ঢাকা: ভীতিকর সঙ্গীতের সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হলো পর্দা। দেখানো হলো একের পর এক কিছু ভয়ঙ্কর দৃশ্য।
নেপথ্যে ধারা বর্ণনায় গম্ভীর আওয়াজ শুনা যাচ্ছে: ‘এই হলো আমেরিকায় ক্রমবর্ধমান মুসলিমদের আসল কর্মকাণ্ড’, ‘আমেরিকায় অনুপ্রবেশ এবং কর্তৃত্ব করার কৌশল... এটাই হলো সেই যুদ্ধ যার ব্যাপারে তুমি কিছুই জানো না। ’
এটা হলো ফিচার ফিল্মের সমান দৈঘ্যের একটি তথ্যচিত্র। নাম দেওয়া হয়েছে ‘ দ্য থার্ড জিহাদ’ বা ‘তৃতীয় ধর্মযুদ্ধ’। চলচ্চিত্রের ‘দ্য ১৪০০- ইয়ার ওয়ার’ পর্বে বর্ণনা করা হয়েছে তিনটি পর্যায়ের জিহাদ রয়েছে: নবী মোহাম্মদের সময় প্রথম, দ্বিতীয়টি মধ্যযুগে এবং তৃতীয় জিহাদ এখন পশ্চিমে যা এখন শুরু হয়েছে।
নিউইয়র্ক পুরিশ বিভাগের সহস্রাধিক পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে এটি দেখানো হয়েছে। এর মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে মুসলিম বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে এই নিয়ে বিতর্ক এখন তুঙ্গে।
৭২ মিনিটের এই চলচ্চিত্রটি ক্ল্যারিঅন ফান্ড নামে একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে নির্মিত হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা বোর্ডে রয়েছেন সিআইএ’র একজন সাবেক কর্মকর্তা এবং সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের উপ প্রতিরক্ষামন্ত্রী।
তবে ক্ল্যারিঅন ফান্ডের অর্থায়নে মুসলিমদের আক্রমণ করে এরকম চলচ্চিত্র নির্মাণ এই প্রথম নয়। এর আগে তারা ‘ওয়ার অন দ্য ওয়েস্ট’ নামে একটি চলচ্চিত্র তৈরি করেছিল। এতে সব ধরনের সহযোগিতা করে ক্যাসিনো মুঘল শেলডন অ্যাডেলসন। এই ব্যক্তি ইসরায়েলের বড় সমর্থক। এই শেলডন যুক্তরাষ্ট্রে আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রাথমিকে রিপাবলিকান দলের মধ্যে পুনর্বিন্যাস আনতে কাড়িকাড়ি টাকা ঢেলেছেন। আর এর সুফল ভোগ করেছেন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী নিউট গিংগ্রিচ।
নির্বাচনী প্রচারণার সময় এই গিংগ্রিচ একদিন বলেছিলেন, ফিলিস্তিনিরা অনাহুত। এরা অন্য কোথাও গিয়ে বসবাসের জায়গা খুঁজে নিতে পারে। তারা কখনই এই ভূখণ্ডে ছিল না।
তবে প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে এরকম আক্রমণাত্মক চলচ্চিত্র প্রদর্শনী চলার খবর ২০১১ সালের জানুয়ারিতে জানাজানি হয়ে যায়। কিন্তু একজন শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা তা অস্বীকার করেন। পরে অবশ্য ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ভুলবশত মিনিট দুই গুটিকয়েক কর্মকর্তাকে ওই ধরনের দৃশ্য দেখানো হয়েছিল।
