ঢাকা : ফ্রান্সে ঘটে গেছে দেশটির সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে আলোচিত রোমহর্ষক সিরিয়াল কিলিং। মোট ৩টি ঘটনার প্রথম দু’টিতে তিন সেনাকে হত্যা, অতঃপর সোমবার ইহুদি ধর্মীয় স্কুলে গুলি চালিয়ে তিন শিশুসহ চারজনকে হত্যা।
প্রথম হত্যাকাণ্ডে নিহত সেনারা উত্তর আফ্রিকার বংশোদ্ভূত মুসলিম। আর সোমবারের ঘটনায় নিহতদের সবাই ইহুদি। ঘটনার মোটিভ পরস্পর বিরোধী। ফরাসি পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে হত্যাকারী একজনই। কিন্ত কেন তাদের হত্যা করা হলো? নিরীহ শিশুদের প্রতি তার এত ক্ষোভই বা কেন? কে আছে এই রোমহর্ষক ঠাণ্ডা মাথার খুনগুলোর পেছনে?
এসব প্রশ্নে উত্তর জানতে ফরাসি পুলিশ শুরু করেছে তাদের সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় নরশিকার অভিযান। উদ্দেশ্য জীবিত বা মৃত যে কোনো উপায়ে হত্যাকারীকে খুঁজে বের করা।
১৯ মার্চ তুলুসের একটি ইহুদি স্কুলে গুলি চালিয়ে চারজনকে হত্যা করে অজ্ঞাত বন্দুকধারী। গত সপ্তাহে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিন সেনা নিহত হওয়ার সঙ্গে সোমবারের এই হামলার যোগাযোগ রয়েছে- এ ব্যাপারে ফরাসি পুলিশ নিশ্চিত।
ঘটনার শুরু গত ১১ মার্চ। এদিন তুলুস শহরে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন ফরাসি সেনাবাহিনীর এক সার্জেন্ট। ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ১৫ মার্চ ঘটলো একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। এবারের স্থান তুলুসের নিকটবর্তী মনতৌ শহর। এখানে একটি ক্যাশ মেশিনের (এটিএম বুথ) সামনে অপেক্ষারত অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন দুই সেনা। মারাত্মক আহত হয় আরো এক সেনা। নিহতদের প্রত্যেকেই উত্তর আফ্রিকান বংশোদ্ভূত।
এ দুটি ঘটনায় যখন সমগ্র ফ্রান্স আলোড়িত ঠিক সে সময়ই ঘটলো সোমবারের রোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডটি। ঘাতকের গুলিতে তুলুসের ওজার হাতোরাহ স্কুলের এক শিক্ষক এবং তিন শিশু নিহত হয় এদিন। এছাড়া অপর এক টিনেজ বালকও এ ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত হয়।
অভিভাবকরা যখন ছুটির পর তাদের সন্তানদের স্কুল থেকে নিচ্ছিলেন ঠিক তখনই ঘাতক তাদের ওপর গুলি ছুড়তে শুরু করে।
স্থানীয় প্রসিকিউটর মাইকেল ভালেট বর্ণনা দিলেন এ ঘটনার। স্কুল ছুটি হওয়ার সময় হত্যাকারী তার স্কুটারের পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। আশপাশে যারা ছিল তাদের প্রত্যেককে উদ্দেশ করে ঠাণ্ডা মাথায় গুলি চালায় সে।
নিহতদের মধ্যে রয়েছেন ফ্রান্স ও ইসরায়েলের দ্বৈত নাগরিক ৩০ বছর বয়সী রাব্বি (ইহুদি ধর্মযাজক) জোনাথন স্যান্ডলার এবং তিন ও ছয় বছর বয়সী তার দুই শিশু। মৃত চতুর্থ জন হলো বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষকের সাত বছরের কন্যা মিরিয়াম মনসোনেগো।
হামলার ঘটনায় ১৭ বছরের এক বালকও মারাত্মকভাবে আহত হয়। হত্যাকারী প্রথমে একটি নাইন এমএম পিস্তল ব্যবহার করে। গুলি চালানোর সময় এটি জ্যাম হয়ে গেলে সে .৪৫ ক্যালিবারের অপর একটি অস্ত্র বের করে ঠাণ্ডা মাথায় টার্গেট প্রাকটিস করে। আগের ঘটনায় নিহত তিন সেনাকে হত্যা করা হয়েছিল একই ক্যালিবারের (পয়েন্ট ৪৫) অস্ত্র দিয়ে।
পুলিশ এখন নিশ্চিত তুলুস ও মনতৌ শহরে সংঘটিত তিনটি ঘটনা একই ব্যক্তির কাজ। তিনটি ঘটনাতেই সে একই অস্ত্র ব্যবহার করেছে, একই ৫০০ সিসি ইয়ামাহা স্কুটারে চড়ে হত্যাকাণ্ড সংঘটনের স্থানে এসেছে এবং তিনটি ঘটনাতেই সে একই ধরনের ঠাণ্ডা মাথার নৃশংসতা দেখিয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো হত্যাকারী কেন তার টার্গেট হিসেবে ফরাসি মুসলিম সেনা ও ইহুদি শিশুদেরকে বেছে নিলো?
এ রহস্যের সমাধানে ফরাসি পুলিশ ভিন্ন ভিন্ন ধারণার ওপর ভিত্তি করে অগ্রসর হচ্ছে।
প্রথম ধারণা হত্যাকারী চরম ডানপন্থী খ্রিস্টান মৌলবাদী। মনতৌ হত্যাকাণ্ডের শিকার তিন ফরাসি সেনা উত্তর আফ্রিকান বংশোদ্ভূত এবং চতুর্থ আহত সেনা ফ্রেঞ্চ ক্যারিবীয় বংশোদ্ভূত।
প্রথম দুটি হত্যাকণ্ডের ঘটনায় পুলিশ ধারণা করে মুসলিম ও কৃষ্ণাঙ্গ বিদ্বেষী কোনো খ্রিস্টান মৌলবাদী হত্যাকাণ্ডগুলোর পেছনে রয়েছে। কিন্তু তাদের ধারণা এলোমেলো হয়ে যায় সোমবারের হত্যকাণ্ডে। কারণ, ওই হত্যাকারী একই সঙ্গে ইহুদি বিদ্বেষী ধারণা দানা বাঁধে এই ঘটনার পরে।
হত্যাকারী অস্ত্র চালনায় অভিজ্ঞ এটা বোঝা যাচ্ছে তার গুলি চালানোর ধরনে। হতে পারে সে নিও নাজি (হিটলার অনুসারী) মতাদর্শের কোনো ফ্যানাটিক। তবে মানসিক বিকারগ্রস্ত কোনো সাবেক সেনা হওয়ার সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
আবার অপরাধ জগত সংশ্লিষ্ট কোনো বিকৃত অথচ ঠাণ্ডা মস্তিষ্কের খুনিও এর পেছনে থাকলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। সকল সংখ্যালঘু বিশেষ করে ইহুদি ও মুসলিমদের প্রতি হত্যাকারীর বিদ্বেষ চরম- প্রাথমিকভাবে এটিই মনে হচ্ছে।
তবে তদন্তকারীরা দুটি ধারণাকে সামনে রেখে তদন্ত শুরু করেন। তা হলো হত্যাকারী হয় উগ্র ইসলামপন্থি নয়তো চরম ডানপন্থি। এখনও এ ধারণা দুটোকে পুলিশ পুরোপুরি বাদ দেয়নি।
তবে রহস্য উদঘাটনের পরই হয়তো জানা যাবে হত্যাকারী কে? কী তার উদ্দেশ্য? কেন সে ঘটালো এই নির্মম হত্যাকাণ্ড?
এদিকে, মঙ্গলবার সকাল ১১টা থেকে ১ মিনিট নীরবতা পালনের মাধ্যমে ফ্রান্সবাসী শিশুদের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শোক প্রকাশ করে।
প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজি হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পরপরই তুলুসে উড়ে যান। ঘটনার পরপরই সমগ্র ফ্রান্স জুড়ে সকল মুসলিম ও ইহুদি ধর্মীয় স্থাপনার পাশাপাশি ধর্মীয় ভাবধারার অনুসারী বিদ্যালয়গুলোতে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে পুরো দক্ষিণ-পশ্চিম ফ্রান্সে সন্ত্রাসী হামলার বিরুদ্ধে সতর্কসংকেত জারি করা হয়েছে।
এদিকে শোকার্তরা বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এক পক্ষকালব্যাপী শোকপালনের উদ্দেশ্যে জড়ো হয়েছেন। রাজধানী প্যারিসেও হাজারো মানুষ নীরব পদযাত্রায় অংশ নিয়ে নিহতদের পরিবারের প্রতি তাদের সমবেদনা জানান।
অপরদিকে, এ ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থীরা তাদের সকল প্রচারণাকে বর্তমানে স্থগিত রেখেছেন। আগামী বুধবার অনুষ্ঠেয় নিহত সেনাদের অন্তেষ্টিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ পর্যন্ত নির্বাচনী প্রচারণাকে স্থগিত করেছেন প্রেসিডেন্ট সারকোজি স্বয়ং।
জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনও এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ সময় : ২২২৮ ঘণ্টা, মার্চ ২০, ২০১২
সম্পাদনা : রাইসুল ইসলাম, নিউজরুম এডিটর