ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

মার্কিন মুলুকে মোদির মিডিয়া ম্যানার ও সাংবাদিকের অতৃপ্তি

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ৭, ২০১৪
মার্কিন মুলুকে মোদির মিডিয়া ম্যানার ও সাংবাদিকের অতৃপ্তি ছবি: সংগৃহীত

রাহুল শ্রীবাস্তব নামে দিল্লির এক সাংবাদিক জানিয়েছেন- ভারতের নয়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর যুক্তরাষ্ট্র সফর কভার করতে গিয়ে একজন সিনিয়র সাংবাদিক বলছিলেন, ‘আমি এই সফরে মনমোহন সিং ও বাজপেয়ীকে খুব মিস করছি। ’

মোদীর এবারের সফরের খবর পরিবেশনা সাংবাদিকদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিলো।

সে নিয়েই বিস্তারিত লিখেছেন রাহুল। তিনি নিজেও ছিলেন ওই সফরে একজন সংবাদকর্মী।

নরেন মোদীর পাঁচ দিনের সফরে ম্যানহাটন ও ওয়াশিংটন ডিসির উচ্চ পর্যায়ের টেবিলে পানীয়র গ্লাসে টোস্ট করে যেমন ডজন খানেক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়েছে তেমনি কম-বেশি গোটা পঞ্চাশেক টুকিটাকি কর্মসূচিও ছিলো। আর এই সফরের সময় মোদীর উপবাস নিয়ে কভারেজ টেলিভিশন-অনলাইনগুলোর গিগাবাইটস যেমন খেয়েছে তেমনি নিউজপ্রিন্ট লেগেছে দিস্তায় দিস্তায়।

ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে মোদীকে দেওয়া রক-স্টার সংবর্ধনা, সেন্ট্রালপার্ক কনসার্টে তার উপস্থিতি ও বক্তৃতা, প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে বৈঠক আর তাদের দুজনের মার্টিন লুথার কিং স্মৃতি সৌধের দিকে হেঁটে যাওয়ার সব ঘটনায় প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো মিনিটে মিনিটে আপডেট দিয়েছে। সংবাদগুলোও ছিলো তথ্যবহুল ও দ্রুত।

নিউইয়র্কে জেএফকে বিমানবন্দরে পৌঁছানো থেকে শুরু করে ওয়াশিংটনে থেকে দেশে ফেরা পর্যন্ত মোদীর প্রতিটি পদক্ষেপের অবিরাম খবর দিয়েছে মিডিয়াগুলো।

অনেক খবর, অনেক রং ও ঢঙের লেখা, অনেক বিশ্লেষণ। কিন্তু তারপরেও তেষ্টা মেটেনি সাংবাদিকদের। রয়ে গেছে তাদের অতৃপ্তি। তার কারণ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মিডিয়া ম্যানার। এয়ার ইন্ডিয়া ওয়ানে তার সঙ্গে ছিলেন কেবলই অল ইন্ডিয়া রেডিও এবং দূরদর্শনের প্রতিনিধিরা। আর দিল্লি থেকে ফ্রাঙ্কফ্রুট হয়ে নিউইয়র্কের পথে হয়নি কোনো ধরনের মিডিয়া মিথষ্ক্রিয়া।

মোদী যখন নিউইয়র্কে তার হোটেলে পৌঁছালেন তখন সেখানে দেখা গেলো ভিড় করে আছে ভারতীয় সাংবাদিকরা। তারা মোদীর কাছাকাছি পৌঁছানোর কসরত চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু মোদীর সেদিকে ভ্রুক্ষেপটিও নেই। অনাবাসী ভারতীয়রাও জড়ো হয়েছিলেন। তাদের দিকে হাসিমুখে হাত নাড়ছিলেন মোদী। দুই-চার টিভি চ্যানেলের রিপোর্টার কোনও রকম সামনে পৌঁছাতে পেরে যখন তাদের মাইক এগিয়ে দিলেন, মোদীর মুখের সামন্য শব্দটিও যদি ধরা পড়ে! কিন্তু তাদের হতাশ করে হেঁটে এগিয়ে গেলেন মোদী।

ম্যানহাটনে নাইন-ইলেভেন স্মৃতিস্তম্ভে গিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। সেখানেও সাংবাদিকদের সামনে মুখ খোলেন নি তিনি। এরই মধ্যে পাকিস্তান জাতিসংঘে কাশ্মীর প্রসঙ্গ তোলার চেষ্টা করছিলো। ফলে প্রধানমন্ত্রীর নাইন-ইলেভেন মেমোরিয়ালে যাওয়া সন্ত্রাসের বিপক্ষে ভারতের অবস্থানকেই স্পষ্ট করে। আর পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদের পক্ষে অবস্থানের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার মোক্ষম স্থানটিই হতে পারতো ওই টুইন টাওয়ারের গ্রাউন্ড জিরো। কিন্তু সেখানেও মোদী ‘স্পিকটি নট’।

