ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইসলাম

‘যে ব্যক্তি নম্রতা থেকে বঞ্চিত, সে সব কল্যাণ থেকে বঞ্চিত’

ইসলাম ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৭, ২০২৩
‘যে ব্যক্তি নম্রতা থেকে বঞ্চিত, সে সব কল্যাণ থেকে বঞ্চিত’ প্রতীকী ছবি

রাগ বা ক্রোধ মনুষত্ব বিধ্বংসী একটি কু-রিপু। রাগের সময় মানুষের পশুসুলভ আত্মা সক্রিয় হয়।

বাহ্যিকভাবে চেহারার রং বিবর্ণ হয়ে যায়। আর শিরা-উপশিরা ফুলে-ফেঁপে উঠে। অনিয়ন্ত্রিত রাগ নিজের আমল-আখলাকের জন্য শুধু ক্ষতিকর এমন নয় বরং শরীরের জন্যও ক্ষতিকর। অতিরিক্ত রাগের কারণে, হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে; স্ট্রোকও করতে পারে। রাগের বশবতী হয়ে কারোর সঙ্গে অন্যায় আচরণ করা অত্যন্ত জঘন্য কাজ। শুধু রাগের কারণে, কর্মস্থলে কতো হেনস্তা হতে হয় ভুক্তভোগী সবারই জানা।

রাগ বা ক্রোধকে আরবিতে বলা হয় الغضب। আমরা কারো প্রতি অসন্তুষ্ট হলে বলে থাকি ‘তোর ওপর আল্লার গজব পড়ুক’। ওই গজবকেই আরবিতে ‘গদ্ব’ বলা হয়। বাংলায় এর অর্থ হচ্ছে রাগ, ক্রোধ।

তবে রাগের বিপরীত হলো সহনশীলতা। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার উম্মতকে অত্যন্ত কঠোরভাবে অনুশীলন করে যেসব চরিত্র অর্জন করতে বলেছেন, তার একটি হলো সহনশীলতা। হজরত জারীর (রা.) এর সূত্রে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি নম্রতা থেকে বঞ্চিত, সে সব কল্যাণ থেকে বঞ্চিত’। (সহিহ মুসলিম শরিফ) তাই এ সংক্রান্ত ইসলামের নির্দেশনা নিম্নে আলোচনা করা হলো।

রাগ ঈমানকে নষ্ট করে: হজরত বাহ্য ইবনে হাকীম রাযিআল্লাহু আনহু তার পিতার সূত্রে পিতামহ থেকে বর্ণনা করেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, রাগ ঈমানকে বিনষ্ট করে দেয়, সাবির গাছের তিক্ত রস যেমন মধুকে বিনষ্ট করে দেয়। (মেশকাত)

মোল্লা আলী কারী (রহ.) উক্ত হাদিসের ব্যাখ্যায় লেখেন, এখানে ঈমান নষ্ট দ্বারা ঈমানের পূর্ণতা ও নূর নষ্ট হওয়া উদ্দেশ্য। তবে কখনো কখনো মূল ঈমানও রাগের কারণে ঝুঁকিতে পড়তে পারে। (মেরকাত শরহে মেশকাত, খণ্ড-৯, পৃষ্ঠা-৩০৭)

এ বিষয়ে আল্লামা মনজুর নুমানী (রহ.) এর আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ মনে হওয়ায় নিম্নে তা তুলে ধরা হলো। তিনি লেখেন ‘মানুষের খারাপ স্বভাবগুলোর মাঝে রাগ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ একটি স্বভাব; এর পরিণতিও অনেক ভয়াবহ। কারো রাগ উঠলে, মহান আল্লাহর হুকুম-আহকাম, নিজের লাভ-ক্ষতির চিন্তা মাথায় থাকে না।


অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতার আলোকে বলা যায়, রাগান্বিত অবস্থায় শয়তান যত সহজে মানুষকে কাবু করতে পারে, অন্যকোনো অবস্থায় পারে না। মানুষ ঐ অবস্থায় নিজের নিয়ন্ত্রনে থাকে না, কেমন যেন ইবলিসের নিয়ন্ত্রনে চলে যায়। কখনো কখনো তো রাগের কারণে কুফুরি শব্দ বলে ফেলে। এজন্য নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাগকে ঈমান বিনষ্টকারী বলেছেন। (মাআরেফুল হাদীস, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-১৪৬)

রাগ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের সতর্কতা: রাগ দমন করা তাকওয়ার আলামত। যারা মুত্তাকি, তাদের আলামতের একটি হলো রাগকে সংবরণ করতে পারা। মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘(মুত্তাকি) যারা নিজেদের রাগকে সংবরণ করে আর ক্ষমা প্রদর্শন করে, বস্তুত আল্লাহ তায়ালা সৎকর্মশীলদেরকেই ভালোবাসেন। (সূরা আল ইমরান-১৩৪) অন্যত্র মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ভালো ও মন্দ সমান নয়। (মন্দের) মোকাবেল সেই পন্থায় করুন, যা উত্তম। তাহলে শত্রু ও আপনার মাঝ থেকে শত্রুতা দূর হয়ে, পরস্পর অন্তরঙ্গ বন্ধুতে পরিণত হবেন। (সূরা হা-মীম আসসাজদা-৩৪)

