ঢাকা, শনিবার, ২২ ভাদ্র ১৪৩২, ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

আন্তর্জাতিক

ভয়ঙ্কর কুসংস্কার

জাহাঙ্গীর আলম, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০:৪৯, ফেব্রুয়ারি ৫, ২০১২
ভয়ঙ্কর কুসংস্কার

ঢাকা: আনুমানিক ১২ বছরের দুধসাদা এক শিশু বসে আছে। পাশেই তার কৃষ্ণাঙ্গ বাবা।

হঠাৎ আরেক কৃষ্ণাঙ্গ এসে শিশুটিকে আক্রমণ করে বসল। ছেলেটার আর্তচিৎকারে ঘর থেকে মা ছুটে এসে তাকে উদ্ধার করলেন। কিন্তু ততোক্ষণে একটি হাতের কবজি পর্যন্ত কেটে নিয়ে গেছে আক্রমণকারী।   অথচ পাশেই বসে থাকা বাবা কিছুই বললেন না!
 
এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য কোনো থ্রিলার উপন্যাস বা ভৌতিক সিনেমার নয়। আক্রমণকারী নরখাদকও নয়। এটি একটি ভয়ঙ্কর সত্য এবং অতি সাম্প্রতিক ঘটনা। দক্ষিণ আফ্রিকার দেশ তানজানিয়ায় অহরহ ঘটছে এমন বর্বর ঘটনা।

এমন ঘটনার শিকার হচ্ছে আলবিনোরা। জন্মগতভাবে যাদের নখ, চুল, চোখ থেকে শুরু করে সর্বাঙ্গ একেবারে সাদা তাদের আলবিনো বলা হয়। আমাদের দেশে এদের কুষ্ঠ রোগী বলে ভুল করে অনেকে। এটা এক প্রকার জিনগত সমস্যা। এদের শরীরের রং উৎপাদনকারী মেলানিন থাকে না। গরমের দেশে যেখানে তীব্র সুর্যালোক রয়েছে, উজ্জল আলোর প্রতি এদের ত্বক অত্যন্ত সংবদেনশীল। তাপে ত্বক পুড়ে যাওয়া বা স্কিন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এছাড়া এদের দৃষ্টিশক্তিও ক্ষীণ।

ভৌগলিক বা নৃতাত্বিক নির্বিশেষে এই সমস্যা বিশ্বব্যাপী ২০ হাজারে একজনের দেখা যায়। তবে এ রোগ ছোঁয়াচে নয়।

কিন্তু এই শারীরিক বৈশিষ্ট্যই তাদের কাল হয়েছে। বিশেষ করে সাব-সাহারান আফ্রিকায় তাদের নিয়ে নানা কুসংস্কার এবং অন্ধবিশ্বাস প্রচলিত আছে।

অনেকে মনে করে, এদের জাদুকরী ক্ষমতা আছে। এদের মধ্যে অতিমানবীয় কিছু রয়েছে। এই সাদা চামড়ার আফ্রিকানদের কালো চামড়ার সগোত্রীয়রা মনে করে-এরা মানুষ নয়; প্রেতাত্মা বা ভূত, এরা কখনো মরে না, বাতাস ও বৃষ্টির মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায় মাত্র। ‘অতিমানবীয়’ এই মনুষ্য গোষ্ঠীকে অনেকে ভয় পায়।

এসব কারণে মারাত্মক দুর্ভোগে পড়েছে আলবিনোরা। আফ্রিকার অনেক সম্প্রদায়ের মধ্যে চরম ‘ভীতিকর প্রাণী’, ‘অভিশপ্ত’ আলবিনোরা সমাজে চরম বৈষম্যের শিকার হয়। অনেক সমাজে এরা অবাঞ্ছিত, কোণঠাঁসা।

পূর্বে ঐতিহ্যগতভাবে (প্রথাগতভাবে) ধাত্রীরা অ্যালবিনো শিশুদের মৃত ঘোষণা করা হতো এবং তাদের গোপনে কবর দেওয়া হতো। তবে এসব ছাড়িয়ে সর্ব সম্প্রতি যে ভয়ঙ্কর প্রবণতা তৈরি হয়েছে তাতে আলবিনোদের অস্তিত্বই এখন হুমকির মুখে।

গত পাঁচ বছরে তানজানিয়াতে এদের অবস্থা শোচণীয় পর্যায়ে নেমে গেছে। ডাকিনী বিদ্যায় শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাজে লাগে- এই উদ্ভট বিশ্বাসে ব্যাপকভাবে আলবিনো হত্যা করা হচ্ছে। ঘটনাটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের চাপে তানজানিয়া সরকার ব্যবস্থা নেওয়ার পরও অবস্থার খুব একটা উন্নতি হচ্ছে না। ২০০৮ সালে তানজানিয়াতে কমপক্ষে ৬২ জন আলবিনো খুন হয়েছে। এদের মধ্যে ১৬ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে নেওয়া হয়েছে। ১২ জনের মৃতদেহ কবর থেকে তুলে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংগ্রহ করা হয়েছে।
albino
অনেকের হিসাবে এ পর্যন্ত এ সংখ্যা শত শত। বিগত ২০১১ সালেই কমপক্ষে ৬৩ জন আলবিনো তানজানিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে খুন হয়েছে যাদের মধ্যে শিশুও রয়েছে।