অধিকাংশ কর্মসূচিতেই মোদীর সঙ্গে সুযোগ পেয়েছে তার সফরসঙ্গী হয়ে থাকা দুটি সংবাদমাধ্যম। কর্মসূচি শেষে সাংবাদিকদের জন্য কোনো অনানুষ্ঠানিক ব্রিফিংও ছিলো না। আর এক্ষেত্রেই সাংবাদিকদের মনে পড়ে যায় মনমোহন সিংয়ের কথা। মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলতে তার কোনো অনীহা ছিলো না। মনমোহন সিংয়ের যে কোনো বিদেশ ভ্রমনে একটি বিষয় অবধারিতভাবেই থাকতো... তা হচ্ছে যাওয়া ও আসার পথে ফ্লাইটে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলা।

অটল বিহারী বাজপেয়ী একজন মজার মানুষ। ফ্লাইটে তিনি নিজেই খোঁজ-খবর নিতেন সাংবাদিকদের যত্ন-আত্তি ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা। মনমোহন সিং ও তার স্ত্রী গুরশরণ কৌর এয়ার ইন্ডিয়া ওয়ানের সিট থেকে উঠে আসতেন সাংবাদিকদের অংশে। প্রত্যেককের আলাদা করে খোঁজ খবর নিতেন। ধন্যবাদ জানাতেন।

মিডিয়ায় মোদীর অনীহা.. তেমনটা নিশ্চয়ই নয়। তাকে ঘিরে থাকা পারিষদ ও কর্মকর্তারাও বেশ দক্ষ। যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় মোদী স্পষ্টই মিডিয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। প্রতিটি কর্মসূচির কথা আগেই মিডিয়াকে জানানো হয়েছে। কিন্তু এর পরে আর কিছু নয়। প্রধানমন্ত্রী মিডিয়ার জন্য সীমারেখা নির্দেশ করে দিচ্ছেন। মিডিয়াকে কতটুকু তথ্য দেওয়া হবে তা তিনি কিংবা তার লোকেরা নিয়ন্ত্রণ করছেন।       

ব্রাজিলে ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার সময়ও একই অবস্থা ছিলো। ওটি ছিলো নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম আন্তর্জাতিক সফর। সেখানে আগেভাগেই হাজির থাকা ভারতীয় সাংবাদিকদের ভীড় থেকে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন প্রধানমন্ত্রী। এসময় হেসে মন্তব্য করেন- পুরি মণ্ডলি আ গেয়ি ইয়হাঁ (পুরো দল এখানে এসে পড়েছে)। কিন্তু টেলিভিশন সাংবাদিকরা এক-দুটি প্রশ্ন করার চেষ্টা করলেও মোদী পাত্তা দেননি। হেঁটে এগিয়ে গেছেন।

মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলতে খুবই সতর্ক মোদী। যুক্তরাষ্ট্র সফরের আগে ফরিদ জাকারিয়ার সঙ্গে সিএনএনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারের বাইরে আর কিছু ছিলো না। আর যেখানে নীতি আর কৌশলের প্রশ্ন সেখানে কোনোভাবেই সংবাদমাধ্যমের সবাইকে ডাকা হচ্ছে না।

এই নিয়ন্ত্রণমুখী পদ্ধতি একাধিকভাবে সংবাদমাধ্যমকে প্রভাবিত করছে। যেখানেই প্রধানমন্ত্রী সফর করেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেখানে একটি মিডিয়া রুম খুলে দেয়। বাজপেয়ীর সময় এই মিডিয়া রুম কেবল সাংবাদিকদের খবর পাঠানোর সুবিধা দিতো তাই নয়- মাঝে মধ্যেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী, সচিব কিংবা রাষ্ট্রদূত এই রুমে আসতেন, সাংবাদিকদের ব্যাকগ্রাউন্ড ব্রিফ করতেন।
 
নরেন্দ্র মোদীর এবারের যুক্তরাষ্ট্র সফরে তার সঙ্গে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল, রাষ্ট্রদূত এস জয়শংকর। কিন্তু এদের প্রত্যেককেই লো-প্রোফাইলে রাখা হয়েছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের সঙ্গে মাত্র একবার কথা বলেছেন যখন আলোচনা বাতিল হওয়ার জন্য ইসলামাবাদ ভারতকে দুষতে চাইলো তখন।

প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফর সাংবাদিকদেরও বিদেশ সফরের একটি সুবিধা এনে দেয়। এই সময় সাংবাদিকদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দলের সঙ্গে সাংবাদিকদের আরও একটু ঘনিষ্ট হওয়ারও সুযোগ তৈরি হয়, এতে ভালো সোর্সও তৈরি হতে পারে। কিন্তু এবারে সে সুযোগটিও হয়নি ভারতীয় সাংবাদিকদের। মিডিয়ার জন্য সুসময় ‍আসতে কি পাঁচ বছরই অপেক্ষা করতে হবে!  এখন সত্যিই মনে হচ্ছে মিডিয়া বাজপেয়ী বা মনমোহন সিংকে মিস করবে। আর ধীরে ধীরে এই মোদী পদ্ধতিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে!

রাহুল শ্রীবাস্তবের এই লেখাটি তার নিজস্ব ব্লগে প্রকাশিত হয়। সেখান থেকে মন্তব্য ও এর যথার্থতার জন্য কোনো দায়িত্ব না নিয়েই প্রকাশ করে এনডিটিভি। সেখান থেকেই অনুদিত করা হলো বাংলানিউজের পাঠকের জন্য।

বাংলাদেশ সময় ১৩৫৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৭, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।