ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

বিশ্লেষণ

পরমাণু চুল্লি নিয়ে বিপদে জাপান

রানা রায়হান, আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০০০ ঘণ্টা, মার্চ ১৫, ২০১১
পরমাণু চুল্লি নিয়ে বিপদে জাপান

ঢাকা: ফুকুশিমা পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের চারটি চুল্লিতে বিস্ফোরণের পর জাপান জুড়ে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। আরও দুটি চুল্লিতে তাপামাত্রা বাড়ছে, এগুলোয় বিস্ফোরণের আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এরই মধ্যে শীতলীকরণ ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে গেছে, বিস্ফোরিত চুল্লির ফুয়েল রডগুলো গলতে শুরু করেছে।

জাপানি পরমাণু প্রকৌশলীরা গত তিন দিন ধরে চুল্লির গলে পড়া ঠেকাতে কাজ করছেন। কিন্তু পুরোমাত্রায় চুল্লির শীতলীকরণ প্রক্রিয়া চালু করতে সক্ষম হননি। সব মিলিয়ে এ মুহূর্তে সবচেয়ে ভয়াবহ পরমাণু ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে জাপান। এরই মধ্যে জাপানের আবহমণ্ডলে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মাত্রার তেজস্ক্রিয় পদার্থের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। আর এখন ক্রমশ বেড়েই চলেছে।

জাপানের পরমাণু নিরাপত্তা সংস্থা মঙ্গলবার জানিয়েছে, দুর্ঘটনায় বিপদের মাত্রা চার। তবে ফ্রান্স জানিয়েছে, ফুকুশিমা পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিপদের মাত্রা ছয়, যার অবস্থান চেরনোবিল দুর্ঘটনার পরপরই। জাতিসংঘের পরমাণু পর্যবেক্ষণ সংস্থা (আইএইএ)-এর মতে, বৈশ্বিক পর্যায়ে দুর্ঘটনার স্কেল সাত।

উল্লেখ্য, চেরনোবিল বিপর্যয়ে ৯ লাখের চেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আহত ও পঙ্গু হয়েছে অসংখ্য অগণিত মানুষ। গোটা এলাকার বাতাস পানি মাটি ও পরিবেশ ভয়াবহ দূষণের শিকার হয়। আশপাশের এলাকাই শুধু নয়, এর ফলে পূর্ব ইউরোপ মহাদেশের একটি বড় এলাকাজুড়ে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে।

বিস্ফোরণ ঘটল কিভাবে?
ভূমিকম্প সংঘটনের প্রাথমিক পর্যায়ে তিনটি চুল্লির ভেতরে নিয়ন্ত্রণকারী রড ঢুকিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে সেসময় সেগুলো রক্ষা পায়। এর ফলে একের পর এক বিস্ফোরিত হয়নি।

তবে পরমাণু জ্বালানি রডগুলো ব্যাপক তাপ উৎপন্ন করতে থাকে এবং এটা নিয়ন্ত্রণে আনতে চুল্লির ভেতরে পানি পাম্প করে চুল্লি শীতল রাখার ব্যবস্থা করা হয়। ভূমিকম্পের ফলে শীতলীকরণ ব্যবস্থার পাম্প নষ্ট হয়ে যায় এবং ব্যাকআপে থাকা ডিজেল চালিত জেনারেটর সুনামিতে ভেসে যায়। জরুরি ব্যাটারিগুলো চুল্লি পানি দেওয়ার জন্য যথেষ্ট না, ফলে ভেতরে ভয়াবহ মাত্রায় তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। এমনকি তিনটি চুল্লির ভেতরে সমুদ্রের পানি ঢোকানোর ব্যবস্থাও ব্যর্থ হয়। ফলে চুল্লির তাপমাত্রা বাড়তেই থাকে। এক সময় বিস্ফোরিত হয়।

তাপমাত্রা বাড়লে চুল্লির কী পরিবর্তন হয়?
প্রাথমিক পর্যায়ে রডের উপরিভাগের বেশিরভাগ পানি বাষ্পে পরিণত হয়। এটা চুল্লির বাইরের আবরণে (কেসিং) ব্যাপক চাপ সৃষ্টি হয়। এই চাপে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। এটা এড়াতে কিছু অতিউত্তপ্ত বাষ্প চুল্লির বাইরে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিজ্ঞানীরা। এরকম উচ্চ তাপমাত্রায় পানি হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনে ভেঙে যায়। বিস্ফোরণ ঘটে। একারণেই এক ও তিন নম্বর চুল্লিতে বিস্ফোরণ ঘটেছে।

