ঢাকা: চলমান সরকার বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে ওঠার প্রেক্ষিতে সোমবার নাটকীয় কিছু ঘটার অপেক্ষায় টান টান উত্তেজনা বিরাজ করছে পাকিস্তানের রাজধানীতে।
দেশটির রাজনীতির অন্যতম নিয়ন্ত্রক সেনাবাহিনীকে এখনও চলমান সঙ্কটে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় দেখা গেলেও গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে সম্ভাব্য অভ্যুত্থানের।
পাশাপাশি সেনাবাহিনীর ক্ষমতাগ্রহণ ঠেকাতে বিক্ষোভকারীদের দাবি মেনে নিয়ে পদত্যাগের মত নাটকীয় ঘোষণাও দিতে পারেন কোণঠাসা হয়ে পড়া প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ এমনও গুজব শোনা যাচ্ছে রাজধানীতে।
চলমান সরকার বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ক্রিকেটার থেকে হাল আমলে পুরোদস্তুর রাজনীতিক বনে যাওয়া বিশ্বকাপজয়ী সাবেক পাকিস্তানি ক্রিকেটার ইমরান খান এবং বিতর্কিত ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব তাহির উল কাদরি।
ভোট কারচুপির অভিযোগে গত সাধারণ নির্বাচনের পর থেকেই নওয়াজ সরকারের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছেন ইমরান খান। তাকে সমর্থন দিচ্ছে পাকিস্তানের মুসলিগ লীগ (কায়েদে আজম) সহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল।
সর্বোপরি কানাডার স্বেচ্ছা নির্বাসন থেকে দেশে ফিরে রহস্যময় আধ্যাত্মিক নেতা তাহির উল কাদরি নতুন করে সরকারবিরোধী আন্দোলনের ডাক দিলে চাঙ্গা হয়ে ওঠে ইমরান শিবির।
অর্থনৈতিক সঙ্কট সামলাতে দিশেহারা নওয়াজের দিকে সাবেক ফাস্ট বোলার ইমরান খান ছুঁড়তে শুরু করেন একের পর এক বাউন্সার।
অথচ সরকার বিরোধী আন্দোলনের প্রথম দিকে সুবিধাজনক অবস্থানেই ছিলেন নওয়াজ। সীমান্ত এলাকায় সেনাবাহিনী তালেবানবিরোধী অভিযানে ব্যস্ত থাকায় ইমরানের বাউন্সারগুলো ঠিকভাবেই ঠেকিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। এছাড়া পার্লামেন্টের সমর্থনও ছিলো তার বগলদাবায়।
মনে হচ্ছিলো এ দফায় ঠিকই সামলে নিতে পারবে মুসলিগ লীগ সরকার।
কিন্তু গত ৮ আগস্ট লাহোরে কাদেরির সমর্থকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনায় পরিস্থিতি পাল্টে দেয়। বিশেষ করে কাদরি সমর্থকদের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের অভিযোগ ওঠে নওয়াজ ও তার ভাই পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী শাহবাজের বিরুদ্ধে।
মূলত ওই সময় থেকেই বেকায়দায় পড়তে শুরু করেন নওয়াজ শরীফ। এরপর পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে ওঠে যখন ৮ আগস্টের উত্তপ্ত পরিস্থিতিকে পুঁজি করে ১৪ আগস্ট স্বাধীনতা দিবসের দিন উৎসবের বদলে সরকার বিরোধী আন্দোলনের ডাক দেন ইমরান খান।
আজাদি মার্চ নামের ওই সরকার বিরোধী আন্দোলনের ডাকে দেশজুড়ে সাড়া পড়ে যায়।
১৪ আগস্ট বৃহস্পতিবার সকালে ইমরান খানের বাসভবন থেকে লং মার্চের যাত্রা শুরু হয়। কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে লাহোর থেকে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদের দিকে যাত্রা করে আজাদি মার্চ।
নওয়াজ সরকারের পতন নিশ্চিত করেই ঘরে ফেরার ঘোষণা দেন ইমরান খান।
ইমরানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাহির-উল-কাদরির দল পাকিস্তান আওয়ামী তেহরিকও ইসলামাবাদে সমাবেশের ঘোষণা দেয়।
ইমরান খানের আন্দোলনে সমর্থন দেয় পাকিস্তান মুসলিম লীগ ( কায়েদে)। দলটির শীর্ষ রাজনীতিক পারভেজ এলাহী আশাবাদ ব্যক্ত করেন, ‘এই লং মার্চ সরকারের পতন ঘটিয়েই শেষ হবে। ’
পাশাপাশি ইমরান খানকে সরাসরি সমর্থন না করলেও পরোক্ষভাবে নওয়াজ বিরোধী অবস্থান নেয় পাকিস্তানের প্রধান বিরোধী দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি পিপিপি।
