ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

কে এই মোল্লা ওমর?

জাহাঙ্গীর আলম, নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৫৩ ঘণ্টা, মে ২৩, ২০১১
কে এই মোল্লা ওমর?

ঢাকা: মোল্লা ওমর। পুরো নাম মোল্লা মোহাম্মদ ওমর।

পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের বিশাল অঞ্চলজুড়ে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালানো প্রধান জঙ্গি সংগঠন তালেবানের আধ্যাত্মিক নেতা। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের কার্যত প্রধান ছিলেন তিনি। তাকে বলা হতো সরকারের সর্বোচ্চ পরিষদের প্রধান। তালেবান শাসিত ইসলামিক আমিরাত অব আফগানিস্তানে আমির উল মুমেনিন (বিশ্বাসীদের নেতা) বলে মানা হতো তাকে। পাকিস্তান, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতও তাকে ও তার সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। যদিও এখন তাদের ভোল পাল্টে গেছে, সমর্থনও উঠে গেছে। মোল্লা ওমর এখন তাদের পহেলা নম্বরের দুষমন। মোল্লা ওমর দুষমন যেহেতু আমেরিকার!

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের বিভীষিকা ৯/১১ নামে বিশ্বব্যাপী বিশেষ পরিচিতি পেয়েছে; যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার্লড ট্রেড সেন্টার এবং টুইন টাওয়ারে হামলার সন্দেহভাজন আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন আল কায়েদা এবং এর প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে ওই বছর অক্টোবরে আফগানিস্তানে হামলা চালিয়ে কার্যত দেশটি দখল কওে নেয় যুক্তরাষ্ট্র।

মনে করা হয়, পাকিস্তানে সন্ত্রাসী হামলা ছাড়াও এবং আফগানিস্তানে কারজাই সরকার এবং ন্যাটোর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় হামলার নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন মোল্লা ওমর।

অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রে হামলার পর থেকে তাকে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। বিভিন্ন গণমাধ্যমে তার যেসব ছবি প্রকাশিত হয় সবগুলোই ২০০২ সালের।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সামনে আসতে সব সময়ই তার অনীহা ছিল। ক্ষমতায় থাকাকালে কান্দাহার ছেড়ে খুব কমই বাইরে যেতেন। বাইরের লোকদের সঙ্গে সাক্ষাৎও করেছেন খুব কম। কূটনৈতিক সব কাজ করাতেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াকিল আহমেদ মোতাওয়াকিলকে দিয়ে।

মার্কিন সমর্থনে আফগানিস্তানের শাসন ক্ষমতায় নতুন সরকারের প্রেসিডেন্ট কারজাইসহ অনেকে মনে করেন, পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই) মোল্লা ওমর ও তালেবানকে পুতুলের মতো ব্যবহার করে।

তার ব্যক্তিগত জীবন:

মোল্লা ওমরের সঠিক জন্মতারিখ জানা যায় না। তবে ১৯৫৯ সালের কোনো এক সময় কান্দাহারের নিকটবর্তী শহর নোদেহতে তার জন্ম। তিনি জন্ম নিয়েছেন আফগানিস্তানের এক গরীব ভূমিহীন পরিবারে। বড় হয়েছেন কান্দাহার প্রদেশের ছোট্ট গ্রাম মেইওয়ান্দে, মাটির দেয়ালঘেরা কুটিরে। তিনি স্থানীয় ঘিলজাইয়ে গোষ্ঠীর একটি অংশ হোতাক উপজাতীর সদস্য। আফগানিস্তানের সবচেয়ে বড় নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী পশতুনেরই একটি শাখা এটি।

জন্মের আগেই বাবা মারা যাওয়ায় কমবয়সেই পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে নিতে হয় ওমরকেই । তিনি আফগানিস্তানের দারুল উলুম হাক্কানি মাদরাসায় পড়াশুনা করেছেন বলেও জানা যায়।

মোল্লা ওমরের সন্ত্রাসী হয়ে ওঠা:

