ঢাকা : পর্বতময় ভূ-প্রকৃতির দ্বীপরাষ্ট্র জাপান । ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ভয়ঙ্কর রকম ভূমিকম্পপ্রবণ এই দেশ ।
এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিশাল এলাকার অবকাঠামো স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে দীর্ঘ মেয়াদি এবং সবচে ভয়াবহ ক্ষতিটা হয়েছে ফুকোশিমা পরমাণু কেন্দ্রের। পরমাণু কেন্দ্রে ফাটল সৃষ্টি হওয়ায় তেজস্ক্রিয় পানি সাগরে ও আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ার কারণে যে ঝুঁকি দেখা দিয়েছে তা বহুদিন বয়ে বেড়াতে হবে দেশটিকে।
১১ মার্চ রোববার জাপানের ইতিহাসে সবচে বড় এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের এক বছর পূর্ণ হবে। প্রলয়ঙ্করী এ দুর্যোগের এক বছর অতিক্রান্ত হলেও তেজস্ক্রিয় ঝুঁকি কাটিয়ে পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অর্থনীতির ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে সমৃদ্ধ এ দেশ।
দুর্যোগে সবচে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় উপকূলের সাধারণ মানুষ বিশেষ করে মৎস্যজীবী মানুষেরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে এখনও চালিয়ে যাচ্ছে নিরন্তর সংগ্রাম।
পরমাণু কেন্দ্র ফুকোশিমা এখনো ভুতুড়ে শহর। জলোচ্ছ্বাসে তছনছ হয়ে যাওয়া মিয়াকো শহরের সর্বত্র ধ্বংসের ছাপ। সমুদ্রতীরবর্তী এলাকাগুলোতে শরণার্থী শিবিরের তাঁবু। এখানকার ভাগ্যাহত মানুষের কাছে আবার পূর্বের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়াটা যেন স্বপ্ন। দুর্যোগের পর দু’বছরের মধ্যে ধ্বংসপ্রাপ্ত বসতবাড়ি মেরামত সম্ভব হবে বলে সরকারের আশা। তবে আগামী ৪ বছরেও তা সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে।
সেই ভয়ঙ্কর দিন : ২০১১ সালের ১১ মার্চ জাপানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় উপকূলে প্রথমে আঘাত হানে কয়েক মিটার উচ্চতার সামুদ্রিক ঢেউ। সেই বিধ্বংসী ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে যায় বসতবাড়ি, হাজার হাজার গাড়ি, হেলিকপ্টার। প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ভেঙে পড়ে ফুকুশিমা পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দেয়ালও৷
বিশ্বের ইতিহাসে রেকর্ড করা ষষ্ঠ শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানার পর সৃষ্ট সুনামির তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় জাপানের উত্তর-পূর্বাঞ্চল। রিখটার স্কেলে ৮ দশমিক ৯ মাত্রার ওই প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে রাজধানী টোকিওসহ জাপানের বিস্তীর্ণ এলাকা। কম্পন অনুভূত হয় দেড় হাজার মাইল দূরে বেইজিং থেকেও। ভূমিকম্পের পর পরই উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় উপকূলে আছড়ে পড়ে ৩৩ ফুট উচ্চতার সুনামি।
সমুদ্রের বিশাল ঢেউ প্রচণ্ড আক্রোশে দূর থেকে ডাঙায় এনে আছড়ে ফেলে জলযানগুলো। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয় ফুকুশিমা, মিয়াগি, টোকিও, ইবারাকি, চিবা, কানাগাওয়া, টাকাহাগি ও টোচিগি। প্রাণ হারায় ১৫ হাজারেরও বেশি মানুষ।
ভূমিকম্পের পরপরই প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলবর্তী ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ও রাশিয়া এবং কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলসহ মোট ৫৩টি দেশে সুনামি সতর্কতা জারি করা হয়। বন্ধ রাখা হয় জাপানের সব বন্দরের কার্যক্রম। উপকূলীয় শহর মিয়াকোতে নেমে আসে মহাবিপর্যয়। ভূমিকম্পে দুই ফুটের মত দেবে যায় এই শহর। দেশের ৫৪টি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে ১১টিই তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। ফলে অনেক এলাকা আবার বিদ্যুৎ সরবরাহের অভাবে অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকে টানা অনেক দিন।
