সৌদি আরব (রিয়াদ) থেকে: পবিত্র কাবা থেকে ভেসে আসছিল ফজরের সুমধুর আযানের ধ্বনি। ভোরের আলো না ফুটলেও দৃষ্টিনন্দন কৃত্রিম আলোয় রাস্তাঘাটসহ পুরো নগর যেন দিনের মতই ঝলমল করেছিল।
মনোমুগ্ধ এ পরিবেশের মধ্যদিয়ে ইব্রাহিম খলিল রোড ধরে মিসফালা হয়ে দলে দলে মানুষ ছুটছেন মক্কার পবিত্র মসজিদুল হারামের দিকে। উদ্দেশ্য ফজরের নামাজ আদায়।
অবশ্য পথে নামাজ শুরু হয়ে গেলে মুসল্লিরা দল বেঁধে রাস্তায় দাঁড়িয়ে যান। নামাজ আদায় শেষে উমরাহ পালনকারীরা উমরাহ করেন। এভাবে প্রতিনিয়ত দিনরাত আল্লাহর ঘর পবিত্র কাবা শরীফে উমরাহ পালন করেন দেশ বিদেশের লাখো মুসল্লি।
পবিত্র মসজিদুল হারামের আশপাশে দিনে রাতে দেখতে পাবেন ঝাঁকে ঝাঁকে কবুতর। কোথা থেকে এসেছে এসব কবুতর জানা নেই কারো। নয়নাভিরাম কালো-ধূসর-সাদা রঙ, মোহনীয় চোখ আর লম্বা ঘাড়ের এসব কবুতর আপনভাবে মিশে থাকে কাবায় আসা হজ্ব-উমরাহ ও নামাজ আদায়কারীদের সঙ্গে।
তাদের অনেকে হারাম কবুতর বলে। দেখলে মনে হয় যেন পবিত্র কাবার প্রবেশ পথে এসব কবুতর মসজিদুল হারামে আগত মানুষদের স্বাগত জানাচ্ছে। এরা কখনো ভীত হয় না। সহজেই মিশে যায় মানুষের সঙ্গে।
মক্কার কবুতরগুলোকে ঐতিহাসিকভাবে পবিত্র ও নিরাপদ মনে করা হয়। এ কারণে এসব কবুতরের ক্ষতি সাধন বা হত্যা করা ইসলামে নিষিদ্ধ। ফলে এদের কেউ কোনো ক্ষতি করে না।
মসজিদ আল হারামের খুব কাছে জমজম টাওয়ার। যা ক্লক টাওয়ার হিসেবে মানুষের কাছে পরিচিত। ঠিক কাছেই মিসফালা। ইব্রাহিম খলিল রোড মিসফালা হয়ে অতিবাহিত। সেই রোডের শেষপ্রান্তে মাঠের মত বেশ খানিকটা খোলা জায়গা। যা মানুষের কাছে কবুতর চত্বর হিসেবে পরিচিত।
সার্বক্ষণিক এ চত্বরেই উড়ে বেড়ায় এসব কবুতর। বেশি উচ্চুতায় ওঠে না এসব কবুতর। আবার মসজিদুল হারামের দিকেও যায় না। কাবার প্রবেশ পথই যেন কবুতরগুলোর ঠিকানা। দিন রাত ধরে চলে তাদের উড়ে বেড়ানো। আল্লাহর ঘরে আসা নানা বয়সী মানুষের সঙ্গে মিলে মিশে থাকে কবুতরগুলো।
বিরামহীন উড়ে বেড়ানো এসব কবুতরের খাবারের টেনশন করতে হয় না। কাবায় আগতরা তাদের খাবার দিয়ে থাকেন। সেখানে একদল মানুষ খাবার বিক্রি করেন। এ কাজে নারীদেরও দেখা যায়। গম, জব, ভুট্টা দানা কবুতরের খাবার হিসেবে বিক্রি হয়। একদল খাবার খেয়ে চলে যাচ্ছে। আরেকদল সেই ফাঁকা জায়গায় বসে খাবার খাচ্ছে।
শিশু-কিশোরসহ সব বয়সী মানুষ এ পথেই পবিত্র কাবায় আসা যাওয়া করেন। এ সুযোগে কবুতর চত্বরের শান্তিময় পরিবেশে সময় কাটান খানিকটা। পরম মমতায় এসব কবুতরের মাঝে খাবার ছিটিয়ে তৃপ্ত হন তারা। কবুতরময় আধ্যাত্বিক অনুভূতিতে ভরপুর এ চত্বরে বিরাজ করে চমৎকার প্রাকৃতিক পরিবেশ। যা সবার মনে এনে দেয় অপার্থিব আনন্দ।
ওদিকে কিছুক্ষণ পরপরই এখানে চলে আসে পরিচ্ছন্নতার কাজে নিয়োজিত গাড়ি। পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা সেই খাবারের উচ্ছিষ্ঠ দ্রুত সরিয়ে ফেলে। পরে আবার একইভাবে আগতরা খাবার ছিটিয়ে দেন। এভাবে চলতেই থাকে দিন রাত।
ইসলামের ইতিহাস মতে, মক্কার অমুসলিম কুরাইশ নেতারা নবী (সা.) কে হত্যার ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। এ কারণে হিজরত করতে তিনি মদিনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সঙ্গী হন অন্যতম সাহাবী হজরত আবু বকর (রা.)।
পথে আশ্রয় নেন পর্বতের গুহায়। যেটির নাম গাড়ে সাওর বা সাওর গুহা। পর্বতটির অবস্থান মক্কা থেকে মিসফালার দক্ষিণে। উচ্চতা ৭৫০ মিটারের বেশি। মসজিদ আল হারাম থেকে ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে এ পর্বত অবস্থিত।
এদিকে মক্কার নেতারা ঘোষণা দেয়, নবী (সা.) কে যারা জীবিত বা মৃত ধরে দিতে পারবে, তাদের ১০০ উট পুরস্কার দেওয়া হবে। এ লোভে নবী (সা.) কে ধরতে তার খোঁজ শুরু করে লোকজন। মক্কার নেতারা চলে আসে সেই গাড়ে সাওর পর্বতের গুহার সামনে। কিন্তু আল্লাহর আদেশে সেখানকার অবস্থা মুহূর্তে পাল্টে যায়।
গুহার মুখে কবুতরের বাসা দেখে থমকে যায় মক্কার নেতারা। বাসায় ছিল ডিম। আর সেই ডিমে তা দিচ্ছিলো কবুতর। পাশাপাশি ছিল মাকড়াসার বুনোনো জাল। এসব দৃশ্য দেখে তারা ঘুরে দাঁড়ায়। এ অবস্থায় গুহায় কোনো মানুষ নেই ভেবে কুরাইশ নেতারা স্থান ত্যাগ করে চলে যায়।
আর এসব কবুতর সেই কবুতরের বংশধর বলে মনে করেন অনেকে। অবশ্য অনেকে আবার নূহ (আ.) এর জাহাজে থাকা কবুতরের বংশধর মনে করেন বর্তমান কবুতরগুলোকে।
সেই থেকে এসব হারাম কবুতর মুসলিমের কাছে বিশেষ মর্যাদা পাচ্ছে। এসব কবুতরকে আরবরা পবিত্র প্রাণী মনে করে থাকেন। সব মিলে হারাম কবুতরগুলো যেন আল্লাহর নিরাপদ আশ্রয়ের প্রতীক।
এমবিএইচ/এসআই