এদের হত্যার পেছনে নতুন আরেক কুসংস্কার যুক্ত হয়েছে। অনেকের বিশ্বাস, আলবিনো কিশোরীর সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক করলে মারণব্যাধি এইডস থেকে আরোগ্য লাভ হয়। ঠিক একারণে ইদানীং কিশোরী ধর্ষণ ও হত্যাও বেড়েছে।

তানজানিয়ার ৪ কোটি ৭ লাখ মানুষের মধ্যে ১৪ লাখই এইডসের জীবাণু এইচআইভি ভাইরাসের বাহক।

আর আলবিনো শিকারীরা কিশোরী ধর্ষণের পাশাপাশি তাদের বিভিন্ন অঙ্গ যেমন, রক্ত, চুল, যৌনাঙ্গ, হাড় এসব সংগ্রহ করে। প্রচলিত ডাকিনী বিদ্যায় এগুলো সৌভাগ্য আয়নকারী বলে বিশ্বাস রয়েছে।

এমন একটি অরক্ষিত অবস্থার কারণে তানজানিয়ায় আলবিনোদের সঠিক সংখ্যাও নিরূপণ করা যায় না। সরকারি হিসাবে মাত্র ৫ হাজার আলবিনো রয়েছে। কিন্তু আলবিনো অ্যাসোসিয়েশনের দাবি এদের সংখ্যা দেড় লাখের কম হবে না।

প্রচলিত সংস্কার জনিত লজ্জা এবং শিকারীদের আক্রমণের ভয়ে পরিবার তাদের কথা গোপন রাখে। আর লোকলজ্জার ভয়ে কাউকে জানায় না বলে ঠিক কতোজন কিশোরী ধর্ষণের শিকার হচ্ছে তারও সঠিক সংখ্যা জানা সম্ভব হচ্ছে না।

তানজানিয়া অ্যালবিনো সোসাইটির সেক্রেটারি জেনারেল জিহাদা সেম্বো বলেন,  জীবন রক্ষায় আমাদের জন্য দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তিনি বলেন, ‘একজন অ্যালবিনো হয়ে তুমি যদি কাজের জন্য রাতে বাইরে যাও, তবে তোমার নিরাপদে ঘরে ফেরা অনিশ্চিত। ঘুমানোর পর আবার চোখ মেলে তাকাতে পারবে কি না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ’

চোখে মুখে হতাশা নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা রাষ্ট্রপতি জাকায়া কিকোয়েটের কাছে গিয়েছিলাম, তিনি আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। সে রাতে শান্তিতে ঘুমিয়েছি বটে; কিন্তু পরদিন সকালেই জানতে পারি গভীর রাতে একজন অ্যালবিনো খুন হয়েছে। ’
 
সরকার বলেছে, বেশিরভাগ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে পশ্চিম তানজানিয়ায়। পুলিশ এসব ঘটনায় জড়িত সন্দেহভাজন ৫৩ জনকে গ্রেপ্তারও করেছে। ঘটনার শিকার ১২ বছরের ওই শিশুটির বাবাকে পরে আটক করে থানায় নেওয়া হয়েছে। এরকম ১৬ বছরের এক কিশোরীর খবর পাওয়া গেছে অপরিচিত এক লোক যার বাম হাতটি কুঠার দিয়ে কেটে নিয়ে গেছে।

অ্যালবিনোদের অঙ্গ-প্রতঙ্গের এই ভয়ঙ্কর বর্বর ব্যবসা এখন তানজানিয়ার বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। গত বছর প্রতিবেশি দেশ বুরুন্ডিতে অ্যালবিনো হত্যার তিনটি ঘটনা ঘটেছে। কর্মকর্তারা বলেছেন, আক্রমণকারীরা তানজানিয়ার লোকদের অর্ডার পাচ্ছেন। তারা মোট অংকের টাকার বিনিময়ে বুরুন্ডির আলবিনোদের হত্যা করে তানজানিয়াতে সরবরাহ করে।

২৪ জন অ্যালবিনো হত্যা আতঙ্কে গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে গেছে বলে স্বয়ং প্রশাসনই স্বীকার করেছে। এসব ঘটনায় আটক দু’জন স্বীকারুক্তিতে জানিয়েছে, অ্যালবিনোদের অঙ্গ-প্রতঙ্গের জন্য তানজানিয়ার কিছু লোক তাদের বুরুন্ডিয়ান ১০ লাখ ফ্রাংক (৮৪০ ডলার) দিয়েছে।

তানজানিয়ার সরকার অবশ্য বলছে, এই অরাজকতা বর্বরকা বন্ধে তারা যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে সরকারের প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। অথবা সরকারের ব্যবস্থা খুব একটা কার্যকর হচ্ছে না। এখনো আলবিনো হত্যা অব্যাহত রয়েছে বলে গণমাধ্যমে প্রায়ই খবর  আসে।

বাংলাদেশ সময়: ২০২৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৫, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।