এর এক বছর পর এখন যুক্তরাষ্ট্রের তথ্য অধিকার আইনের ভিত্তিতে পুলিশ বিভাগ থেকে এমন কিছু নথিপত্র পাওয়া গেছে যা আরেকটি গুরুতর সত্য ঘটনা উন্মোচিত করে। দ্য থার্ড জিহাদ চলচ্চিত্রে পুলিশ কমিশনার রেমন্ড ডব্লিউ ক্যালির সাক্ষাতকার রয়েছে। পুলিশের অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে, এক বছর মেয়াদি প্রশিক্ষণে চলচ্চিত্রটি ধারাবাহিকভাবে টানা তিন মাস দেখানো হয়েছে।
এর দর্শক ছিলেন কমপক্ষে এক হাজার ৪৮৯ জন পুলিশ কর্মকর্তা, এদের মধ্যে লেফটেন্যান্ট থেকে গোয়েন্দা এবং টহল পুলিশ কর্মকর্তারা ছিলেন।
২০১১ সালের ২৩ মার্চ একাডেমির কমান্ডার জানিয়েছিলেন, তথ্যচিত্রটি প্রদর্শনের সময় উপস্থিত ছিলেন- ৬৮ জন লেফটেন্যান্ট, ১৫৯ জন সারজেন্ট, ৩১ জন গোয়েন্দা এবং এক হাজার ২৩১ জন টহল পুলিশের কর্মকর্তা। কিন্তু পুলিশ বিভাগ কখনই এই তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ করেনি।
নিউইয়র্ক নগরীতে বসবাসকারী বিশাল মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে যাওয়া পুলিশ বিভাগের দ্বন্দ্ব বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে এই খবর সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। নিছক সন্দেহের বশে মুসলিম সম্প্রদায়ের বাড়ি বাড়ি তল্লাশি এবং আগ্রাসি গোয়েন্দাগিরির কারণে মুসলিমরা পুলিশের ওপর ক্ষুব্ধ। কিন্তু পুলিশ এ ব্যাপারে কখনই ভুল স্বীকার করেনি বরং সন্ত্রাসী ষড়যন্ত্রের গোপন তথ্যের ভিত্তিতে তারা এটা করছে বলে তাদের দাবি।
এ ঘটনার পর সিটি কাউন্সিলের সদস্য, নাগরিক অধিকার আইনজীবী এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতারা অভিযোগ করে বলছেন, পুলিশ বিভাগ নাগরিক অধিকার পদদলিত করেছে। তারা দেশের অভ্যন্তরে এবং বিদেশের মাটিতে গুপ্তচর বৃত্তির রীতি পার্থক্যবোধক সীমারেখা অস্পষ্ট করে তুলেছে। পুলিশ মুসিলমদের মধ্যে ভীতির বীজ বপন করেছে।
নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের দি ব্রেনান সেন্টার ফর জাস্টিসের পরিচালক ফায়জা প্যাটেল বলেন, ‘এ ব্যাপারে পুলিশ বিভাগের প্রতিক্রিয়া ছিল সরাসরি প্রত্যাখান আর তাদের কাছ থেকে তথ্য বের করতে রীতিমত সংগ্রাম করতে হয়েছে। ’
যুক্তরাষ্ট্রের তথ্য অধিকার আইনের সহায়তায় এই প্রতিষ্ঠানটিই তথ্যচিত্রটির ব্যাপারে নথি এবং তথ্য সংগ্রহ ও প্রকাশ করেছে। ফায়জা বলেন, ‘কর্তৃপক্ষ তাদের কর্মকর্তাদের তথ্যচিত্রটি ঠিকই প্রদর্শন করেছিল কিন্তু জানতে চাইলে আমাদের কাছে তারা পাথরের দেয়ালের মতো নিরুত্তোর ছিল। ’
দি ভিলেজ ভয়েস’র কলামিস্ট টম রবিন্স পুলিশ বিভাগের এই কাণ্ডের খবর প্রথম প্রকাশ করেন। পরে ব্রেনান সেন্টার এ ব্যাপারে তথ্য দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়ে আবেদন করে।
পুলিশ কমিশনার রেমন্ড ডব্লিউ ক্যালিও থার্ড জিহাদের ওয়েবসাইটে একজন সাক্ষাতকার প্রদানকারীর তালিকায় রয়েছেন। কিন্তু পুলিশ বিভাগের প্রধান মুখপাত্র পল জে ব্রাউন ইমেইলে জানিয়েছেন, এই তথ্যচিত্রটির নির্মাতা ওই সাক্ষাতকারের অংশটি পরে ওয়েবসাইট থেকে প্রত্যাহার করেছেন।