পিপিপির সংসদীয় নেতা খুরশিদ শাহ সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, সরকারের উচিত হবে না ইমরানের এই লং মার্চকে বাধাগ্রস্ত করা।
তবে সরকার বিরোধী আন্দোলন ও আজাদি মার্চকে রুখতে বদ্ধপরিকর হন সদ্য নির্বাচনে জিতে আসা নওয়াজ শরীফও। ছোটো ভাই ও পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী শাহবাজ শরীফকে সাথে নিয়ে তিনি কষতে থাকেন গদি রক্ষার নতুন সমীকরণ।
লাহোর সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শহরের সঙ্গে ইসলামাবাদের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে কনটেইনার দিয়ে সব প্রবেশ পথ বন্ধ করা হয়। এছাড়া মোতায়েন করা হয় বিপুল সংখ্যক পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য।
নওয়াজ ভেবেছিলেন, তরুণদের মধ্যে ইমরান খানের জনপ্রিয়তা থাকলেও দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর কাছে যেহেতু তেহরিক ই ইনসাফের তেমন গ্রহণযোগ্যতা নেই, তাই এ যাত্রায় হালে পানি পাবেন না ইমরান খান।
অপরদিকে কানাডা থেকে বহুদিন বাদে দেশে ফেরা ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব তাহির উল কাদরিকেও তিনি খুব একটা গোণায় ধরেননি।
তাই ১৪ আগস্ট থেকে ইসলামাবাদে বিক্ষোভকারীদের সরকার বিরোধী অবস্থান চললেও গত দুই সপ্তাহ নওয়াজ ছিলেন নির্ভার।
অপর দিকে দুই সপ্তাহেও সরকার বিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা করতে না পেরে ইমেজ সঙ্কটের মুখে পড়ে ইমরান খান ও কাদরির আন্দোলন। এমনকি সমালোচনার মুখে পড়েন ইমরান খান নিজেও।
সুপ্রিম কোর্টও আন্দোলনকারীদের রাজধানীর অবরোধ উঠিয়ে নেয়ার নির্দেশ দেন।
কিন্তু পরিস্থিতি প্রতিকূল থাকলেও রণে ভঙ্গে দেননি জাত ফাইটার ইমরান খান। ছিলেন সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষায়। অবশেষে শনিবার রাতে বিক্ষোভকারীদের ওপর নিরাপত্তা বাহিনী চড়াও হলে ইমরান পান তার কাঙ্খিত ‘ব্রেক থ্রু’।
শনিবার রাতভর সংঘর্ষে নিহত হন বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারী। আহত হন সহস্রাধিক লোক।
এ পরিস্থিতিতে মওকা বুঝে ফের সক্রিয় হয় সেনাবাহিনী। এতদিনের দর্শকের ভূমিকা থেকে সরাসরি মঞ্চে নেমে পড়ে তারা।
সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয় তারা চলমান সঙ্কটের মধ্যস্থতা করতে আগ্রহী। পরে পৃথক পৃথক ভাবে নওয়াজ, ইমরান ও কাদরির সঙ্গে বৈঠক করেন সেনা প্রধান রাহিল শরীফ। পাশাপাশি সামরিক বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ কোর কমান্ডারদের সঙ্গেও শলাপরামর্শও সেরে নেন।
এছাড়া আন্দোলন শান্তিপূর্ণভাবে চালানোর জন্য বিক্ষোভকারীদের ‘অনুরোধ’ জানানোর পাশাপাশি বিক্ষোভকারীদের ওপর অতিরিক্ত শক্তিপ্রয়োগের বিরুদ্ধে প্রশাসন ও পুলিশকে ‘সতর্ক’ করে দেয় সেনাবাহিনী।
এ পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের রাজনীতিতে ফের সেনা হস্তক্ষেপের গুঞ্জন শুরু হয়।
সেনাবাহিনী মাঠে নেমে পড়ায় দ্রুত সমর্থন হারাতে থাকেন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ। এতদিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকা অন্যান্য রাজনৈতিক খেলোয়াড়রাও সরব হতে শুরু করে। সেনাবাহিনীর অবস্থানকে স্বাগত জানায় তারা।
‘করাচির নিয়ন্ত্রক’ হিসেবে পরিচিতি প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল মুত্তাহিদা কওমী মুভমেন্ট থেকে শুরু করে বেশ কয়েকটি ধর্মীয় দলও নওয়াজের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের অভিযোগ আনেন।
এ পরিস্থিতিতে সর্বশেষ সোমবার আন্দোলন নতুন মাত্রা লাভ করে যখন ইসলামাবাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ‘রেডজোনের’ ভেতরে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করে বিক্ষোভকারীরা।
বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সেখানে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এক পর্যায়ে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙ্গে সচিবালয়ের ভেতরে প্রবেশ করে অান্দোলনকারীরা। পৌঁছে যায় প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির কাছাকাছি।
অপর দিকে আরেক দল বিক্ষোভকারী ঢুকে পড়ে ইসলামাবাদের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেল পিটিভির মূল ভবনে। ভাঙচুর চালানোর পাশাপাশি পক্ষপাতদুষ্ট সংবাদ পরিবেশনের অভিযোগ মারধর করা হয় সংবাদ উপস্থাপকদের। এ সময় বন্ধ হয়ে যায় পিটিভির সম্প্রচার।
অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যেই সরকার বিরোধীদের সরিয়ে দিয়ে পিটিভি ভবনের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে সেনা সদস্যরা। সোমবার দুপুর থেকে ফের শুরু হয় সম্প্রচার।
সর্বশেষ জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসছেন সেনা প্রধান রাহিল শরীফ। ওই বৈঠকের পরই নতুন কোনো ঘোষণা আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এ অবস্থায় নওয়াজের অবস্থা ‘শ্যাম রাখি না কূল রাখি’। সেনাবাহিনীকে ঠেকাতে তাকে সমঝোতা করতে হবে ইমরানের সঙ্গে। আবার ইমরান ঠেকাতে তাকে সমঝোতা করতে হবে সেনাবাহিনীর সঙ্গে।
উভয় পরিস্থিতিই তার জন্য অস্বস্তিকর। এ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ফায়দা লোটার সুযোগ তাই সেনাবাহিনীর।
যদি সেনাবাহিনীকে ঠেকাতে ইমরানের দাবি মেনে নওয়াজ পদত্যাগ করেন, তবে জিতে যাবেন ইমরান, নওয়াজকে হটিয়ে রাতারাতি পাক রাজনীতির কেন্দ্রীয় চরিত্রে আবির্ভূত হবেন তিনি। সেটা নওয়াজের জন্য অস্বস্তিকর।
আবার বিষয়টি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জন্যও খুব একটা অসুবিধাজনক হবে না।
কারণ ইমরান খানের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা থাকলেও তার রাজনৈতিক দলের তেহরিক ই ইনসাফ এখনও সারাদেশে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। সেক্ষেত্রে শক্তিশালী রাজনৈতিক দল মুসলিগ লীগের বদলে ইমরানকে বশে রাখা অনেক বেশি সহজ হবে সেনাবাহিনীর পক্ষে।
অপরদিকে যদি ইমরান খানকে ঠেকাতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমঝোতা করেন নওয়াজ সেক্ষেত্রেও সেনাবাহিনীর পোয়াবারো।
এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ হারাবে বেসামরিক সরকার। প্রধানমন্ত্রীর পদটি হয়ে পড়বে অনেকটাই অলঙ্কারিক। নীতি নির্ধারণের মূল ক্ষমতা চলে যাবে সেনা প্রধান ও তার কোর কমান্ডারদের হাতে। প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা অনেকটা হবে ‘উজিরে খামোখা’র মত।
তাই সব দিক বিবেচনা করলে এটাই ধারণা হবে যে, চলমান সঙ্কটের অবসান যেভাবেই ঘটুক না কেন শেষ হাসি হাসবে সেনাবাহিনীর প্রধান রাহিল শরীফ।
নওয়াজের পাওয়ার আর কিছুই নেই, আছে অনেক কিছু হারানোর। অপরদিকে ইমরানের হারানোর কিছু নেই, যা পাওয়ার তিনি পেয়ে গেছেন।
পরিস্থিতির যবনিকা যেভাবেই ঘটুক না কেন, এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতের পাক রাজনীতিতে তার অবস্থান অনেকটা নিশ্চিত হয়ে গেলো।
তবে চলমান খেলায় চূড়ান্তভাবে হারলো আসলে পাকিস্তানের গণতন্ত্র। নির্বাচন ও শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ সেনাশাসনে জর্জরিত দেশটিতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে চলার যে সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছিলো, বর্তমান পরিস্থিতিতে সে সম্ভাবনার বিনাশ হলো।
বাংলাদেশ সময়: ১৮১৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০২, ২০১৪