নয়াদিল্লি: জাপানে ভয়াবহ ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত পরমাণু চুল্লিগুলোতে একের পর এক বিস্ফোরণে বিশ্বব্যাপী তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা সত্ত্বেও জ্বালানি বুভূক্ষু দেশগুলো তাদের চুল্লির ব্যবহার অব্যাহত রাখবে। সেই সঙ্গে নতুন আরো চুল্লি নির্মাণেরও পরিকল্পনা করছে তারা।
জাপানের সংঘটিত এ ভয়াবহ বিপর্যয় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশগুলোর জ্বালানি ও বিদ্যুৎ বিষয়ক কর্মকর্তাদের পরমাণু সম্প্রসারণ নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবতে বাধ্য করেছে।
আর যদি জাপানের বিস্ফোরিত দুটি চুল্লি থেকে প্রচুর তেজস্ক্রিয় বিকিরণ এ সংকটকে আরও জটিল করে তোলে তাহলে নতুন উন্নয়নশীল দেশগুলোও তাদের পারমাণবিক উচ্চাভিলাষ নিয়ে পুনর্বিবেচনা না করে পারবে না।
কিন্তু এই মুহূর্তে তারা নিরাপত্তা প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করে বলছে, তাদের অপ্রতুল শক্তি উৎস পেতে আর কোন বিকল্প নেই। আর সে কারণেই পারমাণবিক শক্তিখাতে বিনিয়োগ অব্যাহত রাখতে তারা বাধ্য।
সোমবার মুম্বাইয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ভারতের অ্যাটোমিক এনার্জি কমিশনের চেয়ারম্যান শ্রী কুমার ব্যানার্জি এমন কথাই বলেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশ খুবই শক্তি সংকটে রয়েছে। ভারতের ১২ কোটি মানুষ নিয়মিত বিদ্যুৎ পান না। সুতরাং আরও বিদ্যুৎ উৎপাদন আমাদের জন্য অপরিহার্য। ’
এদিকে, চীন যাকে বিশ্বের সবচেয়ে পরমাণু উচ্চাভিলাষী দেশ বলা হয় তারা তাদের লক্ষ্য অর্জনে এখনো দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। দেশটির পরিবেশ প্রতমন্ত্রী ঝ্যাং লিজুন শনিবার বলেছেন, ‘জাপানের সাম্প্রতিক সংকট সত্ত্বেও তাদের পরমাণু কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হবে না। ’
পরমাণু বিস্তারে উৎসাহী এ দু’দেশের সঙ্গে এশিয়া, পূর্ব ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোও পরমাণু শক্তির অধিকারী হতে আগ্রহী হয়ে উঠছে। জীবাস্ম জ্বালানির ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফিতি এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে সৃষ্ট পরিবেশ বিপর্যয়ের হুমকি তাদের এতে প্ররোচণা যোগাচ্ছে।
শিল্প-বাণিজ্য গ্রুপের একটি সংগঠন ওয়ার্ল্ড নিউকিয়ার অ্যাসোসিয়েশনের হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে সারা বিশ্বে পরমাণু চুল্লির সংখ্যা ৪৪৩টি আর আগামী ১৫ বছরে তা দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে যাবে।
তবে পরমাণু শক্তির ঝুঁকি নিয়ে ভারত ও চীনের কর্মকর্তারা যে নিরুদ্বেগ তা কিন্তু নয়। যেমন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং সোমবার বলেছেন, তার দেশের পরমাণু শক্তি বিভাগ নিউকিয়ার প্ল্যান্টের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আবারও পরীক্ষা করে দেখবে। সুনামি বা ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে যেনো চুল্লিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এ বিষয়টি মাথায় রাখা হচ্ছে। ’
রোববার বেইজিং একটি রাজনৈতিক সমাবেশে জাপানের ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রিফোর্ম কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট জিয়া ঝেনহুয়া বলেন, ‘পরমাণু নিরাপত্তা ব্যবস্থার মূল্যায়ন এবং চুল্লিগুলোতে পর্যবেক্ষণ অবশ্যই আরও জোরদার করা হবে। ’