অতীতের রেকর্ড : বিশ্বের ইতিহাসে জাপানের ৮ দশমিক ৯ মাত্রার এই ভূমিকম্পের চেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়েছে মাত্র ৫টি। এগুলো হলো- ১৯৬০ সালের ২২ মার্চ চিলিতে (৯ দশমিক ৫), ১৯৬৪ সালের ২৭ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় (৯ দশমিক ২), ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর ইন্দোনেশিয়ায় (৯ দশমিক ১), ১৮৬৮ সালের ১৩ আগস্ট পেরুতে (৯ দশমিক ০) এবং ১৯৫২ সালের ৪ নভেম্বর রাশিয়ায় (৯ দশমিক ০) ।
এছাড়া ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রায় এক প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পের পর সৃষ্ট সুনামিতে অন্তত ১৪টি দেশের ২ লাখ ৫০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়।
জাপানে এর আগে সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছিল ১৯২৩ সালে। ৭ দশমিক ৯ মাত্রার ওই ভূমিকম্পে প্রাণহানি ঘটেছিল ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষের। ১৯৯৫ সালে কোবে নগরীতে ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক মূল্য ধরা হয় ১০ হাজার কোটি ডলার। যেখানে ২০০৪ সালে ব্যাপক বিধ্বংসী সুনামিতে ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক মূল্য ছিল ১ হাজার কোটি ডলার।
ভূমিকম্পের কারণ : ভূমিকম্প প্রধানত ভূ-তাত্ত্বিক ত্রুটির কারণে হয়ে থাকে। এছাড়াও আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, ভূমিধস, খনি বিস্ফোরণ, পরমাণু বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ এসব কারণেও ভূমিকম্প হতে পারে।
শক্তিশালী ভূমিকম্প থেকে সমুদ্রের জলরাশিতে যে আন্দোলনের সৃষ্টি হয় তা থেকেই সুনামির উৎপত্তি। ‘সুনামি’ জাপানি শব্দ, এর অর্থ- পোতাশ্রয়ী তরঙ্গ। সাইক্লোন, টাইফুন, হ্যারিকেনের ক্ষেত্রে প্রতি ১০ সেকেন্ড অন্তর সমুদ্রে ১৫০ মিটার পর্যন্ত তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের ঢেউ সৃষ্টি হয়। আর সুনামি বৃত্তাকারে প্রতি সেকেন্ডে ২শ মিটার কিংবা ঘণ্টায় ৭শ কিলোমিটার বেগে ছুটতে পারে। উৎপত্তিস্থল থেকে ১০ হাজার কিলোমিটার দূরেও অব্যাহত থাকে এর দানবীয় তাণ্ডবলীলা।
প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তর অংশের ভূখণ্ড গুলোকে বিবেচনা করা হয় সুনামির মুক্তাঞ্চল হিসেবে। দক্ষিণ চীন সাগরেও সুনামির উদ্ভব হয়। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন সংলগ্ন সমুদ্রতল অনেক সক্রিয় আগ্নেয়গিরির অঞ্চল হওয়ার কারণে এলাকাটি ভূমিকম্পপ্রবণ।
হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের কাছে ৩৮ হাজার ৬শ’ কিলোমিটার লম্বা ‘রিং অব ফায়ার’ বা অগ্নিবলয় রয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো ভূ-কম্পের উৎপত্তিস্থল হিসেবে চিহ্নিত এ অঞ্চল।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের কিছু পরিসংখ্যান : অগ্ন্যুৎপাত, ভূমিকম্প, সুনামি, সামুদ্রিক ঝড়, বন্যা ইত্যাদিতে ৫২৬ সালে সিরিয়ায়, ১২২৮ সালে হল্যান্ডে, ১২৯০ সালে চীনের চেহলিতে, ১৬৪২ সালে চীনে, ১৭০৩ সালে জাপানের আইওয়া, ১৭৩৬ সালে জাপানের হোক্কাইদো শহরে, ১৭৩৭ সালে ভারতের কলকাতায়, ১৭৭৫ সালে পর্তুগালের লিসবনে, ১৭৭৯ সালে ভিসুভিয়াসের পাদদেশে পম্পেই ও হার কুলোনিয়াম শহরে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় নেমে আসে।
এছাড়া ১৯৪৬ সালে আলাস্কার ন্যালিউশিয়ান দ্বীপপুঞ্জে, ১৯৫২ সালে রাশিয়ার বামসার্কায়, ১৯৬০ সালে চিলি ও হাওয়াই দ্বীপে, ১৯৬৪ সালে আলাস্কার প্রিন্স উইলিয়াম সাউন্ডে, ১৯৬৬ সালে পেরুও হাওয়াইয়ে, ১৯৭০ সালে বাংলাদেশে, ১৯৭৫ সালে হাওয়াই দ্বীপে, ১৯৭৬ সালে চীনে, ১৯৭৭ সালে সুমাত্রায়, ১৯৯৪ সালে মিনডোবার ফিলিপিনস দ্বীপে, সম্প্রতি ভারতের গুজরাটে এবং সর্বশেষ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ভূমিকম্পে প্রাণ হারায় বহু মানুষ, ক্ষতি হয় বহু অবকাঠামোর।
বাংলাদেশ সময় : ০০২০ ঘণ্টা, মার্চ ১০, ২০১২