কয়েক দশকে বাংলাদেশের চক্ষু চিকিৎসাসেবা অনেকটাই এগিয়েছে। বাংলাদেশ আই হসপিটাল অ্যান্ড ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. মাহবুবুর রহমান চৌধুরী একজন চিকিৎসক হিসেবে দেশে চোখের চিকিৎসাব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করছেন দীর্ঘদিন ধরে।
বাংলাদেশে চোখের চিকিৎসাব্যবস্থার বর্তমান ও সামগ্রিক চিত্র সম্পর্কে তিনি বলেন, সাধারণভাবে বলব, অন্তত চক্ষু চিকিৎসাব্যবস্থায় আমরা প্রায় আন্তর্জাতিক মানের। এ কথা এ জন্যই বলছি, বাংলাদেশ আই হসপিটালসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবার এই শাখায় আমরা অনেকটাই উন্নতি করেছি। আমরা খুব গর্ব করে বলতে পারি, সিঙ্গাপুর বা লন্ডনে যে অপারেশন (অস্ত্রোপচার) হয়, সেটা আমরা এখানেই করতে পারি।
আমাদের যন্ত্রপাতি সর্বোচ্চ প্রযুক্তির। আমরা যে মাইক্রোস্কোপ ও লেন্স ব্যবহার করি, তা-ও আন্তর্জাতিক মানের। অর্থাৎ সক্ষমতার দিক থেকে আমি বলব, আমরা আন্তর্জাতিক মানের। সবাই মিলেই এটা আমরা করতে পেরেছি।
কয়েক দশক আগের চিত্র সম্পর্কে চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. মাহবুবুর রহমান চৌধুরী কলেন, এ জায়গায় ছিলাম না আমরা। আমি ১৯৯২ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যাই ভারতের দিল্লিতে। গিয়ে মনে হলো, আমি এত দিন ছাদ দেখেছি, আর এখন আকাশ দেখছি। পার্থক্য ছিল এতটাই। এখন কিন্তু অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সবাই মিলে এই পরিবর্তন করেছে। এখন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গেলে মনে হয়, আমরাও তো এসব করছি। এই উপলব্ধি হয় যে অন্য দেশগুলোর প্রায় সমপর্যায়ে চলে এসেছি আমরা। চোখের চিকিৎসায় আমাদের সক্ষমতা আন্তর্জাতিক মানের বলছেন।
সেবা প্রদানের বিষয়টিও কী অন্তর্জাতিক মানের ও কোনো ঘাটতি আছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঘাটতি তো আছে অবশ্যই। এখনো আমাদের উন্নতির জায়গা রয়েছে। বিশেষ করে আমাদের (চিকিৎসক) বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আছে—আমরা ধৈর্য ধরে রোগীর কথা শুনি না, মনোযোগ দিই না। রোগীর যদি একটি কথাও বাকি থাকে, তাহলে তার মাথায় কিন্তু এই ভাবনা চলতে থাকবে যে সমস্যা তো পুরোটা বলতে পারলাম না, তাহলে চিকিৎসা কী সঠিক হবে। এ জন্য আমাদের দুটি দিকে মনোযোগ দিতে হবে—কথা শোনা ও ব্যবহার ভালো করা। রোগীর সঙ্গে ব্যবহারের দিক দিয়ে প্রতিবেশী দেশ, বিশেষ করে ভারত ও থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলোর তুলনায় আমরা পিছিয়ে আছি। ওরা হসপিটালিটি (আতিথেয়তা) ও হাসিমুখ দিয়ে আপনার মন জয় করে ফেলবে। এই জায়গায় আমাদের ঘাটতি রয়েছে এবং এর প্রভাবও পড়ছে আমাদের চিকিৎসাক্ষেত্রে। আমরা রোগীদের সেই আস্থা দিতে পারিনি বলেই তাঁরা বিদেশমুখী হচ্ছেন। চিকিৎসক হিসেবে বলতে পারি, নার্সিং স্টাফসহ অন্যান্য সহায়তা প্রদানকারী কর্মী, বিশেষ করে দলনেতা হিসেবে ডাক্তারদের এ ক্ষেত্রে অনেক সচেতন হওয়া উচিত।
আস্থাহীনতার এ পরিস্থিতির উন্নতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রোগীর মানসিক অবস্থাটা আমাদের চিকিৎসকদের বুঝতে হবে। তাঁদের যেন আমরা সম্মান দিই। ধরা যাক, আমাদের প্রায় এক হাজার ৫০০ জন চোখের ডাক্তার আছেন। তাহলে যে রোগী আমার কাছে এলেন, তিনি বাকি এক হাজার ৪৯৯ জনকে বাদ দিয়ে আমার কাছে এসেছেন। এই যে একজন রোগী সবাইকে বাদ দিয়ে আমার ওপর আস্থা রাখলেন, তাকেও তো আমার সেই সম্মান ও ভালোবাসাটা দিতে হবে। আমি চিন্তা করব, একজন রোগী আমার সঙ্গে কথা বলে খুশি মনে বাড়ি ফিরলেন কি না। আমার মনে হয়, এগুলো মাথায় রাখলে এ সমস্যাগুলোর অনেকটা সমাধান হতে পারে। আরেকটি বিষয় আমাদের মাথায় রাখতে হবে। আমরা সামান্য সর্দিকাশি হলেও বড় বিশেষজ্ঞ বা অধ্যাপকের কাছে চলে যেতে চাই। ফলে দেখা যায়, তাঁদের ওপরও চাপ বেশি পড়ে। স্বাভাবিকভাবেই তখন রোগীকে সময় কম দিতে পারেন তিনি। ফলে এ বিষয়েও আমাদের সবার একটু চিন্তা-ভাবনা বা সচেতনতার প্রয়োজন আছে।
রোগীদের বিদেশমুখিতা কমাতে প্রাতিষ্ঠানিক জায়গা থেকে হাসপাতালগুলোর ভূমিকার বিষয়ে এ চক্ষু বিশেষজ্ঞ বলেন, জনবল ও সেবার সহজলভ্যতা বাড়াতে হবে। আমাদের হাসপাতালের ১১টি শাখা—ঢাকায় সাতটি, চট্টগ্রামে দুটি এবং একটি করে শাখা রাজশাহী ও খুলনায়। এই সংখ্যা আরো বাড়াতে হবে। কারণ ১৮ কোটি মানুষের জন্য এটা যথেষ্ট নয়। আমি আশা করি, অন্য চক্ষু হাসপাতালগুলোও এটা ভাববে এবং আন্তর্জাতিক মানের চক্ষু চিকিৎসা বিভিন্ন জেলায় নিয়ে যাবে। তাহলে মানুষের বাইরে যাওয়ার প্রবণতা কমবে।
বাংলাদেশ আই হসপিটালের বিশেষত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, আমি যখন ছাত্র ছিলাম, তখন আমাদের অধ্যাপক চোখের সব বিষয়েই পড়াতেন এবং চিকিৎসা দিতেন। কিন্তু পরে দেখা গেল, চোখের চিকিৎসা নানা ভাগে, যেটাকে আমরা সাবস্পেশালিটি বলি—সেভাবে বিকশিত হয়েছে। ফলে কর্নিয়া বিশেষজ্ঞ, রেটিনা বিশেষজ্ঞ, গ্লকোমা বিশেষজ্ঞ, বাচ্চাদের চোখের বিশেষজ্ঞ, ল্যাসিক, লেজার ইত্যাদি বিশেষায়িত ভাগ দাঁড়িয়ে গেল। বাইরের দেশে চিকিৎসকরা গ্রুপ প্র্যাকটিস (দলগত চিকিৎসা) করেন এবং সাবস্পেশালিটি বজায় রাখেন। অর্থাৎ একজন রেটিনা বিশেষজ্ঞ রেটিনা নিয়ে এবং কর্নিয়া বিশেষজ্ঞ কর্নিয়া নিয়েই কাজ করেন। সেটা না হলে কিন্তু আন্তর্জাতিক মানে যাওয়া যাবে না। ২০০৪ সালে যখন বাংলাদেশ আই হসপিটাল করি, তখন থেকেই আমাদের চিন্তা ছিল, আমরা সাবস্পেশালিটি বজায় রাখব। আমাদের হাসপাতালে এখন এ রকম ১২টি বিভাগ রয়েছে। এই চর্চা কিন্তু আজ দেশের অন্যান্য হাসপাতালেও ছড়িয়ে পড়ছে।
চক্ষু চিকিৎসা সাধারণ মানুষের নাগালে রাখতে বাংলাদেশ আই হসপিটালের ভূমিকার বিষয়ে তিনি আরও বলেন, আমাদের ১১টি শাখার মধ্যে ১০টি বাণিজ্যিক শাখা। একটি শাখার নাম বাংলাদেশ আই ট্রাস্ট হসপিটাল। এটি রাজধানীর রায়েরবাজারে অবস্থিত। আর্থিক সমস্যার কারণে যাঁরা আমাদের অন্য শাখাগুলো থেকে চিকিৎসাসেবা নিতে পারেন না, তাঁদের জন্য বাংলাদেশ আই ট্রাস্ট হসপিটালে আমরা বিনামূল্যে ও স্বল্প খরচে একই মানের চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকি। আমরা সবাই এই হসপিটালের সঙ্গে জড়িত। এখানে আমরা অস্ত্রোপচারও করি। সেই সঙ্গে এখানে হাতে-কলমে চিকিৎসা প্রশিক্ষণ ও চিকিৎসা শেখানো হয়। আমরা চেষ্টা করছি নতুন একটি প্রজন্ম তৈরি করতে, যারা আমাদের স্বাস্থ্য খাতকে আরো মানবিক করবে এবং সামনের দিকে এগিয়ে নেবে।
বেসরকারি হাসপাতালগুলোর পর্যবেক্ষণ নিয়ে তিনি বলেন, আমি নিজেদের কথাই বলি। দেখুন, আন্তর্জাতিক মানের হতে হলে সবচেয়ে ভালো যন্ত্রপাতি, লেন্স, ওষুধ ইত্যাদি নিশ্চিত করতে হবে। যখনই আপনি ‘সবচেয়ে ভালো’ নিশ্চিত করতে চাইবেন, তখন সেখানে আবার অর্থ বা খরচও বেড়ে যাবে। এ জন্য বাংলাদেশ আই হসপিটালে অন্যান্য জায়গা থেকে খরচ একটু বেশি। আমরা তো কোথাও থেকে অনুদান পাই না। সুতরাং মান নিশ্চিত করতে গিয়ে আমাদের এ ক্ষেত্রে খুব বেশি কিছু করার সুযোগ থাকে না। এই জায়গায় কোনোভাবে একটা সমন্বয় আমাদের করতে হবে।