মোল্লা ওমর প্রথম অস্ত্র ধরেন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে। নেক মোহাম্মদের নেতৃত্বে মুজাহেদিন গ্রুপ হরকাত-ই-ইনকিলাব-ই-ইসলাম এ যোগ দেন তিনি। সোভিয়েতদের সমর্থনে ক্ষমতায় থাকা নজিবুল্লাহ সরকারের বিরুদ্ধে ১৯৮৯ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত তিনি যুদ্ধ করেছেন। সোভিয়েতবিরোধী আফগানযুদ্ধে পানজোয়াই জেলার সাংসারে এক সংঘর্ষের সময় তিনি এক চোখ হারান। অন্য এক সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৬ অথবা ১৯৮৯ সালে জালালাবাদ যুদ্ধে তিনি চোখ হারান। যুদ্ধে চারবার আহত হন ওমর।

এরপর যুদ্ধ শেষে পাকিস্তানের সীমান্ত শহর কুয়েটায় একটি মাদ্রাসাতে শিক্ষকতা করেন ওমর। তখন থেকে তিনি মোল্লা নামে পরিচিত। পরে তিনি করাচিতে বিনুরি মসজিদের ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আর সেখানেই প্রথমবারের মতো ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় তার, পরে ঘনিষ্টতা। এমনকি বিন লাদেনের সঙ্গে এক মেয়ের বিয়েও দিয়েছেন তিনি।

আফগান মুজাহিদিনের অন্য নেতাদের মতো তিনি পশতু ভাষায় কথা বলেন না, বলেন আরবিতে। বিখ্যাত মিশরীয় ইসলামী ব্যক্তিত্ব শেখ আব্দুল্লাহ আজ্জামের একজন বড় ভক্ত তিনি।

তালেবান গঠন:

১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিলে দুর্বল নজিবুল্লাহ সরকারের পতন ঘটে ১৯৯২ সালে। তবে এরপরেই আফগানিস্তানজুড়ে শুরু হয় বিশৃঙ্খলা আর নৈরাজ্য। আফগান মুজাহিদিন বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে যায়। ওই সঙ্কট মুহূর্তে মোল্লা ওমর সিঙ্গেসরে ফিরে আসেন। প্রায় অর্ধশত মাদ্রাসাছাত্র নিয়ে একটি সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তোলেন। এ দলটিই তালেবান (ছাত্র) নামে পরিচিত। সংগঠনের সদস্য সংগ্রহ করা হতো আফগানিস্তানের বিভিন্ন মাদ্রাসা এবং শরণার্থী শিবির থেকে। গৃহযুদ্ধের সময় ছড়িয়ে পড়া ব্যাপক দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলায় খুব শিগগির দেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে তালেবান। ১৯৯৪ সালের নভেম্বরে কান্দাহার প্রদেশ এবং পরের বছর সেপ্টেম্বরে হেরাত দখল করে নেয় তালেবান।

ইসলামিক আমিরাত অব আফগানিস্তানের নেতা হয়ে ওঠা:

তালেবানের কর্মী-সমর্থক দিন দিন বাড়তে থাকে। আফগানিস্তানের অনেক এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ১৯৯৬ সালের এপ্রিলে সমর্থকরা ওমরকে আমির-উল-মুমেনিন উপাধিতে ভূষিত করে। এরপর ১৯৯৬ সালে তার হাতে কাবুলের পতন ঘটে। ১৯৯৭ সালের অক্টোবরে আফগানিস্তানকে ইসলামি রাষ্ট্র ঘোষণা করা হয়। আরব দেশের মধ্যে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং পাকিস্তান তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়। যদিও তখনও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে গৃহযুদ্ধ চলছিল।

অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ এবং অনাড়ম্বর জীবনযাপনে অভ্যস্ত মোল্লা ওমর ‘৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত সময়ে মাত্র দুইবার কাবুল সফর করেছেন। বেশিরভাগ সময়ই তিনি কান্দাহারে অবস্থান করতেন। ওমরের একটি বিখ্যাত উক্তি এখানে উল্লেখযোগ্য; তিনি বলতেন, ‘সব তালেবানই প্রগতিশীল। দুইটি বিষয়: চরমপন্থা এবং রক্ষণশীলতা। এ দুটি থেকে আমরা মুক্ত। এর ভিত্তিতে আমরা সবাই প্রগতিশীল, মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী। ’

তার আত্মগোপন:

আফগানিস্তানে ২০০১ সালের অক্টোবরে ইঙ্গ-মার্কিন যৌথ সামরিক আক্রমণ শুরু হলে মোল্লা ওমর আত্মগোপন করেন। এরপর তার অবস্থান সঠিকভাবে জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হতো, আফগানিস্তান অথবা পাকিস্তানের পশতুন উপজাতি এলাকায় তিনি আত্মগোপন করে আছেন।

তার অবস্থা সম্পর্কে তথ্য দাতাকে এক কোটি ডলার পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। সেই পুরস্কারের অর্থ পরে বাড়িয়ে ২ কোটি ৫০ লাখ ডলার করা হয়। আফগানিস্তান আক্রমণের শুরুতেই কান্দাহারে ওমরের বাড়িতে বোমা ফেলা হয়। হামলায় তার সৎপিতা এবং ১০ বছর বয়সী শিশুপুত্র নিহত হয়।

২০০৪ সালের এপ্রিলে মোল্লা ওমর পাকিস্তানি সাংবাদিক মোহাম্মদ শেহজাদকে একটি টেলিফোন সাক্ষাৎকার দেন। সেসময় তিনি দাবি করেন, আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেন বেঁচে আছেন এবং ভাল আছেন। সাক্ষাৎকারের কয়েক মাস আগেই তার সঙ্গে তার কথা হয়েছে বলে জানান তিনি।

এরপর ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে আটক একজন তালেবান সদস্য আফগান কর্তৃপক্ষকে জানায়, মোল্লা ওমর কুয়েটাতে আইএসআই এর আশ্রয়ে রয়েছেন। এর আগে ২০০৬ সালে প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই একই অভিযোগ করেছিলেন। তবে পাকিস্তান তা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে।

২০০৭ সালের জানুয়ারিতে এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০০১ সালে আত্মগোপনে যাওয়ার পর মোহম্মদ হানিফ নামে এক সাংবাদিকের সঙ্গে ই-মেইল এবং কুরিয়ারে যোগাযোগ করেন মোল্লা ওমর। এখানে তিনি তালেবানের পক্ষে এর আগের বছর (২০০৬ সাল) আফগানিস্তানে শতাধিক আত্মঘাতী বোমা হামলার দায় স্বীকার করেন।

২০০৯ সালের নভেম্বর সংখ্যায় ওয়াশিংটন টাইমস দাবি করে, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই মোল্লা ওমরকে সহযোগিতা করছে। অক্টোবরে তিনি করাচিতে গেছেন। এরপর সর্বশেষ ২০১১ সালের জানুয়ারিতে এক রিপোর্টে মোল্লা ওমরের হার্টঅ্যাটাকের খবর প্রকাশ করে পত্রিকাটি। আইএসআই তাকে হাসপাতালে চিকিৎসা দিচ্ছে বলেও দাবি করা হয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত হুসাইন হক্কানি এ প্রতিবেদন ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেন।

সর্বশেষ ২০১১ সালের ২৩ মে আফগানিস্তানের বেসরকারি টিভি তলোনিউজ একটি বেনামি সূত্রের বরাত দিয়ে মোল্লা ওমর নিহত হওয়ার খবর প্রচার করে। তবে এ খবর কোনো সূত্রেই নিশ্চিত করা যায়নি। তালেবানের একজন মুখপাত্র এ খবর প্রচারের পরপরই তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমির-উল-মুমেনিন নিহত হননি, তিনি আফগানিস্তানেই নিরাপদে রয়েছেন। ’

বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৭ ঘণ্টা, মে ২৩, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।