হজরত আব্দুল্লা ইবনে আব্বাস রাযিআল্লাহু আনহুমা এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, রাগের সময় ধৈর্য ধারণ করা এবং কোনো ব্যক্তি খারাপ আচরণ করলে মাফ করে দেয়া। (সহিহ বুখারি)

খারাপ লোকের দুষ্টামির ওপর যদি ধৈর্য ধরে থাকা যায়, অভদ্র আচরণের জবাবে ভালো ব্যবহার করা হয় তাহলে অচিরেই ঐ ব্যক্তির মাঝে পরিবর্তন ঘটবে। প্রকৃত অর্থে অন্তরঙ্গ বন্ধু না হলেও বাহ্যিকভাবে ভালো ব্যবহার করবে।

রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখা উত্তম চরিত্রের বুনিয়াদ: হজরত আবু হুরাইরা রাযিআল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, একবার কেউ এসে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট কিছু নসিহত করার আবেদন করলেন। (নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কথা তো ছিলো ‘জাওয়ামিয়ুল কালিম’ অর্থাৎ অল্প কথা, কিন্তু অর্থ বেশি। তাই তিনি লম্বা বয়ান দিলেন না বরং শুধু বললেন) রাগ করবে না। আরো কিছু নসিহত শুনার আশায়, লোকটি কয়েকবার একই আবেদন করলেন, প্রত্যেকবার নবী করিম (সা.) বললেন, রাগ করবে না। (সহিহ বুখারি)

আরও কয়েকজন বর্ণনাকারী উল্লিখিত হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। তবে তাদের বর্ণনায় কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। যেমন- হজরত আবিদ দুনিয়া (রাহ.) এর এক বর্ণনায় এসেছে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, রাগ করবে না, কেননা রাগ বিনষ্টকারী। হজরত আবু দারদা রাযিআল্লাহু আনহু এর সূত্রে হজরত আবিদ দুনিয়া (রাহ.) এর অন্য এক বর্ণনা ও ইমাম ত্ববরানী (রাহ.) এর বর্ণনাও হলো, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘রাগ করবে না তাহলে জান্নাত পেয়ে যাবে’। (মেরকাত শরহে মেশকাত, খণ্ড-৯. পৃষ্ঠা-২৯২) হাদিসের আলোচনা স্পষ্ট। লোকটি বারবার আবেদনের উদ্দেশ্য ছিলো, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছ থেকে বেশি নসিহত শুনা। কিন্তু প্রত্যেকবার নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে একটিই নসিহত করলেন, রাগ করবে না। কারণ, রাগ নিয়ন্ত্রন করতে পারা উত্তম চরিত্রের বুনিয়াদ। কারো এই বুনিয়াদ হয়ে গেলে বাকীগুলো অতি সহজে এসে যাবে-ইনশাআল্লাহ!

রাগ হজম করার ফজিলত: রাগ হজম করার বহু বিষয় রয়েছে। কিন্তু তার মাঝে সর্বোত্তম হলো, মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য রাগ হজম করা। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাযিআল্লাহু আনহু এর সূত্রে বর্ণীত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, বান্দা যা হজম করে কোনটিই ফজিলতের দিক থেকে এত ওপরের নয়, যতটুকু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য রাগ হজম করা হয়। (মুসনাদে আহমদ)

অপর এক হাদিসে এসেছে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি রাগের চাহিদা মিটানোর সুযোগ থাকা সত্তেও (একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য) রাগকে হজম করবে, হাশরের ময়দানে আল্লাহ তাআলা তাকে সমস্ত মাখলুকের সামনে ডাকবেন এবং ঘোষনা দেবেন যাও! জান্নাতের হুরদের মাঝে যাকে চাও নিয়ে নাও। (তিরমিযী ও আবু দাউদ)

অনেক সময়, কাজের লোক বা অন্য কোনো অধীনস্ত ব্যক্তি অন্যায় করে ফেলে। তখন জোরে থাপ্পড় না মেরে নিজের রাগকে যদি হজম করি তাহলে এই কোরবানির বদৌলতে মহান আল্লাহ তাআলা আখেরাতে বিশেষ পুরস্কার দান করবেন। সম্মানের জন্য সবার সামনে ডেকে তার এই মহৎ কর্মের প্রশংসা করবেন।

আমাদের অবস্থা আজ অবনতির দিকে যাচ্ছে। পান থেকে চুন খসলেই আমরা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠি। অন্যায়ের তুলনায় শাস্তির মাত্রা বহুমাত্রা বাড়িয়ে দেই। বিবেকের কাছে প্রশ্ন করা দরকার, যার সবকিছু আমরা ভোগ করে চলছি, তিনি যদি আমার মতো হতেন তাহলে আজ আমার কি অবস্থা হতো?