এ বিষয়ে সরকারের ভূমিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নিশ্চিতভাবেই আছে। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব হলে এ ক্ষেত্রে হয়তো অনেক কিছু করার সুযোগ আছে। এটা সরকার থেকে যেমন দেখতে হবে, তেমনি আমাদের, অর্থাৎ বেসরকারি চিকিৎসা খাতেরও উদ্যোগী হওয়া উচিত।
আমাদের দেশের রোগীদের চোখের সমস্যার বিষয়ে তিনি বলেন, অন্ধত্ব বা কম দেখার সমস্যা। এটি বয়সজনিত, মূলত ছানির কারণে হয়। তবে চিকিৎসা করালে ছানি পুরোপুরি ঠিক হয়ে যায়। ছানির সবচেয়ে আধুনিক চিকিৎসা আমাদের দেশে রয়েছে। আমি একটু গর্ব করে বলতে পারি, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে চোখের সবচেয়ে আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা ফ্যাকো সার্জারি কিন্তু আমিই প্রথম প্রবর্তন করেছি ১৯৯৫ সালে। ফ্যাকো সার্জারিতে কোনো কাটাছেঁড়ার প্রয়োজন হয় না। ছোট্ট একটি ফুটো করে ছানিটিকে ভাগ ভাগ করে গলিয়ে বের করে আনা হয়। ফুটোটাতে একটা লেন্স বসিয়ে দেওয়া হয়। কোনো সেলাই বা ব্যান্ডেজ থাকে না, রোগীকে হাসপাতালে থাকতে হয় না। এই ধরনের সার্জারি অনেক উন্নত ও মানসম্পন্ন। এই সার্জারি আমাদের চোখের চিকিৎসায় একটা বড় গুণগত পরিবর্তন নিয়ে এসেছে।
শিশু থেকে প্রবীণ—অনেকেই স্মার্টফোনে আসক্তিতে চোখের প্রভাব সম্পর্কে এ চক্ষু বিশেষজ্ঞ বলেন, চোখ দেহের সবচেয়ে মূল্যবান অঙ্গ। অতিমাত্রায় মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ বা ট্যাব ব্যবহার করছি আমরা অনেকেই। এতে চোখের ক্ষতি তো হচ্ছেই, মানসিক বিকাশও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবন থেকে মোবাইল বা কম্পিউটারের মতো প্রযুক্তিগুলো বাদ দিতে পারব না। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। দীর্ঘক্ষণ পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকলে তা চোখকে শুষ্ক করে ফেলে। এতে মস্তিষ্কও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সর্বোপরি চোখের প্রতি সবার যত্নবান হওয়ার পরামর্শ দিয়ে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, আমরা বলি, অন্তত বছরে একবার চোখের চিকিৎসক দেখানো উচিত। এটা না হলেও অন্তত তিন বছরে একবার চোখ পরীক্ষা করানো উচিত কোনো সমস্যা আছে কি না বোঝার জন্য। শিশুদের স্কুলে ভর্তি করানোর সময় একবার চোখ পরীক্ষা করানো উচিত। আমাদের একটা বড় অংশের ডায়াবেটিসের সমস্যা রয়েছে। ডায়াবেটিস কিন্তু চোখের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। ডায়াবেটিসের কারণে চোখের ছানি, রেটিনায় রক্তক্ষরণসহ নানাভাবে দৃষ্টিশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ফাস্ট ফুড ও ভেজাল খাদ্য আমাদের চোখের ক্ষতি করছে। সুষম খাদ্য নিশ্চিত করতে হবে। শাক-সবজি ও ছোট মাছ খেতে হবে। শরীরচর্চাসহ নিয়ন্ত্রিত ও স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করতে হবে, যাতে ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন (উচ্চ রক্তচাপ) ইত্যাদি থেকে দূরে থাকা যায়। কম্পিউটার, মোবাইল ও অন্যান্য ডিভাইস একটানা লম্বা সময় ধরে ব্যবহার করা যাবে না।
সূত্র: কালের কণ্ঠ
জেএইচ