যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার দ্বিতীয় দফার পররাষ্ট্রনীতি পুরোপুরি সুতোয় ঝুলে পড়েছে। ইরানের পরমাণু কর্মসূচি সীমিতকরণে মঙ্গলবারের আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার পর সে কথাই বলছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা।
আর এই ফাঁদ ওবামার নিজেরই পাতা। ৩১ মার্চের ডেডলাইন পার হওয়া এখন সময়ের অপেক্ষা মাত্র। কোনও চূড়ান্ত ফল না বের করা গেলে ওবামা প্রশাসনের ওপর বড় আঘাত আসবে, আর হোয়াইট হাউসের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে শুরু হওয়া সমালোচনার আগুনে ঘি পড়বে।
হোয়াইট হাউসের ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি এরিক ক্লাটজ সোমবার স্বীকার করে নিয়েছেন আলোচনা থেকে সাফল্য অর্জনের পারদ নিচের দিকেই নামছে।
‘এখনই ব্যর্থ বলছি না,’ এয়ারফোর্স ওয়ানের আরোহী হওয়া সাংবাদিদের তিনি সে কথাই বলেন। এরিক বলেন, ‘আমাদের প্রতিনিধি দল দিন-রাত টানা কাজ করে যাচ্ছে চেষ্টা করছে একটা সুফল নিশ্চিত করতে। ”
এই সংলাপে ওবামার আগ্রহের ভিত ছিলো গোটা মধ্যপ্রাচ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতিতে বড় পরিবর্তনের চিন্তা থেকে। তিনি চাইছেন মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে সম্পর্কটি সামরিক থেকে কূটনীতিকে পাল্টে দিতে।
সেই ভাবনা থেকেই তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, কথা বলবেন এই অঞ্চলে ইরানের মতো ক্রুদ্ধ হয়ে থাকা দেশগুলোর নেতাদের সঙ্গে কথা বলবেন।
চুক্তির প্রস্তাব করা হলো, তেহরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হবে, আর বিনিময়ে ইরান অন্তত আসছে একটি দশক তারা পারমানবিক কর্মসূচি বন্ধ করে রাখবে। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতি ইস্যুতে ওবামা প্রশাসন যখন বিপাকে তখন এমন একটি প্রস্তাব থেকে আশার মুখ দেখা যাচ্ছিলো।
‘ইরানের পরমাণু কর্মসূচি বন্ধ করা গেলে তা হতো এক বড় বিজয়,’ ওবামা প্রশাসনের পররাষ্ট্র দফতরের পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ বিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা রবার্ট ইনহর্ন সে কথাই বললেন।
তবে এই চুক্তিতে উপনীত হওয়া ইরান সরকারের জন্য একটি বড় কাজ। তাদের বেশ কিছু বড় বড় সিদ্ধান্তই নিতে হবে, যার মধ্যে রয়েছে সামরিক উদ্দেশ্যে ইউরেনিয়াম সম্মৃদ্ধকরণ থেকে বিরত থাকা, আর পরমানু শক্তির বহর পরিদর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া।
পরমাণু চুক্তির পক্ষে যারা তারা এমন একটি পদক্ষেপকে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ দিক বলেই বিবেচনা করছেন। বছরের পর বছর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞায় থেকেও এই ইরান আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে মাথা উঁচু করে আছে।
‘ইরানের উত্থানকে ঠেকিয়ে রাখা যায়নি,’ এমন মত দিয়ে জর্জ ডব্লিউ বুশ ও বিল ক্লিনটন আমলের জাতীয় প্রতিরক্ষা কাউন্সিলের ইরান বিষয়ক উপদেষ্টা হিলারি মান লেভেরেট বলেছেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে কৌশলগত অবস্থান নিশ্চিত করতে একটি চুক্তি জরুরি। কিন্তু এখন দেখছি সে সম্ভাবনা ফুরিয়ে যাচ্ছে। ’