বিস্ফোরণে বিপর্যয় কিসের?
বাইরে থেকে ব্যাপক আকারে বিস্ফোরণ দেখা গেলেও, তা স্বয়ং চুল্লিরও খুব বেশি ক্ষতি করে না। এর কারণ হচ্ছে, চুল্লির বাইরের আবরণটি কেবল পরিবেশ থেকে পৃথক করতে ব্যবহৃত হয়। তেজষ্ক্রিয়তার জন্য এর কোনো ভূমিকা নেই। রডের সঙ্গে যুক্ত থাকে তেজষ্ক্রিয় জ্বালানি, এই রড অত্যন্ত শক্ত ও তাপসহনশীল ধাতু জিরকালয় দিয়ে নির্মিত। এই ধাতুটির চারপাশেই শীতলীকরণ ব্যবস্থা এবং সুদৃঢ় (সুপার-স্ট্রং) ছয় ইঞ্চি পুরু ধাতুর ফ্লাস্ক রয়েছে। সব শেষে ফ্লাস্কটি তিন ফুটেরও বেশি কনক্রিটের নির্মিত আবরণের মধ্যে রয়েছে।

তাহলে এটা বন্ধ করা হচ্ছে না কেন?
চুল্লির ভেতরে শীতলীকরণ ব্যবস্থা অব্যাহতভাবে ব্যর্থ হতে থাকে এবং জ্বালানি রডগুলোর গায়ে বাষ্প লাগে না। এর অর্থ হচ্ছে, তাপমাত্রা বাড়তে থাকে এবং তা বন্ধ করার কোনো উপায় নেই। তাপমাত্রা ২২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছালে এমনকি জিরকালয় ধাতু পর্যন্ত গলতে শুরু করে। এরপর ইউরেনিয়াম ও প্লুটোনিয়াম (৩ নম্বর চুল্লির ক্ষেত্রে) পরিবেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এগুলোর সংস্পর্শে যা আসে তাই আক্রান্ত হয়।

গলে যাওয়ার মানে কি?
এখনো বলা যাচ্ছে না চুল্লিগুলো গলে গেছে। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, আংশিক গলা শুরু হয়েছে। কারণ আবর্জনার মধ্যে জিরকালয় ধাতু পাওয়া গেছে। তেজষ্ক্রিয় জ্বালানি ও চুল্লির একেবারে ভেতরের ধাতু গলে গেলেই কেবল পুরোপুরি গলে যাওয়া বোঝায়। সেই মুহূর্তে ভয়াবহ বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। চুল্লিগুলো আর প্রকৌশলীদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না।

ফ্লাস্ক কি গলিত পদার্থ ধারণে সক্ষম?
কাগজে  লেখা রয়েছে তা পারবে। তবে আমাদের এখনো জানা নেই। গলে যাওয়া জ্বালানি আরও উত্তপ্ত হতে পারে এবং প্রতিরক্ষামূলক ফাস্কের ভেতর দিয়ে গলে বেরিয়ে পড়তে পারে। একইসময় ফাস্কের ওপর এমন পর্যায়ে চাপ পড়ে যে তা বিস্ফোরিত হয়। এরপর তেজষ্ক্রিয় পদার্থ পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে। এমন আশঙ্কা থাকলে প্রকৌশলীরা দ্বিধায় পড়ে যান।

পরমাণু বোমার মতো কি তা বিস্ফোরিত হবে?
পরমাণু চুল্লি কোনো বোমা না। চুল্লিতে বিস্ফোরণ ঘটে চাপ ও রাসায়নিক অগ্নিকাণ্ডের কারণে। যেমন পানি হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনে বিভক্ত হয়ে পড়লে। তবে এটা বোমার মতো।

কী করা যায়?
প্রকৌশলীরা সমুদ্রের পানি পাম্প করে চুল্লির ভেতরে প্রবেশ করায়, যাতে তা তাপমাত্রা কমাতে পারে। এছাড়া বোরিক এসিডও দেওয়া হয়। এতে পারমাণবিক প্রতিক্রিয়া (বিস্ফোরণ) দমিয়ে রাখা হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৪০ ঘণ্টা, মার্চ ১৫, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।