ঢাকা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ৭০ বছর আগে ঠিক আজকের দিনের সকালে প্রতিদিনের মতোই জেগে উঠেছিল জাপানের হিরোশিমাবাসী। গুরুত্বপূর্ণ এই শিল্পনগরীর বাসিন্দারা প্রস্তুত হচ্ছিলেন কর্মস্থলে যেতে, বাচ্চারা স্কুলে।
১৯৪৫ সালের মে মাসেই জন্ম হয় ‘লিটল বয়’য়ের। নাম ‘লিটল বয়’ হলেও সে বছর ৬ আগস্ট হিরোশিমার ওপর ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার টন টিএনটি’র সমপরিমাণ শক্তি নিয়ে দুই হাজার ফুট ওপরে বিস্ফোরিত হয় এটি। পাঁচ বর্গ কিলোমিটার এলাকা মুহূর্তেই ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে বলেন, এ যেন ছিলো রৌদ্রজ্জ্বল আকাশে আলোর বিস্ফোরণ।
১৯৪৫ সালের এপ্রিলেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মার্কিন সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল জর্জ সি মার্শাল মেজর জেনারেল লেসলি গ্রোভসের কাছে সম্ভাব্য পরমাণু হামলার লক্ষ্য কি হবে তা জানতে চান। এরই প্রেক্ষিতে ম্যানহাটন প্রোজেক্টের প্রধান গ্রোভস একটি কমিটি গঠন করেন, যারা পাঁচটি স্থানের নাম প্রস্তাব করেন। জাপানের সবচেয়ে বড় সামরিক ভাণ্ডার এলাকা কোকুরা; পোতাশ্রয় ও শিল্পাঞ্চল হিরোশিমা; জঙ্গিবিমান, যুদ্ধাস্ত্র, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম প্রস্তুত কেন্দ্র, তেল শোধনাগারের স্থান ও নগরাঞ্চল ইয়োকোহামা; তেল শোধনাগার, শিল্পাঞ্চল ও বন্দরনগরী নিগাতা; গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকেন্দ্র কিয়োটো।
হামলার লক্ষ্যগুলো নির্ধারণের সময় কয়েকটি বিষয়ের ওপর নজর রাখা হয়। হামলার স্থানের ব্যস অবশ্যই কমপক্ষে ৩ মাইল (৪.৮ কিলোমিটার) হবে, বৃহত্তর নগরাঞ্চল হবে, বিস্ফোরণে উল্লেখযোগ্য ধ্বংসসাধনের সুযোগ থাকবে ও আগস্টে হামলার জন্য উপযোগী হবে।
এরই ভিত্তিতে প্রাথমিক লক্ষ্য হিসেবে হিরোশিমা ও নাগাসাকিকে নির্বাচিত করা হয়। এ দুই স্থানে মিশন বিফল হলে বাকি তিন স্থানকে বিকল্প হিসেবে রাখা হয়।
৫ আগস্ট দিবাগত মধ্যরাতে জাপানি রাডার আকাশে বিপুল সংখ্যক মার্কিন জঙ্গিবিমানের উপস্থিতি সনাক্ত করে। হিরোশিমাসহ অনেক শহরেই রেডিও সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়।
এদিকে স্থানীয় সময় সকাল ৮টা ৯ মিনিটে ৬৪ কেজি (১৪১ পাউন্ড) ইউরেনিয়াম-২৩৫ সমৃদ্ধ পারমাণবিক বোমা ‘লিটল বয়’কে বহনকারী জঙ্গিবিমান হিরোশিমার উদ্দেশে উড়তে শুরু করে। ৮টা ১৫ মিনিটে বোমাটি ৩১ হাজার ফুট (৯,৪০০ মিটার) ওপর থেকে ফেলা হয়। বিস্ফোরণের আগে এটি ৪৪ সেকেন্ড ধরে নিচে পড়তে থাকে। দুই হাজার ফুট ওপরে থাকতে শিমা সার্জিক্যাল ক্লিনিকের ওপর এটি বিস্ফোরিত হয়। বোমা বহনকারী প্লেনের পাইলট এনোলা গ্যে তার বাহন নিয়ে ততক্ষণে ১১.৫ মাইল দূরে চলে গেছেন। এতো দূর গিয়েও তিনি এর শকওয়েব অনুভব করেন।
বিস্ফোরণের লক্ষ্য ছিল হিরোশিমার আইওই সেতু। কিন্তু বাতাসের প্রবাহের কারণে এটি ওই ক্লিনিকের ওপর বিস্ফোরিত হয়। সঙ্গে সঙ্গে ১ মাইল ব্যাসার্ধের (১.৬ কিলোমিটার) এলাকা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। ৪.৪ বর্গমাইল (১১ বর্গ কিলোমিটার) এলাকাজুড়ে আগুন ধরে যায়।
বিস্ফোরণে তাৎক্ষণিকভাবে ৭০ হাজার থেকে ৮০ হাজার মানুষ, যার মাঝে সেনা ছিলেন ২০ হাজার, নিহত হন। এ মৃত্যুর সংখ্যা ছিল সে সময় হিরোশিমার মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ। এছাড়া আহত হয় আরও ৭০ হাজার মানুষ। এছাড়া বিস্ফোরণের পর প্রথম দুই থেকে চার মাসের মধ্যে মৃতের সংখ্যা দেড় লাখ ছাড়িয়ে যায়।
ঘটনায় বেঁচে যাওয়া অনেকেই জানিয়েছেন, বিস্ফোরণের পর আতঙ্কে ছুটতে থাকা মানুষের শরীর থেকে মাংস খুলে পড়তে দেখা যায়। ঘড়ির কাঁটাগুলো গিয়েছিল থেমে। শব্দে কান তালা লেগে গিয়েছিল সবার। পারমাণবিক বোমাটির নাম ‘লিটল বয়’ হলেও তার বিস্ফোরণের প্রতিক্রিয়া হয়েছিল নারকীয়।
এই বিস্ফোরণ ও ৯ আগস্ট নাগাসাকিতে অপর পারমাণবিক বোমা ‘ফ্যাট ম্যান’র বিস্ফোরণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল নির্ধারণ করে দেয়।
এ কালো দিবসের ৭০ বছরপূর্তিতে হিরোশিমার অধিবাসীরা বৃহস্পতিবার (০৬ আগস্ট) স্মরণ করছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হতাহত হতভাগ্যদের। শহরের মোতোইয়াসু নদীর তীরে জাপানী প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবেসহ হাজার হাজার অধিবাসী মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করেছেন। সেই সঙ্গে পুরো জাপানজুড়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
এসময় শিনজো আবে বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণে আহ্বান জানিয়ে বলেন, সেই বিস্ফোরণ হিরোশিমায় শুধু হাজার মানুষই মারেনি, বেঁচে যাওয়াদের জন্যও বয়ে এনেছে অবর্ণনীয় ভোগান্তি।
তিনি বলেন, আজ হিরোশিমা আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সংস্কৃতি ও উন্নতির শহরে পরিণত হয়েছে। এদিনের ঘটনার সত্তর বছরে দাঁড়িয়ে আমি বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় সবার অংশগ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি।
বাংলাদেশ সময়: ১০৫৮ ঘণ্টা, আগস্ট ০৬, ২০১৫
আরএইচ/আরআই