মনিপুর: তারা ছিলেন অনেকের মধ্যে মাত্র ১০ জন। অসাধারণ সুন্দরী।
এরা হলো ভারতের সেভেন সিস্টারের অন্যতম রাজ্য মনিপুরের অল্পবয়সী বিধবা নারী। গত ৫০ বছর ধরে এ অঞ্চলে ভারতীয় পুলিশ এবং সেনাবাহিনী বিচ্ছিন্নতাবাদিদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে আসছে। বিদ্রোহীদের সঙ্গে সংঘর্ষে এখানে কমপক্ষে ৫০০ নারী স্বামী হারিয়েছে বলে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দাবি।
সম্প্রতি বিবিসির রূপা ঝা মনিপুর ঘুরে এসে এসব নারীর করুণ কাহিনী বর্ণনা করেছেন। নিচে এর কিছু অংশ তুলে ধারা হলো-
রূপা বাড়িতে সমবেত হওয়া এমন ১০ জন নারীর সঙ্গে কথা বলেছেন। এসব অল্পবয়সী নারীদের জীবনের নেপথ্যে যে কী করুণ কাহিনী আছে তা তিনি প্রথমে কল্পনাই করতে পারেন নি। রূপা বলেন, ‘তাদের প্রত্যেকের কাছে থাকা একটি পারিবারিক ফটো অ্যালবাম যখন মেলে ধরলেন তখন আমি গল্প শুরুর একটা সূত্র পেয়ে গেলাম। অ্যালবামটি ছিল তাদের হারানো স্বামীদের ছবিতে ভরা, যারা তাদের জীবনের ক্ষুদ্র একটা সময় নির্ভরতা আর সুখের আশ্রয় ছিল। ’
দুই সন্তানের মা বছর পঁচিশের এডিনা নামের মেয়েটা তার ছবিগুলো দেখানোর জন্য খুব উদগ্রিব। কাঁপা কাঁপা হাতে তিনি অ্যালবামের পাতা উল্টানোর চেষ্টা করছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি স্ট্রোক করেছিলেন। এখন শরীরের অর্ধাংশ অবশ। তিনি আমাকে বলছিলেন কীভাবে ২০০৯ এ জানুয়ারির এক শীতের সকালে তার স্বামী নিহত হন।
এডিনা বলেন, ‘সে গাড়ি চালাতো এবং পরিবারের প্রতি খুবই যতœশীল ও বাচ্চাদের প্রতি স্নেহশীল পিতা। সেদিন দুপুরের খাবারের পর সে বের হয়ে যায়। এরপর আর কোনো খবর পাচ্ছিলাম না। পরে টেলিভিশনে খবরে বলা হয় নিরাপত্তা বাহিনী তাকে হত্যা করেছে। তারা বলছে সে নাকি বিদ্রোহী জঙ্গি ছিলো। ’
রূপা বলেন, ‘আমি এডিনাকে জিজ্ঞেস করলাম, দাবির পক্ষে নিরাপত্তা বাহিনী কোনো যুক্তি-প্রমাণ দেখিয়েছে কিনা। উত্তরে সে তীরস্কারের কণ্ঠে বললো, না, আর আমি জানি তারা মিথ্যা বলছে। ’ বলতে বলতে তার দুই গাল বেয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরতে থাকে। কাঁদতে কাঁদতে বহুদিন ধরে আগলে রাখা স্বামীর ছবিতে পরম আদরে হাত বুলাতে থাকে এডিনা। ’
এডিনার মতো এ অঞ্চলের আরো অনেক যুবতী বিধবা রমনী মাসের দ্বিতীয় শনিবার পরস্পরের দুঃখ ভাগাভাগি করতে জড়ো হয়। পরস্পরের দুঃখ-বেদনার কথা বলে গলা জড়িয়ে কেঁদে বুক হালকা করে।
এটা হলো ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের একটি বাস্তব চিত্র। এ সংগ্রামে অনেক বিদ্রোহী, সেনা এবং পুলিশ কর্মকর্তা হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। অনেক নিরীহ অধিবাসীও এ অস্থিরতার শিকার।
এসব নারীরা সবাই তাদের স্বামীদের হারিয়ে অসহায় জীবন যাপন করছেন। তাদের সবার দাবি স্বামীরা নির্দোষ। বিশেষ ক্ষমতাবলে তাদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে বিদ্রোহী বলে দাবি করা হয়েছে। ’
