দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের সমৃদ্ধ দেশ ক্রোয়েশিয়া। আধুনিক ফুটবলের কারণে অগ্রসর এই দেশ সবার কাছে বহুল পরিচিত।
সাম্প্রতিককালে সমগ্র বিশ্বে ইসলাম যখন ক্রমবর্ধমান ও দ্রুত বিকাশমান ধর্ম হিসেবে অগ্রসর হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে ক্রোয়েশিয়া মোটেও পিছিয়ে নেই।
ক্রোয়েশিয়ার পরিচিতি : জনসংখ্যা, ভূগোল ও ধর্ম
ক্রোয়েশিয়া আড্রিয়াটিক সাগরের তীরে অবস্থিত। এর উত্তরে হাঙ্গেরি, পূর্বে সার্বিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্বে বসনিয়া-হার্জেগোভিনা ও মন্টিনেগ্রোর অবস্থান। দেশটির ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ।
১৯৪১ সালে ক্রোয়েশিয়া যুগোস্লাভিয়ার কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। এর রাজধানী জাগরেব। দেশটির আয়তন ৫৬ হাজার ৫৯৪ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা ৪৫ লাখ ৮০ হাজার।
ক্রোয়েশিয়ার প্রধান ধর্ম খ্রিস্টধর্ম। দেশটির প্রায় ৭৯ শতাংশ লোক রোমান ক্যাথলিক। জনসংখ্যার ১.৭৫ শতাংশ মাত্র মুসলিম। মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ সেন্টারের হিসাব মতে, দেশটিতে বর্তমানে ৭৫ হাজার মুসলমান বাস করে। এই জনসংখ্যার বেশির ভাগ নও-মুসলিম।
ক্রোয়েশিয়ায় ইসলামের আগমন
ক্রোয়েশিয়ায় ইসলামের আগমন ঘটে ১৫ থেকে ১৬ শতকের মধ্যে। তখন প্রায় শত বছর স্থায়ী ক্রোয়েশিয়ান-অটোমান যুদ্ধের সময়কালে দেশটিতে ইসলামের অনুপ্রবেশ ঘটে বলে জানা যায়। এ সময় ক্রোয়েশিয়ান রাজ্যের কিছু অঞ্চল অটোমান মুসলমানদের দখলে আসে। তখন মুসলমানদের কিছু সদস্য ওই সব অঞ্চলে থেকে যায়। তাদের মাধ্যমে সেখানে মুসলিম বসতি গড়ে ওঠে। এর ফলে সেসব এলাকায় ইসলাম বিস্তার লাভ করে। তা ছাড়া স্থানীয় ক্রোয়েশিয়ান অধিবাসীদের অনেকে ইসলামের সুষমায় আকৃষ্ট হয়ে ধর্মান্তরিত হয়। এভাবে ক্রোয়েশিয়ায় ইসলামের সূচনা ও বিস্তার হয়।
এরপর ধীরে ধীরে দেশটিতে অনেক অভিবাসী মুসলিম ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী এবং অন্যান্য কারণে ক্রোয়েশিয়ায় আগমন করে, বিশেষ করে সেখানে আলবেনিয়া, বসনিয়া ও হার্জেগোবিনা থেকেও মুসলমানরা ক্রোয়েশিয়ায় পাড়ি জমায়। তা ছাড়া দেশটিতে আগমন ঘটে তুর্কি, ম্যাসিডোনিয়ান, মন্টিনেগ্রোর অধিবাসীর। আধুনিক সভ্যতার নানা কূটনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কারণেও বিভিন্ন মুসলিম দেশ ক্রোয়েশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে। প্রতিষ্ঠিত হয় বিভিন্ন মুসলিম দেশের দূতাবাস। তাদের প্রভাবে ক্রোয়েশিয়ায় গড়ে ওঠে ইসলামী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান—মসজিদ, ইসলামিক সেন্টার এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন। এসব সংগঠন ও সংস্থার তৎপরতায় ক্রোয়েশিয়ায় ইসলামের ক্রম বিস্তার ঘটে।
ক্রোয়েশিয়ায় ইসলামের বিকাশ ও বর্তমান অবস্থা
ক্রোয়েশিয়ায় অটোমান শাসনামলে ইসলামের আগমন ঘটলেও সেখানে প্রথম আধুনিক মসজিদ স্থাপিত হয় ১৯৬৯ সালে। দেশটির গুঞ্জায় এই মসজিদ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বর্তমানে ক্রোয়েশিয়ায় মোট ১১টি মসজিদ এবং দুটি ইসলামিক কেন্দ্র রয়েছে। মসজিদের পাশাপাশি আছে কোরআন শিক্ষার ব্যবস্থা। রাজধানী জাগরেব ও রিজেকা শহরে ইসলামিক কেন্দ্র দুটি অবস্থিত।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ক্রোয়েশিয়ায় অটোমান শাসনামলে ২৫০টি মসজিদ ছিল। কিন্তু ২০১৪ সাল পর্যন্ত সেখানে মাত্র তিনটি স্থাপনা টিকে ছিল। এ সময়ের মধ্যে মসজিদগুলোও ধ্বংস করা হয়। আবার কোনো কোনো মসজিদকে গির্জায় রূপান্তর করা হয়।
ইসলামের কাজ করা এবং ক্রোয়েশিয়ান মুসলমানদের নানা সমস্যা সমাধানের জন্য দেশটিতে একটি ইসলামী সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর নাম ‘ক্রেয়েশিয়ান ইসলামিক কমিউনিটি’। এটি রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত একটি সংগঠন। এই সংগঠন মুসলমানদের সাহায্য-সহযোগিতা করা এবং নানা প্রকার সমস্যা সমাধানের জন্য নানা কর্মসূচি পালন করে। ক্রোয়েশিয়ার মসজিদ এবং ইসলামিক সেন্টারগুলোতে কোরআন ও ইসলাম শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। মুসলমানদের বিয়ে ও ইসলামী বিভিন্ন অনুষ্ঠান মসজিদকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হয়।
ক্রোয়েশিয়ায় প্রায়ই বিভিন্ন দেশ থেকে তাবলিগ জামাত আগমন করে। তারা ইসলাম প্রচার ও প্রসারের জন্য স্থানীয়দের মধ্যে দাওয়াতি কাজ করেন। ক্রোয়েশিয়ার সংবিধানে ধর্মীয় স্বাধীনতা স্বীকৃত। তাই দেশটিতে ইসলামের কাজ করার ক্ষেত্রে আইনগত কোনো বাধা নেই।
লেখক: প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক ও সাবেক অ্যাডিশনাল ম্যানেজিং ডিরেক্টর, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক