ঢাকা: ড্রাকুলার গল্প মনে আছে তো। যৌবন ধরে রেখে অনাদিকাল বেঁচে থাকতে ড্রাকুলা পান করে মানুষের রক্ত।
অথবা মহাভারতের যযাতির কথা মনে আছে? নিজের জরা বিনিময় করেছিলেন পু্ত্র পুরুর যৌবনের সঙ্গে ! যৌবন পাওয়ার আনন্দে ছেলের উপর খুশি হয়ে তাকে সব উজাড় করে দেন তিনি।
আসলে যৌবন কে না চায়! কিন্তু, জৈবিক নিয়মে শরীরে বার্ধক্য আসতে বাধ্য। জরাকে ঠেকিয়ে রাখা অসম্ভব, এতদিন এটাই জানা থাকলেও বিজ্ঞানীদের একটা অংশ এখন বলছেন, এই অসম্ভবকেও সম্ভব করা সম্ভব!
সম্প্রতি নেচার পত্রিকায় এই তত্ত্ব প্রকাশের পর শোরগোল পড়ে গেছে বিজ্ঞানী মহলে। টনি ওয়াসি-কোরে নামে এক গবেষক জানিয়েছেন, নবীন রক্তই পারে প্রবীণের জরা বিলম্বিত করতে।
টনি জরাগ্রস্তদের নিয়েই কাজ করেন। প্রথম দিকে তিনি অ্যালঝাইমার্স নিয়ে গবেষণা করতেন। ভুলে যাওয়ার এই রোগে প্রবীণদের একটা বড় অংশ ইদানীং ভীষণ ভাবে আক্রান্ত। এই রোগে কে কে আক্রান্ত হবেন, তা যৌবনেই আগাম বলে দেয়া যায় কি না তার ওপরই গবেষণা করতেন টনি।
দীর্ঘ গবেষণার পর তার আবিষ্কার, ‘নবীন রক্তের ভিতরেই লুকিয়ে আছে যৌবনের চাবিকাঠি। ’
বিজ্ঞানীদের দাবি, হৃদ্পিণ্ড থেকে ধমনী, শিরা, উপশিরা, জালিকা হয়ে ফের হৃদ্পিণ্ডে ফিরতে রক্ত সারা দেহে প্রায় ৯৬ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়। নিজের শরীরে প্রায় ৭০০ উপাদান বহন করে চলে সে। উপাদানগুলিকে চিহ্নিত করা গেলেও তাদের সবার কাজ কী, বিজ্ঞানীদের কাছে তা স্পষ্ট নয়।
টনি ভাবলে এই উপাদানগুলির কোনও একটির মধ্যেই অ্যালঝাইমার্স-এর আগাম সঙ্কেত থাকতে পারে। গবেষণার জন্য ২৪ জনের একটি দলও গঠন করেন তিনি। সেই গবেষণায় উঠে এল, বয়স যতই বাড়ে রক্তে কয়েকটি প্রোটিনের পরিমাণ তত কমতে থাকে। ২০ বছর পরে এই প্রোটিনগুলির পরিমাণ বেশ খানিকটা কমে যায়। উল্টো দিকে কয়েকটি প্রোটিনের পরিমাণ বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পেতে থাকে। প্রবীণদের রক্তে কয়েকটি প্রোটিনের পরিমাণ আবার প্রায় তিন গুণ হয়ে যায়। এই প্রোটিনের বাড়া-কমার সঙ্গে অ্যালঝাইমার্স’র সম্পর্ক খুঁজে পেলেন তাঁরা। ২০০৭এ সেই ফলাফল প্রকাশ পায়।
অপর দিকে প্রায় একই সময়, স্টেম কোষ নিয়ে কাজ করছিলেন থমাস রান্ডো নামের আরেক গবেষক। শরীরের কোষগুলিকে সুস্থ ও কর্মক্ষম রাখতে ওই কোষের প্রয়োজন। কিন্তু, প্রবীণদের স্টেম কোষ ঠিক মতো কাজ করে না। সে কারণেই বৃদ্ধ বয়সে কোনও ক্ষত সারতে বেশি সময় লাগে। থমাসের মাথায় প্রশ্ন এল, কোনও সঙ্কেত পেয়ে কি স্টেম কোষ কাজ বন্ধ করে দেয়? সেই সঙ্কেত কি তবে রক্তই বয়ে বেড়ায়? ঠিক এই জায়গাতেই দুই গবেষকের অনুসন্ধান এক বিন্দুতে এসে মিলিত হয়। এরপরই একসঙ্গে কাজ শুরু করেন তারা।
এরপর এ ব্যাপারে ইঁদুরের উপরে নানা পরীক্ষা চালানো হয়। তরুণ ইঁদুরের রক্ত ঢুকিয়ে দেওয়া হল প্রবীণ ইঁদুরের শরীরে। ফলাফলে বিজ্ঞানীরা তাজ্জব! দেখা গেল, রক্ত বেশ কিছু প্রোটিন বহন করে যা কোষকে সতেজ রাখে। আবার কিছু প্রোটিন কোষকে বুড়োটে করে দেয়। কম বয়সীদের রক্তে এই সতেজ করার প্রোটিনগুলি খুব বেশি থাকে। বয়স যত বাড়ে, ততই কমতে থাকে এই প্রোটিনগুলি।
তবে, টনিদের এই ধারণা অবশ্য নতুন নয়। ১৬১৫ সালে জার্মান চিকিৎসক আন্দ্রেজ লিবাভিয়াস এমনই একটা কথা বলেছিলেন। লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটি’র হয়ে এ নিয়ে গবেষণা করছিলেন রবার্ট বয়েল। পরে ফ্রান্স আর ইংল্যান্ড এই পরীক্ষা নিষিদ্ধ করে। ১৬৯০ সালে পোপও এই ধরনের পরীক্ষার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।
এর প্রায় ৩শ’ বছর পরে সেই গবেষণার জন্য নতুন কোম্পানি খুলেছেন টনি। এই ব্যাপারে সাহায্য করছে এক জাপানি ধনকুবের পরিবার। ওই পরিবারের প্রধান আক্রান্ত ছিলেন অ্যালঝাইমার্স‘এ। তাঁকে কোনও কারণে রক্তের নতুন প্লাজমা দিতে হয়েছিল। এর পরে অবস্থার হঠাৎ উন্নতি হয়। টনিদের কাজ জানতে পেরে সেই পরিবার সাগ্রহে এগিয়ে আসে।
টনিদের এই গবেষণা আশার জন্ম দিয়েছে অনেকের মনে। পাশাপাশি আশঙ্কারও। এর পরে তরুণ, যুবকদের রক্ত নিয়ে কালোবাজারি শুরু হয়ে যাবে না তো? কিডনি, ফুসফুস, লিভার নিয়েও তো বিশাল কালোবাজারি হয়। এ বার তার সঙ্গে রক্তও না জুড়ে যায়!
বাংলাদেশ সময়: ০৪৫৩ ঘণ্টা, আগস্ট ০৬, ২০১৫
আরআই