এদিকে সংশয়বাদীরা বলছেন, ওবামা যদি এই চুক্তি নিশ্চিত করেও ফেলেন, তার এই প্রচেষ্টা ইতিহাসের বইয়ে তাকে ব্যর্থ বলেই তুলে রাখবে।
ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসির নির্বাহী পরিচালক মার্ক ডাবোইচের কথাই ধরুন না। তিনি বলছেন, ‘একটি চুক্তিই যে গোটা মধ্যপ্রাচ্যের চরিত্র পাল্টে দেবে, তা আমি মনেই করি না। তিনিসহ অন্য সমালোচকরা বিশ্বাস করেন ওবামা প্রশাসন নিজেদের অনেকটাই নামিয়েছে, আর যে চুক্তির প্রস্তাব করা হয়েছে তাকে ইরানের পরমাণু শক্তি ও সেই শক্তির উন্নয়ন থেমে যাবে না।
একটি পরমাণু শক্তিধর ইরান যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ধ্বংসাত্মক পরিণতি বয়ে আনতে পারে। এতে ইয়েমেন, সিরিয়া আর ইরাকে এখন যে কান্না চলছে তা বাড়িয়ে দেবে। এসব অঞ্চলে ইরানের মদদপুষ্ট দলগুলো সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। এছাড়াও এই ক্ষিপ্ত রয়েছে শিয়া প্রধান ইরানের সুন্নি শত্রুদেশ সৌদি আরব ও মিশর। এরাও তাদের নিজেদের পরমাণু শক্তিধর করে তুলতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
এক্ষেত্রেও কিছু দোষের ভাগ নিতে হচ্ছে ওবামা প্রশাসনকে। কেউ কেউ যুক্তি দিচ্ছে আরব বসন্তে ওবামা যে দুষ্টুখেল খেলেছেন তা সিরিয়ার গণযুদ্ধকে ব্যর্থতার দিকে ঠেলে দেয়।
‘কোনো চুক্তি যদি না হয়, সেটাই বরং ভালো হবে ওবামা শাসনের জন্য,’ বলেন ডাবোইচ।
এই চুক্তি ইরানকে পরমানু শক্তিধর হওয়া থেকে বিরত রাখতে পারবে কি না সেটি আদতেই একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। চুক্তিতে ইরানকে পরমাণু অস্ত্র বানানো থেকে এক দশকের জন্য বিরত থাকার শর্ত দেওয়া হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে ইরান এই চুক্তি থেকে সরে যাবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
এদিকে ইরানের সঙ্গে এই পরমাণু আলোচনা ওবামা প্রশাসনের ওপর নাখোশ করেছে ইসরাইলকে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে ওবামার দুরত্বও সৃষ্টি হয়েছে। সংশয়বাদীরা বলছেন, ইসরাইলের সঙ্গে এই ক্ষতিগ্রস্ত সম্পর্কের জের টানতে হবে ওবামার সম্ভাব্য উত্তরসুরি হিলারি ক্লিনটনকে।
কংগ্রেসের সদস্যরা বলছেন, প্রশাসন এই প্রক্রিয়া থেকে তাদের সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন রেখেছে। যদিও হোয়াইট হাউস সে কথা মেনে নিতে নারাজ।
দুই পক্ষের আইনপ্রণেতারাই হুমকি দিচ্ছেন এই চুক্তি যদি হয়ও, কংগ্রেস এমন আইন করে দেবে যাতে চুক্তিই হয়ে যাবে অকার্যকর। আর এ কারণে এই সংশয়বাদী কংগ্রেস সদস্যদের রাজি করাতে ঘরেও লড়তে হচ্ছে ওবামা প্রশাসনকে।
ইনহর্ন বলছেন, প্রশাসনকে সব কথা খোলাসা করে জানাতে হবে। স্বচ্ছ থাকতে হবে।
ওবামা অবশ্য এখনো ইরানের পরমাণু অস্ত্র বানানো ঠেকাতে শক্তির ব্যবহার এখনো বাতিল করে দেননি। তবে তার যুক্তি হচ্ছে, কূটনৈতিক পথেই ভালো ফল আসবে।
‘তাদের পরমাণু শক্তি বৃদ্ধি ঠেকাতে সম্ভাব্য সকল পথেই চেষ্টা চালাতে চাই আমি,’ একটি সাক্ষাৎকারে বলেন প্রেসিডেন্ট ওবামা। ‘তবে অবশ্যই সবচেয়ে সেরা পথ হচ্ছে কূটনৈতিক সমাধান,’ বলেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১১৪০ ঘণ্টা, মার্চ ৩১, ২০১৫