যে ব্যক্তি রাগ দমন করবে মহান আল্লাহ তাআলা তার আজাব মওকুফ করে দেবেন: ইমাম বায়হাকি (রাহ.) হাদিসটি শুয়াবুল ইমানে এনেছেন। হজরত আনাস রাযিআল্লাহু আনহু এর সূত্রে বর্ণীত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি অন্যের দোষ চর্চা থেকে নিজের যবানকে হেফাজত করবে আল্লাহ তাআলা তার দোষ গোপন রাখবেন। যে ব্যক্তি নিজের রাগকে হজম করবে আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের দিন তার আজাব মওকুফ করে দেবেন। কোনো ব্যক্তি আল্লাহর কাছে ওজর পেশ করলে, আল্লাহ তাআলা তা কবুল করবেন (তাকে মাফ করে দেবেন)।

সহনশীলতা মহান আল্লাহ তাআলার প্রিয় বস্তু: সহনশীলতা অর্থাৎ রাগের কাছে হার না মেনে নিজেকে নিয়ন্ত্রন করা মহান আল্লাহ তাআলার কাছে অনেক প্রিয় বিষয়। একবার নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট একটি প্রতিনিধি দল এসেছিলো। সে প্রতিনিধি দলের প্রধানকে লক্ষ করে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমার মাঝে দুটি গুণ রয়েছে, যা আল্লাহ তাআলা পছন্দ করেন। একটি হলো সহনশীলতা আর অপরটি হলো ধীরস্থিরতা। (মুসলিম)

রাগ নিয়ন্ত্রণে করণীয়: রাগ নিয়ন্ত্রন করতে হলে প্রথমত নিজের অহংকার দূর করতে হবে। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও রাগ নিয়ন্ত্রনের জন্য বিভিন্ন তদবির বলেছেন; সেগুলোর ওপর আমল করলে রাগ নিয়ন্ত্রন হয়ে যাবে, ইনশাআল্লাহ!

রাগের সময় বসে যাওয়া: রাগকে নিয়ন্ত্রনে আনার জন্য ইহা একটি পদ্ধতি। হজরত আবু যর গিফারী রাযিআল্লাহু আনহু এর সূত্রে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণীত, তিনি বলেন, তোমাদের কারো রাগ উঠলে, সে যদি দাঁড়ানো থাকে তাহলে উচিত হলো বসে যাওয়া। (যদি বসার দ্বারা রাগ থেমে যায় তাহলে ভালো; অন্যথায়) তার উচিত শুয়ে পড়া। (মুসনাদে আহমদ-তিরমিযী)

শরহুস সুন্নাহ নামক কিতাবে এই হাদিসের ব্যাখ্যায় লেখা হয়েছে, ‘বসা বা শুয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যেন রাগের মাথায় এমন কোনো কাজ না করে, যার কারণে পরে লজ্জিত হতে হয়। কেননা, বসার কারণে অনাকাঙ্খিত কোনো ঘটনা সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। তার চেয়ে সম্ভাবনা কম থাকে যদি শুয়ে পড়ে। ইমাম ত্বিবী (রাহ.) বলেন, হাদিস দ্বারা হয়তো বিনয়ী হওয়া উদ্দেশ্য। কেননা, রাগের বড় কারণ হলো অহংকার। (মেরকাত শরহে মেশকাত, খণ্ড-৯. পৃষ্ঠা-৩০২)

কোনো কোনো বর্ণনায় ওজুর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেমন- হজরত আতিয়্যা ইবনে উরওয়া সায়দি রাযিআল্লাহু আনহু এর সূত্রে বর্ণীত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, রাগের অবস্থায় সীমালঙ্ঘন শয়তানের প্ররোচনায় হয়ে থাকে। শয়তানকে সৃষ্টি করা হয়েছে আগুন দ্বারা। আর পানি দ্বারা আগুন নিভানো যায়। এজন্য কারো রাগ উঠলে, উচিত হলো ওজু করা। (আবু দাউদ)

এক বর্ণনায় রাগের সময় চুপ থাকার কথা এসেছে এবং এ কথা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনবার বলেছেন।

সবশের্ষ কথা হলো, আমাদের অবস্থা এতই নাজুক যে, ক্ষমা বা চুপ থাকার মতো মহৎ গুণগুলোকে দুর্বলতা ভাবা হয়। আর সামান্য কিছুতেই ক্ষেপে গিয়ে কয়েকটি মেরে দিতে পারলে, মনে করা হয় বাপের বেটা! কিন্তু প্রকৃত অর্থে বাপের বেটা ওই ব্যক্তি, যে শাস্তি দিতে সক্ষম কিন্তু শারাফতের কারণে ক্ষমা করে দেয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৭২০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৭, ২০২৩
জেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।