তবে কশিনার এ ব্যাপারে বলছেন, তিনি ওই অংশ বাদ দেওয়া বা তিনি এ কাজে তাদের সহায়তা করেননি এই বুঝিয়ে দেওয়ার কোনও অনুরোধ নির্মাতাদের করেননি।
অবশ্য ব্রেনান সেন্টারের সংগৃহীত নথিপত্রে এই বিষয়টি পরিষ্কার নয় যে, কোন কোন কর্মকর্তা এই তথ্যচিত্রটি প্রদর্শনের অনুমোদন দিয়েছেন। বিভাগের আইনজীবীরা অভ্যন্তরীণ অনেক তথ্য মুছে ফেলেছেন বা গায়েব করে দিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
এ দিকে অর্থ যোগানদাতা ক্ল্যারিঅন ফান্ডের কাছে গত কয়েক দিনে অসংখ্যবার ফোন করা হয়েছে কিন্তু একটা কলেও তারা সাড়া দেয়নি।
এই তথাকথিত লাভজনক প্রতিষ্ঠানটি আয়িশ হাতোরাহ নামের একটি ইসরায়েলি সংগঠনের সঙ্গে কর্মকর্তা ভাগাভাগি করে। এই সংগঠন ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের সঙ্গে সীমানা নির্ধারণ নিয়ে কোন সমঝোতা করার বিরোধী। ‘দ্য থার্ড জিহাদ’র নির্মাতা রাফায়েল শোর আয়িশ হাতোরাহ‘র হয়েও কাজ করেন।
তবে ক্ল্যারিওনের অর্থ কীভাবে আসে সে এক রহস্য। কেন্দ্রীয় আয়কর নথিতে দেখা যাচ্ছে, তাদের রাজস্ব বার্ষিক ১০ লাখের মধ্যে উঠানামা করে। তবে ২০০৮ সালে তারা আয় এক কোটি ৪৩ লাখ ডলার দেখানো হয়েছে। একই বছর তারা ‘অবসেশন: রেডিক্যাল ইসলামস ওয়ার এগেইনস্ট দ্য ওয়েস্ট’ চলচ্চিত্র প্রযোজনা করে। ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে অঙ্গরাজ্যের ইলেক্টোরালে এই চলচ্চিত্রের ১০ লাখেরও বেশি ডিভিডি কপি বিতরণ করে।
মুসলিমদের বিরুদ্ধে এমন পশ্চিমা প্রোপাগান্ডা অবশ্য নতুন কিছু নয়। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান, এমিনকি ইউনিভার্সিটিগুলোতে মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিভাগের পাঠ্যসূচি নির্ধারণের কৌশল এবং হলিউডের অনেক চলচ্চিত্রও এই প্রোপাগান্ডায় জড়িত রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞরাদের গবেষণার ধরণও তাই। বড় বড় করপোরেট কোম্পানি অর্থায়নে এরা মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে গবেষণা নিবন্ধ বের করে যেখানে কোম্পানির স্বার্থ সুপ্রতিষ্ঠিত থাকে। এদের মধ্যে বেশিরভাগের আচরণই সাংবাদিকসুলভ। এরা প্রকৃত অবস্থা বুঝার চেষ্টা করে না। গবেষণার জন্য নির্ভর করে পশ্চিম লেখকদেরই কিছু বই পুস্তক। একারণে মুসলিম মানসিকতা বুঝা তাদের পক্ষে দুসাধ্য। এদের সবচে বড় যে সীমাবদ্ধতা তা হলো, এরা আরবি ভাষাই জানে না। সুতরাং গবেষণা যতোটুকু হয় তা একেবারেই মার্কিন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট যা পক্ষপাতিত্ব দোষে দুষ্ট হতে বাধ্য।
বাংলাদেশ সময়: ২২০১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৬, ২০১২