চীনে ১১টি পরমাণু চুল্লি কার্যকর আছে এবং আগামী এক দশকে প্রতি এক বছরে একটি করে নতুন চুল্লি নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে তারা। চীনে প্রতি বছর বিদ্যুতের চাহিদা ১২ শতাংশ করে বাড়ছে। অথচ পশ্চিমের দেশগুলোতে এ চাহিদা স্থির রয়েছে।
অপরদিকে, ভারতে কার্যকর চুল্লির সংখ্যা ২০টি। তারা দেশব্যাপী আরও ডজন খানেক চুল্লি স্থাপনে ১৫ হাজার কোটি ডলারের বাজেট নিয়ে নতুন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এতে করে ২০৫০ সালের মধ্যে দেশটির চাহিদার এক চতুর্থাংশ পূরণ করা যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর এ পরিমাণ হবে বর্তমানের ১০ গুণ।
এসব দেশের এ উচ্চাভিলাষে সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছে জেনারেল ইলেক্ট্রিক নামের একটি চুল্লি নির্মাণ কোম্পানি। অন্য কোম্পানিগুলো হলো- ফ্রান্সের অ্যাভেরা এবং টোশিবার মালিকানাধীন ওয়েস্টিং হাউজ ইউনিট।
জেলারেল ইলেক্ট্রিকের প্রধান নির্বাহী জেফ্রি আর ইমেলট সোমবার দিল্লিতে আসেন। তার কোম্পানির উৎপন্ন দ্রব্য ও সেবার বাণিজ্যের খাতিরে এক পূর্ব নির্ধারিত প্রণোদনা সফরে তিনি এসেছিলেন।
জাপানের ওকুমাতে প্রথম বিস্ফোরিত চুল্লি ফুকুশিমা ডেইচির নকশা তিনিই করেন। শুক্রবার এটি বিস্ফোরিত হয়। এর পর একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটছেই।
সোমবার এক সংবাদ সেম্মলনে তিনি বলেন, ‘পরমাণু শক্তি শিল্পে জাপানের ঘটনার প্রভাব সম্পর্কে কিছু বলার সময় এখনো হয়নি। ’ তবে তার কোম্পানির শেয়ার সোমবার ২ শতাংশেরও বেশি পড়ে গেছে।
তিনি বলেন, ‘পরমাণু শক্তির প্রায় ৫০ বছরের ইতিহাস রয়েছে। জনগণ এ ইতিহাসের পেছনে তাকাতে পারে এবং তারা নিজেরাই এর বিচার করবেন। ’
এর আগে অবশ্য জেনারেল ইলেক্ট্রিক ভারতে পারমাণবিক চুল্লি বিক্রি করেনি। বেশিরভাগ দেশই তাদের নিজস্ব প্রযুক্তি অথবা রাশিয়ার সহায়তায় নিজের নিজের চুল্লি স্থাপন করেছে। ভারত গত ডিসেম্বরে অ্যাভেরার সঙ্গে ৯৩ কোটি ডলারের পরমাণু চুল্লির চুক্তি করেছে।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রও অবশ্য তাদের দেশীয় শিল্পের বাজার ভারতে সম্প্রসারণে ব্যাপক প্রচেষ্টা চালিয়েছে। গত ৫ বছর ধরে দুই দেশের কর্মকর্তারা আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ প্রচেষ্টা দুই দেশের সরকার এবং আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থাও প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে, পারস্য উপসাগরে ইরানের পরমাণু উচ্চাভিলাষ নিয়ে পশ্চিমাদের উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য ও এর আশপাশের দেশগুলোও পরমাণু শক্তি অধিকারী হতে উঠেপড়ে লেগেছে। জর্দান, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন এবং মিশর নিউকিয়ার গবেষণা শুরু করেছে। এমনকি তেল সমৃদ্ধ সৌদি আরবও তাদের আগ্রহের কথা গোপন রাখে নি।
এদিকে, ইউরোপের অন্যান্য দেশের মধ্যে জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল রোববার বলেছেন, তার দেশ অভ্যন্তরস্থ পরমাণু চুল্লিগুলোর স্থায়ীত্ব আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। যদিও এ মুহূর্তে বিষয়টি তারা পূনর্মূল্যায়ন করছেন।
তবে সুইজারল্যান্ড নতুন চুল্লি স্থাপন বা পুরনো চুল্লি পুনস্থাপনের সিদ্ধান্ত স্থগিত করেছে। তারা জননিরাপত্তার বিষয়টির ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।
কিন্তু একই সময়ে ইতালি, রাশিয়া এবং চেক প্রজাতন্ত্র বলছে, তারা তাদের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ নীতিতে অবিচল থাকবে।
নিউইয়র্ক টাইমস অবলম্বনে জাহাঙ্গীর আলম।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৪১ ঘণ্টা, মার্চ ১৬, ২০১১