাদেশিক সরকার ও রাখাইন সরকার রোহিঙ্গাদের সঙ্গে অনাগরিকসুলভ আচরণ করেছে।
তিনি বলেন, ইদানিং ভারত কিংবা বাংলাদেশ থেকে অনেক রোহিঙ্গা শরণার্থী মালয়েশিয়া এসেছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কমিশন অন রিলিজিয়াস ফ্রিডমের দুজন কমিশনার এম. জুধি জেসের ও এরিখ পি স্কয়ার্টস গত সপ্তাহে মায়ানমার সফর করেন। তারা এক বিবৃতিতে বলেন, মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা মুসলিমদের নির্যাতনের অভিযোগ আমরা পেয়েছি।
কয়েক বছর আগে নতুন রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে থেইন সেইন ক্ষমতাসীন হয়েছেন। পশ্চিমাদের কাছে বিনিয়োগের জন্য মায়ানমারকে অনেকটা খোলামেলা হিসেবে তুলে ধরেছে। মানবাধিকার উন্নয়নে মায়ানমারকে তুলে ধরা হলেও রোহিঙ্গা ইস্যু কিন্তু সে দেশের সরকার ঠিকই আড়াল করে রেখেছে।
বাংলাদেশ সময়: ১১০৫ ঘণ্টা, আগস্ট ২৭, ২০১৪