ঢাকা: পাঁচ দশক আগে তোলা পরিবেশ বিজ্ঞানীদের আশঙ্কাই সত্যে পরিণত হচ্ছে। ৬০ দশকের শেষভাগে সুইডেনের স্টকহোমে আয়োজিত পরিবেশ বিজ্ঞানীদের প্রথম সম্মেলনে ওঠা উদ্বেগকে সত্যে পরিণত করতেই যেন উষ্ণায়নের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী বাড়ছে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়, উপকূলীয় নিম্নভূমি তলিয়ে যাচ্ছে সাগরে।
এজন্য ১৯৭২ সালের রিওডি সম্মেলন ও ১৯৯২ সালের ধরিত্রী সম্মেলনসহ জলবায়ু বিষয়ক আর সব সম্মেলনে উদ্বেগ প্রকাশ করা হলেও পশ্চিমাবিশ্ব তার দায় আগাগোড়াই তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর ওপর চাপিয়ে আসছে।
বিপরীতে বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশ ধরিত্রী সম্মেলনে বেঁধে দেওয়া ক্লোরোফ্লোরোকার্বন (সিএফসি) নির্গমনের মাত্রা কমিয়ে আনলেও বিশ্বের ৮০ শতাংশ সিএফসি নির্গমনকারী শিল্পোন্নত ২০ দেশ ওই লক্ষে পৌছানোর আগ্রহ দেখাচ্ছে না মোটেই।
বিশেষত বিশ্বমোড়ল যুক্তরাষ্ট্র জলবায়ু পরিবর্তন ও জীববৈচিত্র সংরক্ষণ চুক্তিতে স্বাক্ষর না করায় ধরিত্রী সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্যটাই ভেস্তে গেছে।
আর এতে ঝুঁকি বাড়ছে বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশের।
এ ঝুঁকি ভৌগলিক তো বটেই, প্রজন্মগত সীমারেখাও অতিক্রম করছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবেই সম্প্রতি ভয়াবহ বন্যা হলেঅ থাইল্যান্ডে। এরপর হঠ্যাৎ করেই যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরে অসময়ে হয়ে গেলো প্রাণঘাতী তুষারঝড়।
এদিকে পুরো থাইল্যান্ডই ডুবে গেছে বন্যার পানিতে। গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে এটি থাইল্যান্ডের সবচেয়ে বড় বন্যা। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে নিকট আগামীতে এরকম আরও অনেক প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটতে পারে। আন্তর্জাতিক জলবায়ু রিপোর্টে এবিষয়ে বিশদভাবে তথ্য উপস্থাপন করেছেন বিজ্ঞানীরা।
রিপোর্টে তারা বলেছেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে জীবনযাপনের ব্যয় বেড়ে যাবে বহুগুণ এবং বিশ্বের কিছু জায়গা মানুষ বসবাসের পুরোপুরি অযোগ্য হয়ে যাবে। ’
উগান্ডায় এক সম্মেলনের পর গত সপ্তাহে নোবেলজয়ী সংগঠন আইপিসিসি (ইন্টারগর্ভানমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ) এই রিপোর্ট তৈরি করে।
এতে বলা হয়, মানবসৃষ্ট গ্রিন হাউস গ্যাসের কারণে ইতোমধ্যেই জলবায়ুর বড়সড় পরিবর্তন ঘটেছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অতিবৃষ্টিসহ অনাবৃষ্টিজনিত নানা বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। এছাড়াও এই পরিবর্তনের ফলে একদিকে যেমন মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে অপরদিকে জীবন হারাচ্ছে অনেক মানুষ।
জলবায়ু পরিবর্তনের অতিসাম্প্রতিক উদাহরন হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরাঞ্চলের তুষারঝড়। অসময়ে হওয়া এই তুষারঝড়ের প্রাথমিক ধাক্কাতেই অন্তত ১০ জন প্রাণ হারান।
নাসার জলবায়ু বিজ্ঞানী গ্যাবিন শামিত বলেন, ‘আরও গবেষণার দরকার আছে। তবে এটা সত্য যে, বড় ধরনের কিছু ঝড়ের মুখোমুখী হবো আমরা। এটা হয়তো তুষারঝড় হবে না কিন্তু ভয়াবহতার দিকে দিয়ে হবে জঘন্য। ’
তবে শামিত আরও বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের আরও কিছু দিক আছে। যেমন টেক্সাস এবং যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের শুষ্কতা। এটাও একপ্রকার পরিবর্তন। যেসময় বৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল সেসময় বৃষ্টির অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে সবকিছু। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা হলে শুষ্কতা নিয়ে ততটা কথা হয় না। কিন্তু বিশ্বের অনেক অঞ্চলই দিনে দিনে মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে। ’
জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার সবচেয়ে বেশি হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশগুলো। আর এই ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বাংলাদেশ। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলো বরাবরই পরিবেশ দূষণের জন্য উন্নয়নশীল দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধিসহ অপরিকল্পিত কলকারখানার কথা বলে আসছে।
তবে প্রশ্ন ওঠে, আসলেই কি উন্নয়নশীল দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী?
বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী নয়:
২০০৭ সালে ইউএনডিপির হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিপোর্টের (২০০৭) মতে, ২০০৪ সালে বাংলাদেশ মোট গ্রিন হাউস গ্যাসের মাত্র ০.১ শাতংশ নির্গমন করেছে। যা যুক্তরাষ্ট্রের মোট নির্গমনের তুলনায় মাত্র দেড় শতাংশ। সিএআইটি’র (ক্লাইমেট অ্যানালাইসিস ইন্ডিকেটর টুল) মতে, ১৯৫০ সাল থেকে ২০০০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন করেছে মাত্র ০.০১ শতাংশ।
জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ বাংলাদেশ:
বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের (১৪৪,০০০ বর্গকিলোমিটার) তলদেশ থেকে ১০ মিটার ইতোমধ্যেই সমুদ্রগর্ভে হারিয়ে গেছে। এক ভূতাত্ত্বিক জড়িপে দেখা গেছে, সমুদ্রগর্ভে যাওয়া প্রতি মিটার সমান বাংলাদেশের মোট ভূখন্ডের ১৫ শতাংশ হারিয়ে যাওয়া। ১৯৯৩ থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে ৭ মিটার তলিয়ে গেছে বাংলাদেশের। অব্যাহতভাবে এই প্রক্রিয়া চলতে থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ সমুদ্রগর্ভে চলে যাবে। আর এর ফলে বসত হারাবে এক হাজার পাঁচশ লাখ মানুষ। বাংলাদেশের মানুষ ইতোমধ্যেই জলবায়ু পরিবর্তনের নগ্ন থাবায় আক্রান্ত। সিডর, নার্গিস, বিজলী, আইলার মতো সাইক্লোনগুলো বাংলাদেশের ওপর দিয়ে অতি সম্প্রতি বয়ে গেছে। যার ফলে বাংলাদেশের উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোর পানিতে ঢুকে গেছে নোনা জল। ধ্বংস হয়ে গেছে ফসলী জমি।
উন্নত দেশগুলোকেই নিতে হবে দায়ভার:
উন্নয়নশীল দেশুগুলোর অর্থনীতি এমনিতেই দীর্ঘদিনের উপনিবেশিক শাসনের কারণে ধ্বংস প্রায় হয়ে গেছে। আর তাই উন্নত দেশুগুলোকেই জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয়ক্ষতি নিরসনে দায়িত্ব নিতে হবে। বাংলাদেশের মতো গরীব দেশের অর্থনীতি চাঙ্গাসহ অবকাঠামোগত উন্নয়নে তাদের এগিয়ে আসতে হবে। একইসঙ্গে জ্বালানি সক্ষমতা অর্জন, মাথাপিছু আয়ের বৈষম্য দূরীকরণ, শিক্ষা বৈষম্য দূরীকরণে কাজ করতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯০৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ০১, ২০১১