ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশে করোনার জাল সনদের রমরমা ব্যবসা: নিউ ইয়র্ক টাইমস

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৪৯ ঘণ্টা, জুলাই ১৬, ২০২০
বাংলাদেশে করোনার জাল সনদের রমরমা ব্যবসা: নিউ ইয়র্ক টাইমস

মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে বাংলাদেশের কিছু হাসপাতালে ভুয়া করোনা সার্টিফিকেট বিক্রির ঘটনায় কেবল দেশেই নয়, সমালোচনা চলছে বিশ্বব্যাপী। সম্প্রতি ইতালিতে ভুয়া করোনা সার্টিফিকেট নিয়ে যাওয়া বেশ কিছু বাংলাদেশিকে চিহ্নিত করার পর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিষয়টি নজরে আসে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এ ঘটনায় বড় করে সংবাদ পরিবেশন করছে। এবার এ বিষয়ে প্রতিবেদন করেছে প্রভাবশালী মার্কিন সংবাদমাধ্যম ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’। 

বৃহস্পতিবার (১৬ জুলাই) ‘বাংলাদেশে জাল করোনা সনদ বেচার রমরমা ব্যবসা’ শিরোনামে নিউ ইয়র্ক টাইমস ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে ভুয়া করোনা সার্টিফিকেট দেওয়া রিজেন্ট হাসপাতাল, এর মালিক সাহেদ করিম, জেকেজি ও ডা. সাবরিনা-আরিফুল দম্পতির প্রতারণাসহ বাংলাদেশে করোনার বিভিন্ন অব্যবস্থাপনার চিত্র তুলে ধরা হয়।

    

প্রতিবেদনে রিজেন্ট হাসপাতাল কর্তৃক ইতালিসহ বিভিন্ন দেশের বাংলাদেশী অভিবাসী শ্রমিকদের জাল করোনা সার্টিফিকেট দেওয়ার প্রসঙ্গ তুলে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার দেশটির অভিবাসী শ্রমিকদের কাছে হাজার হাজার জাল করোনা সনদ বিক্রি করা এক হাসপাতাল মালিককে গ্রেফতার করেছে। ওই হাসপাতাল পরীক্ষা না করেই অভিবাসী শ্রমিকদের ভুয়া করোনা নেগেটিভ রিপোর্ট সরবরাহ করে।  

বুধবার (১৫ জুলাই) নারীর ছদ্মবেশে সীমান্ত দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় মোহাম্মদ সাহেদ নামের ওই হাসপাতাল মালিককে আটক করা হয় বলে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। দেশটির পুলিশ জানায়, বিভিন্ন অপরাধে অভিযুক্ত সাহেদ মাথা থেকে পা পর্যন্ত বোরখায় নিজেকে ঢেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন।  

...

গত দেড় সপ্তাহ ধরে দেশটির তদন্ত কর্মকর্তারা সাহেদের রিজেন্ট হাসপাতালের প্রতারণা বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য জানতে পেরেছেন। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় তার হাসপাতাল। তিনি ৫ হাজার করে টাকার বিনিময়ে হাজার হাজার করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট বিক্রি করে আসছিলেন।  

দেশটিতে আটকে পড়া অভিবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকরা বর্তমানে এই সার্টিফিকেট পেতে মরিয়া। ফলে সেখানে জাল সার্টিফিকেটের বিশাল এক বাজার তৈরি হয়েছে। এই অভিবাসী শ্রমিকরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মুদি দোকান-আড়তে কাজ করা, রেস্তোরার টেবিল পরিষ্কার করা, রাস্তায় পানি বিক্রি করাসহ বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত। করোনা পরিস্থিতিতে দেশে গিয়ে আটকে পড়ায় এখন তারা কর্মক্ষেত্রে ফিরতে ব্যাকুল।  

কাজে যোগ দেওয়ার শর্ত হিসেবে কর্তৃপক্ষ করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট দাবি করায় সম্প্রতি এ ধরনের জাল সার্টিফিকেট নিয়ে বাংলাদেশ থেকে ইতালিতে ফেরেন অনেক শ্রমিক।

কয়েক দিন আগে এ ধরনেরই ভুয়া করোনা সনদ নিয়ে যাওয়া অন্তত ৩৭ বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিককে ইতালিতে চিহ্নিত করা হয়, যাদের করোনা পজিটিভ পাওয়া যায়। এর প্রতিক্রিয়ায় ইতালির স্বাস্থ্যমন্ত্রী রবার্তো স্পেরানজা বাংলাদেশ থেকে ইতালিতে সব ধরনের ফ্লাইট বহিষ্কারের নির্দেশ দিয়েছেন। গত সপ্তাহে রোম ও মিলান বিমানবন্দর থেকে এ ধরনের ১৬৮ বাংলাদেশিকে নিজেদের দেশে ফেরত পাঠানো হয়।

