ঢাকা, বুধবার, ২৬ ভাদ্র ১৪৩২, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

ইসলাম

সাম্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা.)-এর কর্মসূচি

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০:৩৬, সেপ্টেম্বর ১০, ২০২৫
সাম্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা.)-এর কর্মসূচি মহানবী (সা.)-এর রওজা মোবারক

ইতিহাসের পাতায় তাকালে দেখা যায়, মানবসমাজে যখন নৈতিকতা ও আদর্শ বিলুপ্তির পথে, তখন মহান আল্লাহ মানবজাতির হেদায়েতের জন্য নবী ও রাসুল পাঠিয়েছেন। এই ধারাবাহিকতার সর্বশেষ নবী ও রাসুল হিসেবে মুহাম্মদ (সা.) আগমন করেন।

তিনি শুধু ধর্মীয় দিক থেকে নয়, বরং সমাজসংস্কারক হিসেবেও মানবজাতির ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

মহানবী (সা.)-এর আগমনের আগে আরবের সমাজে ছিল চরম অরাজকতা, নৈরাজ্য ও নৈতিকতার অধঃপতন।

সেই যুগকে ‘জাহেলিয়াত’ বা অজ্ঞতার যুগ বলা হয়। সে সময়ে হত্যা, রক্তপাত, নারীর প্রতি অবমাননা, দাস প্রথা, মদ্যপান, জুয়া, ছলচাতুরীসহ অসংখ্য জুলুম ও কুসংস্কারে সমাজ আচ্ছন্ন ছিল, বিশেষ করে নারীর অবস্থা ছিল করুণ। কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করলেই তাকে জীবন্ত কবর দেওয়া হতো। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর যখন তাদের কাউকে কন্যাসন্তানের সুসংবাদ দেওয়া হয়, তখন তার মুখ অন্ধকার হয়ে যায় এবং সে ক্ষোভে পূর্ণ থাকে। ’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৫৮)

এই ভয়াবহ সমাজব্যবস্থার সংস্কার করে মহানবী (সা.) একটি সোনালি সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর সমাজ সংস্কারের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দিক তুলে ধরা হলো—
১. নৈতিক মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠা : মহানবী (সা.)-এর সমাজ সংস্কারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা। তিনি বলেন, ‘আমি নৈতিক গুণাবলির পূর্ণতা দানের জন্য প্রেরিত হয়েছি। ’ (মুয়াত্তায়ে মালিক, হাদিস : ১৬৮৬)

তিনি সত্যবাদিতা, আমানতদারিতা, ন্যায়বিচার, দয়া ও ক্ষমাশীলতার মতো গুণাবলি সমাজে প্রতিষ্ঠা করেন।
মিথ্যাচার, প্রতারণা, অন্যায় ও অবিচারকে তিনি সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করার নির্দেশ দেন।

২. নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা : নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মহানবী (সা.)-এর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি নারীদের শিক্ষা গ্রহণ, সম্পত্তির অধিকার, উত্তরাধিকার এবং বিবাহ ও তালাকের অধিকার প্রদান করেন। তিনি বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম, যে তার স্ত্রীদের প্রতি উত্তম আচরণ করে। ’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৩৮৯৫)
মহানবী (সা.) নারীদের শিক্ষা, সম্পত্তির অধিকার ও মতামতের গুরুত্ব নিশ্চিত করেছেন।

তিনি বলেছিলেন, ‘যে ব্যক্তি দুটি কন্যাসন্তানের লালন-পালনে ধৈর্য ধরবে, সে জান্নাতে আমার সঙ্গী হবে। ’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৬৩১)
তিনি নারীদের মা, স্ত্রী, কন্যা ও সুনাগরিক সব পরিচয়ে সম্মানিত করেছেন এবং সমাজে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করেছেন। ফলে সমাজে নারীর অবস্থান উন্নত হয় এবং নারী-পুরুষের মধ্যে পারস্পরিক সম্মান ও দায়িত্ববোধ সৃষ্টি হয়।

৩. দাস প্রথা বিলুপ্তির প্রচেষ্টা : মহানবী (সা.) দাস প্রথাকে পুরোপুরি নিষদ্ধি না করলেও তিনি এমন অনেক পদক্ষেপ নিয়েছেন যার ফলে দাস প্রথা বিলুপ্ত হয় এবং দাসরা মালিকদের থেকে ন্যায্য অধিকার লাভ করে। যেমন তিনি দাসমুক্ত করাকে সওয়াবের কাজ বলেছেন, ইসলামী শরিয়ত একাধিক অপরাধের প্রতিবিধান হিসেবে দাসমুক্তির কথা বলেছে। যেমন কসমের প্রতিবিধানে আল্লাহ বলেন, ‘এর প্রতিবিধান ১০ জন দরিদ্রকে মধ্যম ধরনের খাবার দান করা, যা তোমরা তোমাদের পরিজনকে খেতে দাও, অথবা তাদেরকে বস্ত্রদান, কিংবা একজন দাস মুক্তি। আর যার সামর্থ্য নেই তার জন্য তিন দিন রোজা পালন করা। ’
(সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৮৯)

৪. সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা : মহানবী (সা.) জাতি, গোত্র, বর্ণ বা ভাষার ভিত্তিতে কোনো প্রকার বৈষম্যকে স্বীকৃতি দেননি। তিনি বলেন, ‘সব মানুষ আদমের সন্তান। আর আদম মাটি থেকে সৃষ্ট। আরবের ওপর অনারবের এবং অনারবের ওপর আরবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই, আল্লাহভীতি ছাড়া। ’ (মুসনাদ আহমাদ, হাদিস : ২২৯৭৮)

এ বক্তব্যে তিনি মানবসমাজে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তি স্থাপন করেন। এই আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি ‘মুয়াখাত’ (ভ্রাতৃত্ব স্থাপন) প্রথা চালু করেন, যার মাধ্যমে মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব গড়ে তোলা হয়।

৫. অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার : অর্থনৈতিক শোষণ রোধে মহানবী (সা.) সুদ নিষদ্ধি করেন এবং ব্যবসায় সততা বজায় রাখার আদেশ দেন। তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি প্রতারণা করে, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়। ’ (মুসলিম, হাদিস : ১০১)

তিনি জাকাত প্রথা চালু করে ধনী-গরিবের মধ্যে সম্পদের ভারসাম্য স্থাপন করেন। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে সমাজের দরিদ্র শ্রেণির মানুষের অধিকার নিশ্চিত হয়।

৬. শিক্ষা ও জ্ঞানের প্রসার : মহানবী (সা.) জ্ঞানার্জনের ওপর অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, ‘জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর ওপর ফরজ। ’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২২৪)

তিনি বদর যুদ্ধের বন্দিদের মুক্তির শর্ত হিসেবে মুসলিমদের শিক্ষাদানকে নির্ধারণ করেন। এটি ছিল শিক্ষা প্রসারে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

৭. ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি বন্ধ : মহানবী (সা.) সব সময় ধর্মীয় গোঁড়ামি ও বাড়াবাড়ির বিরোধিতা করেছেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা বাড়াবাড়ি কোরো না, কারণ তোমাদের পূর্ববর্তী অনেক জাতি ধ্বংস হয়েছে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কারণে। ’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৩০৫৭)

তিনি ইসলামকে সহজ, সরল ও মানবিক জীবনব্যবস্থা হিসেবে উপস্থাপন করেন এবং কোনো মানুষকে জোরপূর্বক ধর্মে প্রবেশ করাতে নিষেধ করেন। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘ধর্মে জবরদস্তি নেই...। ’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ২৫৬)

৮. যুদ্ধক্ষেত্রে নীতি ও মানবতা : যুদ্ধের সময়ও মহানবী (সা.) শৃঙ্খলা ও নৈতিকতা বজায় রাখার নির্দেশ দেন। তিনি স্পষ্টভাবে নিষেধ করেছেন যে শিশু, বৃদ্ধ, নারী, সন্ন্যাসী ও নিরস্ত্রদের হত্যা করা যাবে না। গাছপালা, ফসল, পশু ও উপাসনালয় ধ্বংস করা যাবে না। তিনি বলেন, ‘আল্লাহর নামে যুদ্ধ করো, কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা কোরো না, লাশ বিকৃত কোরো না, শিশুদের হত্যা কোরো না। ’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ২৬১৪)

৯. অসহায় ও দুর্বলদের প্রতি দয়া : মহানবী (সা.) সব সময় সমাজের দুর্বল, দরিদ্র ও নিপীড়িত শ্রেণির পাশে দাঁড়িয়েছেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা তোমাদের দুর্বলদের কারণে সাহায্যপ্রাপ্ত হও এবং রিজিক লাভ করো। ’ (আবু দাউদ, হাদিস : ২৫৯৪)
তিনি এতিম, গরিব, দাস ও অভাবীদের প্রতি দয়া প্রদর্শনের জন্য উৎসাহিত করেছেন এবং সমাজকে তাদের দায়িত্ব নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

১০. সংঘাত নয়, শান্তি প্রতিষ্ঠা : মহানবী (সা.) সংঘাতের পরিবর্তে শান্তিকে প্রাধান্য দিতেন। তিনি হুদাইবিয়ার সন্ধির মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাঁর আগ্রহ ও ইচ্ছার প্রমাণ পেশ করেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা যদি সন্ধির দিকে ঝুঁকে পড়ে, তবে তুমিও সন্ধির দিকে ঝুঁকবে এবং আল্লাহর ওপর নির্ভর করবে। তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। ’ (সুরা : আনফাল, আয়াত : ৬১)

মহানবী মুহাম্মদ (সা.) শুধু ধর্মীয় নেতাই ছিলেন না, বরং একজন সমাজসংস্কারক, নৈতিক আদর্শের প্রবর্তক এবং মানবতার মুক্তিদাতা ছিলেন। তাঁর শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে একটি বর্বর, ভ্রান্ত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন জাতিকে একটি সুব্যবস্থাপূর্ণ, ন্যায়ভিত্তিক ও নৈতিক সমাজে পরিণত করা সম্ভব হয়েছিল। আজকের আধুনিক সমাজেও তাঁর আদর্শ চিরকাল প্রাসঙ্গিক ও অনুসরণীয়।

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।