১৯৫৮ সালে ভারত সরকার সশস্ত্রবাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন পাশ করে। যা ভারতের মুনপুরসহ উত্তর-পূর্ব প্রদেশগুলোতে কার্যকর করা হয়।
ভারতের এমন একটি ছোট শহরে একজন বিধবা হিসেবে বেঁচে থাকা খুবই কঠিন এবং তারা স্বামী না থাকার কারণে প্রায়ই বৈষম্যের শিকার হন। বিশেষ করে হিন্দু আইনে বিধবাদের প্রতি এমনিতেই বৈষম্যমূলক আচরণের বৈধতা আছে।
এডিনা, নিনা, টনি এবং এমন আরো অনেকে তাদের জীবনের অনেক অজানা করুণ কাহিনী শুনান। তাদের একজন বলেন, ‘অনেক কমবয়সী আর সুন্দরী হওয়ার কারণে এ বৈধব্যের জীবন আরো কঠিন হয়ে উঠেছে। ’
‘আমাদের শশুর-শাশুড়ি এবং বাবা-মারা আরো বেশি বিধিনিষেধ আরোপ করেন। বাইরে বের হওয়া বা কাজে যাওয়া তারা পছন্দ করেন না কারণ লোকেরা তখন আমাদের নিয়ে অনেক বাজে কথা বলে। ’
‘তারা এই ভেবে ভীত যে আমরা আবার বিয়ে করে ফেলব। আর আমাদের সমাজে এটা খুবই খারাপ কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ’
রূপা বলেন, ‘আমি তাদের জিজ্ঞেস করলাম তারা আবার বিয়ে করতে বা কারো প্রেমে পড়তে চায় কিনা। কিছুক্ষণ তারা স্তব্ধ হয়ে যায়। তারা বুঝতে পারছিলোনা কীভাবে এর প্রতিক্রিয়া জানাতে হবে। অবশ্য তাদের কাছে এটি একটি অকল্পনীয় বিষয়। কিছুই না বুঝে সবাই হাসতে শুরু করে। ’
এসব নারীর মুখে-চোখে ফুটে আছে মনিপুরে সরকারের অনৈতিক বল প্রয়োগের করুণ চিত্র। গত ৫০ বছর ধরে শুধু বিশেষ ক্ষমতাবলে নিরাপত্তা বাহিনী এভাবে তাদের তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে। এর আদৌ কি কোনো বৈধতা আছে?
ঠিক এ প্রশ্নেই গত ১০ বছর ধরে নীরবে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন মনিপুরের এক সংগ্রামী নারী ইরোম শর্মিলা চানু। এ আইন প্রত্যাহারের দাবিতে তিনি আমরণ অনশন করে যাচ্ছেন। কারাগারে বন্দি অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে জোরপূর্বক খাওয়ানোর কারণে এখনো তিনি প্রাণে বেঁচে আছেন। এখন তার বয়স ৩৮ বছর।
তার সঙ্গে কোনো সাংবাদিককে দেখা করতে দেওয়া হয় না। বিবিসির সাংবাদিক রূপা কোনোভাবে তার সঙ্গে দেখা করতে পেরেছিলেন। এক সকালে শর্মিলার সঙ্গে দেখা করেন তিনি। লোহার গরাদের ফাঁক দিয়ে তাদের খুব কম সময়ের জন্য সাক্ষাৎ হয়।
রূপা বলেন, ‘শর্মিলাকে খুবই শুকনো আর দূর্বল দেখাচ্ছিলো। তার নাকে একটি নল ঝুলছিলো যেটা দিয়ে তাকে খাওয়ানো হয়। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, শর্মিলা কেমন আছো? সে মুচকি হেঁসে ফিস ফিস করে বললো, ভাল। এর পরই নিরাপত্তা রক্ষীরা আমাদের বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ’ তবে শর্মিলা সরকারের সদিচ্ছার ব্যাপারে বেশ সন্দিহান। কিন্তু সে তার দাবি ছাড়তে রাজি নয়।
ইন্টারনেট অবলম্বনে জাহাঙ্গীর আলম।
বাংলাদেশ সময়: ১৭২৪ ঘণ্টা, মার্চ ১৭, ২০১১