সার্বিক প্রেক্ষাপটে বৃহস্পতিবার (১৬ জুলাই) বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, সম্প্রতি ইতালিতে যাওয়া প্রায় ১ হাজার ৬০০ বাংলাদেশি ভুয়া করোনা সার্টিফিকেট নিয়ে যাননি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ইতালিতে যাওয়া কিছু কিছু বাংলাদেশি যথাযথভাবে অবশ্যপালনীয় কোয়ারেন্টিন বিধিনিষেধ পালন করেননি। সম্ভবত তাদের কারো কারো মাধ্যমে করোনা যেতে পারে।  
  
বাংলাদেশ সরকারের সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি ভুয়া করোনা সার্টিফিকেট সরবরাহের বিষয়টি নজরে এলে বাংলাদেশের পুলিশ রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক সাহেদকে গ্রেফতারে তৎপর হয়ে ওঠে। কিন্তু টের পেয়ে তিনি গা ঢাকা দেন বলে কর্তৃপক্ষ জানায়। পরে ৯ দিনের অনুসন্ধান শেষে বুধবার দেশটির সীমান্ত এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।  

করোনার ভুয়া সার্টিফিকেট কেলেঙ্কারি ছাড়াও সাহেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, আত্মসাৎ ও প্রতারণা সংক্রান্ত আরও অন্তত ৩০টি অপরাধের অভিযোগ রয়েছে বলে বাংলাদেশ পুলিশ সূত্রে জানা যায়। তিনি এর আগে ২ বছর জেল খেটেছেন বলেও জানিয়েছে তারা।

বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের সদস্য ফাইজুল ইসলাম জানান, সাহেদ চিহ্নিত অপরাধী। আমরা এ ধরনের অন্য অপরাধীদের ধরতেও কাজ করছি।  

সাহেদের এ অপকর্ম প্রসঙ্গে দেশটির অন্যতম জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, এটি ব্যাপকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে।  

অভিবাসী শ্রমিকদের ভুয়া সার্টিফিকেট দিয়ে প্রতারিত করা প্রসঙ্গে ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, দেশে এ ধরনের বেশ কিছু অপরাধী চক্র সক্রিয় আছে, যারা অভিবাসী শ্রমিকদের করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট দিচ্ছে, এবং পরিণামে অনেক মানুষের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে।  

বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সূত্রে জানা যায়, সাহেদের রিজেন্ট হাসপাতাল ১০ হাজারেরও বেশি করোনা সার্টিফিকেট দিয়েছে, যার বেশিরভাগই ভুয়া।  

গ্রেফতার ডাক্তার সাবরিনা

কেবল সাহেদই নয়, হাজার হাজার জাল করোনা সার্টিফিকেট দিয়ে প্রতারণার অভিযোগে সম্প্রতি ঢাকার আরও একটি ল্যাবরেটরির দুই চিকিৎসককে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ধরনের প্রতারণা করা অন্যদের ধরতেও আইনপ্রয়োগকারী বিশেষ বাহিনী তৎপর রয়েছে বলে দেশটি জানিয়েছে।  

বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি তুলে ধরে নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, এ দেশটির করোনা পরিস্থিতি মূলত অস্পষ্ট। ১৬ কোটিরও বেশি অধিবাসীর বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত করোনা শনাক্ত হয়েছে ২ লাখের মতো মানুষের। যদিও দক্ষিণ এশিয়ায় বর্তমানে করোনার প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু সেই তুলনায় বাংলাদেশে করোনা পরীক্ষার হার তুলনামূলক কম। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারি হিসাব যা দেখাচ্ছে, দেশটিতে প্রকৃত করোনা আক্রান্ত এর চেয়ে অনেক বেশি।   

বাংলাদেশের পরিচয় তুলে ধরে নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ এশিয়ার অতি দরিদ্র দেশগুলোর একটি। দেশটির লাখ লাখ শ্রমিক অভিবাসী হয়ে বিশ্বের নানা দেশে কাজ করেন। তাদের পাঠানো টাকা বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি। করোনা পরিস্থিতিতে দেশে ফিরে যাওয়া অনেক অভিবাসী শ্রমিকই কাজ খুইয়েছেন। সার্বিক বাস্তবতায় এখন তারা কর্মক্ষেত্রে ফিরতে উদগ্রীব।  

ইতালির মিলানে একটি রেস্তোরার রান্নাঘরে কাজ করেন বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিক তাহের হুসাইন। নিউ ইয়র্ক টাইমসকে তিনি বলেন, সম্প্রতি ইতালির পত্রিকাগুলো বাংলাদেশে করোনার প্রকোপ বাড়ছে, লাগাতার এ ধরনের সংবাদ প্রকাশ করছে। এতে করে লোকজন আমাদের দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে, যেনবা আমরা সবাই করোনা আক্রান্ত।  

বাংলাদেশ সময়: ২১৪৬ ঘণ্টা, জুলাই ১৬, ২০২০ 
এইচজে 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।